আফসান চৌধুরী, প্রবীণ সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক। সত্তর দশকের মাঝামাঝি ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র’ গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে শুরু করেছিলেন একাত্তর নিয়ে গবেষণা। সেই থেকে আজও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অবিরত চলছে তার গবেষণা। বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলা ট্রিবিউনের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি।
বাংলা ট্রিবিউন: কয়েক দশক ধরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখে চলছেন। এখন আপনার গবেষণায় একাত্তরের সামাজিক প্রসঙ্গ, বিশেষ করে নারী, সংখ্যালঘুসহ প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠীর ভূমিকা গুরুত্ব পাচ্ছে। এতে শহুরে সমাজ কি কিছুটা কম গুরুত্ব পাচ্ছে?
আফসান চৌধুরী: এই ধারণা ঠিক না। আমরা সব পরিসরের ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছি । আমাদের ২০টি’র মতো বই প্রকাশিত হয়েছে , গণহত্যা, প্রতিরোধ থেকে মুজিবনগর ও একাত্তরের মিডিয়া। এছাড়া আছে তিনটি মাঠ পর্যায়ের তথ্যভিত্তিক বই, সামাজিক ইতিহাস। তার মধ্যে একটা হচ্ছে গ্রাম। অন্য গ্রন্থে শহর ও গ্রাম উভয় আছে। বিষয়ভিত্তিক বইতে তথ্য এসেছে উভয় পরিসর থেকে, যেমন- নির্যাতন, যুদ্ধ, প্রতিরোধ ইত্যাদি। আমরা “একাত্তরপিডিয়া” শিরোনামে একটি ৬০০ পৃষ্ঠার বই তৈরি করেছি। ২০ চ্যাপ্টার, তার মধ্যে শহরের জন্য আছে একটা আলাদা চ্যাপ্টার।
তবে আমাদের দেশের ৭১-এর ইতিহাস চর্চায় রাষ্ট্রের ইতিহাসকে দেখি, সমাজের ইতিহাস অনেক কম । আমি মনে করি, রাষ্ট্র আর সমাজ দুটো আলাদা বাস্তবতা। দল বা গোষ্ঠীর রাজনীতির ইতিহাস বা যেভাবে রাষ্ট্র গঠন হয় সেটা সামনে এসেছে, সমাজের ভূমিকা তেমন আসেনি। ফলে আমরা তখনকার মানুষের জীবনের ইতিহাস বলতে পারি না, পাবলিকের ইতিহাসও বলতে পারি না। তখন ইতিহাস কিছু মানুষ ও ব্যক্তির অর্জন, বা একটি ছোট গোষ্ঠীর বা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস মূলধারা হয়ে যায়। ফলে একাত্তর সালের পরিপূর্ণ ইতিহাস অর্থাৎ রাষ্ট্রিক ও সামাজিক ইতিহাসের উভয়ের সম্পূরক বিবরণ পাওয়া কঠিন। ইতিহাসের অধিক অংশ হচ্ছে সমাজ। রাষ্ট্রিক ইতিহাস আছে, যেটা রাষ্ট্রের বাস্তবতায় আছে। কিন্তু সামাজিক বাস্তবতায় সেই ইতিহাস নাই তেমন। যদি না থাকে তাহলে রাষ্ট্রিক বাস্তবতাও ব্যর্থ হতে বাধ্য।
যেহেতু আমরা কেবল রাজনৈতিক ইতিহাস পড়ি এবং এটাকেই শুধু গুরুত্ব দেই, তাই আমরা সমাজের মানুষকে বাদ দেই ইতিহাস থেকে। গ্রামের ইতিহাসের ওপর আমাদের একটা বই আছে। তবে সব গ্রন্থে আমাদের সমাজকে জায়গা দেবার চেষ্টা করেছি। যেমন- হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর কম গবেষণা হয়েছে। যদিও নানা কারণে তারা ছিল সবচেয়ে নাজুক জনগোষ্ঠী। নারীর ইতিহাসকে আমরা অনেক সময় কেবল ধর্ষণ ও নির্যাতনের হিসেবে উপস্থিত করি। আমরা এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কাজ করিনি রাষ্ট্রের ইতিহাস থাকবে, আমাদের আছে, কিন্তু সমাজের ইতিহাস থাকতে হবে সম্পূর্ণ ইতিহাস জানতে। সমাজের যুদ্ধের কথা আমরা বলি কম, বন্দুক যুদ্ধের কথা বেশি।
৯৫ ভাগ মানুষ কিন্তু গ্রামের। এইটা হচ্ছে একাত্তরের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। কিন্তু তারা দলিলে বইতে নেই বলে ইতিহাসেও নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো দলিল রাখে না। সাধারণ মানুষ মনে রাখে। আমরা মাঠের গবেষণা করেছি, দলিলের গবেষণাও করেছি —তাই দুই পরিসরকেই সামনে আনার চেষ্টা করেছি ।
আমাদের প্রথম কাজ ‘বাংলাদেশ ৭১’, ২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ৪ খণ্ডের বই। তাতে নেতা থেকে সাধারণ মানুষের কথা আছে। সামাজিক ইতিহাস আর রাষ্ট্রিক ইতিহাস দুই আছে।
বাংলা ট্রিবিউন: মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সিরিজ বইসহ এ পর্যন্ত আপনার লেখা বইয়ের সংখ্যা কত? এসব বইয়ে আপনি যা লিখতে চেয়েছেন, তাকি পুরোপুরি পেরেছেন? এমনিতেই জীবিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কমে আসছে, সময়ের ব্যবধানে ইতিহাসের উপাদান খুঁজে পেতে বেগ পেতে হচ্ছে কিনা? আরেকটা বিষয়— গবেষণার ক্ষেত্রে ‘আমি’ না বলে ‘আমরা’ বলছেন কেন?
আফসান চৌধুরী: আমার ৭১-এর ইতিহাস চর্চা শুরু হয়েছিল ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের’ ১৫ খণ্ড দিয়ে। সেখানে আমরা দল হিসেবে কাজ করেছি। এ জন্য বইগুলো ‘আমার’ থেকে ‘আমাদের’ বেশি। দুই-একটি ছাড়া সবই সম্পাদিত বই, কেউ লেখক নন। আমরা দলিল নিয়ে, গবেষণা নিয়ে কাজ করি। বইয়ে ব্যক্তিগত মতামত আমরা দিই না। আমরা ব্যক্তিগত মতামতের বাইরে থেকে তথ্যগুলো উপস্থিত করি।
আমাদের ২০টি মতো বই বের হয়েছে। দুটি বাদে বাকি ১৮টি সম্পাদিত গ্রন্থ। আমরা মৌলিক তথ্য বা প্রাইমারি ডকুমেন্ট সংগ্রহ করি। বইয়ে প্রাইমারি ডকুমেন্ট তথ্য ও সোর্স ব্যবহার করি। আমরা লাইব্রেরিভিত্তিক গবেষণা করি না। আমরা মানুষের কাছে চলে গেছি এবং পাবলিক হিস্ট্রি নিয়ে কাজ করি। মানুষের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করি। গণহত্যা নিয়ে লিখতে গেলে ঘরে বসে, কী হয়েছিল সেরকম অঙ্ক কষে বই বের করার দরকার নেই। গণহত্যার বিষয়ে জানতে হলে গ্রামে যেতে হবে বা শহরে যেখানে হয়েছে, আমরা গিয়েছি। এজন্য বলি ‘আমাদের’। কারণ এই কাজ গোষ্ঠী ছাড়া সম্ভব না। লেখকরা নিজের মতামত প্রকাশ করেন বা বলেন। এটা ইতিহাস প্রথাগত চর্চার পদ্ধতি। আমরা তা করি না। আমরা মনে করি, তথ্যটাকে পৌঁছে দেওয়া প্রথম দায়িত্ব। আর ‘আমার’ কী মত এটা অনেক পরে আসা উচিত। কারণ আমি কে, যে বলবো তার কী হয়েছিল ? তার কথার মাঝখানে দাঁড়াবো কেন? আমাদের কাজ হলো যা বলছে সেটা ঠিক কিনা তা যাচাই করা। এ জন্য আমরা একেবারে সচেতনভাবে নিজেদের যতটা সম্ভব অদৃশ্য করে রাখার চেষ্টা করি গবেষণার কাজে, গ্রন্থ তৈরিতে।
বাংলা ট্রিবিউন: প্রশ্নটা আবারও করছি, আপনারা যা লিখতে চেয়েছেন, তা কি পুরোপুরি পেয়েছেন। কারণ আমরা দেখছি পাঁচ দশক হয়ে গেছে, অনেক ডকুমেন্ট হারিয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
আফসান চৌধুরী: আমরা যা চেয়েছি তা পুরোপুরি করতে পেরেছি। আমরা দলিলপত্রের তথ্যগুলো জানি, দলিলপত্রের সন্ধানগুলোও জানি। তো আমরা দলিলপত্রের ভিত্তিতে পেয়েছি। তারপর মানুষের কাছে গিয়ে জেনেছি। আমাদের যা করা দরকার বা বলা দরকার, আমরা সেটা বলেছি। তবে আমাদের পরের প্রজন্ম যদি কাজ করতে যায়, তারা অসুবিধায় পড়বে। কারণ আমরা কতটুকুই বা করতে পেরেছি, খুব ছোট একটা অংশ করতে পেরেছি। দিন যত যাবে তথ্য পেতে তত কঠিন হয়ে যাবে।
আমি দুটো দলিলপত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঘটনা বলি। মুজিবনগর সরকারের দলিলভিত্তিক ইতিহাসের সমস্যাটা কোন জায়গায়। মুজিবনগর সরকারের যে দলিলগুলো ছিল সেই দলিলগুলো ‘এমভি সানড্রা’ নামে একটি জাহাজে করে আনা হয়েছিল। জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিল। দলিলের ডকও করা হয়েছিল। কিন্তু সেই দলিলগুলো আজ কোথায় আছে, কেউ জানে না। তার মানে আমরা কম বেশি সবই হারিয়েছি।
আমার কপাল ভালো। আমি ওই সময় যেকোনও উপায়ে সন্ধান পেয়েছিলাম—মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা দফতরের দলিলগুলো হেলিকপ্টারে এসেছিল। আমি তখন প্রতিরক্ষা দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সে সময় আমার স্ত্রীর এক আত্মীয় ছিলেন। আমি তার নাম ভাঙিয়ে, তিনি জানতেন না যে আমি তার নাম ভাঙাচ্ছি, এটা করে আমরা দলিলগুলো নিয়ে আসছিলাম। বাংলাদেশের আজকের মানুষ, যারা মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের দলিলটা দেখতে পাচ্ছেন, এর কারণ হচ্ছে যে হেলিকপ্টারে করে দলিলগুলো আনা হয়েছিল। এরপর আর কোনও সূত্র থেকে দলিল পাওয়া যায়নি।
দ্বিতীয়টি হলো, ফরেন মিনিস্ট্রিতে প্যাঁচানো অবস্থায় একটা বাক্স ছিল। আমি বললাম, এটা দলিল হতে পারে কিনা? তখন খোলা হলো। সেটা ৭৭/৭৮ সালের ঘটনা। তখন দেখা গেলো যে বাক্সের ভেতরে একাত্তরের দলিল, মিডিয়া ক্লিপিং। সেখানে আমি একটা ফাইল পেলাম যেটাকে বলে ফাইল রেজিস্টার। ফাইল রেজিস্টারটা হচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, ফাইলের তালিকা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে কার্যক্রম ছিল সেগুলোর। আমি তখন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম যে সেখানে একটা দলিল, প্রথমে যেটা ছিল, সেটা মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী, অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর আলাপের মিনিটস। মানে মিটিংয়ের মিনিটস। এরকম ১৮০ থেকে ২০০টির মতো ফাইল ছিল। আমি তখন সন্ধান করা শুরু করি। সে সময় শিহাবুদ্দিন সাহেব ছিলেন (উনি মুজিবনগর সরকারের লোক ছিলেন), তিনি আমাকে সাহায্য করেছিলেন। রেহমান সোবহানের ছোট ভাই ফারুক সোবহান আমাকে ডকুমেন্টগুলো ব্যবহারের জন্য অনুমতিপত্রে সই করেন। আমি ফাইল রেজিস্টার নিয়ে এই রুম থেকে সেই রুম যাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত তারা বললো যে কোনও দলিল নাই। তার মানে বাংলাদেশ সরকারের কোনও দলিল ওখানে পাওয়া যায়নি। আমি খুব মর্মাহত হয়েছিলাম। পরে আমাকে একজন গোপনে বলেছিলেন— ফাইলগুলো নষ্ট করা হয়েছে। আমি বললাম কেন? তিনি বলেছিলেন যে নষ্ট করা হয়েছে, কারণ—মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যারা কর্মরত ছিলেন, এতে ছিল তাদের মতামত। তখন যদি এটা উন্মুক্ত হয়ে যায়, তাহলে তো ওদের পোস্টিং হতে সমস্যা হবে সেসব দেশে। সুতরাং, সেগুলো এভাবে নষ্ট করা হয়েছিল। মানে সরকারি যেটা রাষ্ট্রিক ইতিহাস, রাষ্ট্রের ইতিহাসের যে ভিত্তি বা দলিল, কোথায় সেই দলিল? এক কথায় নেই। আমরা যেগুলো চর্চা করি— সেগুলো খুবই সীমিত দলিলের ভিত্তিতে চর্চা করি। আবার সেনাবাহিনীর দলিলগুলো বলেছিল দেবে, কিন্তু দেয়নি। পরে সেনাবাহিনীর দলিলপত্র বের হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয়—যারা সেনাবাহিনীর ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন, তাদের গবেষণার জন্য সেগুলো ভালোভাবে যাচাই করা দরকার।
দলিল থাকলেই যে দলিলগুলো শুদ্ধ-সঠিক, তাও না। সব দলিলের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। আমরা যখন গ্রাম নিয়ে গবেষণা করি, অনেক সাবধানে কাজ করি। কারণ মানুষের পক্ষে মিথ্যা কথা বলা বা ভুলে যাওয়া এটা এত কমন। ফলে যাচাই করার পেছনে আমাদের তিন গুণ সময় যায় তথ্য সংগ্রহের চেয়ে। তখন তো আমাদের এটা করার সময় ছিল। এখন তো আর লোকও পাওয়া যাবে না। মানুষ মরে গেছে, স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছে এবং যারা কিছুটা দেখেছে—তারাও সত্যি কথা বলতে চায় না। অতএব, আমি মনে করি না বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের ইতিহাসের চর্চা সম্ভব হবে আর তথ্যের ভিত্তিতে। এখন যা হবে, তা অনুমান বা আন্দাজে হবে, বা মতামতের ভিত্তিতে হবে।
বাংলা ট্রিবিউন: স্বাধীনতার পর পর সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার কাজ শুরু করেছিল। সেটা থেমে যাওয়ার কী কারণ ছিল?
আফসান চৌধুরী: আমার মনে আছে বাহাত্তর সালেও এই তালিকার ভালো নাম-ডাক ছিল না। আমার পরিবারের অনেকেই কোনও না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত ছিল। আমার দুই খালাতো ভাই বীর প্রতীক, সম্মুখ সারির যোদ্ধা। আর আমার মা বললেন, ওরা সেনাবাহিনীর লোক, ওদের নাম তো থাকবেই। কিন্তু অন্যেরা তালিকায় নাম লেখাতে যাবে কেন? তখনই তালিকায় একটা ছাপ পড়ে গিয়েছিল। মানুষ রাজনৈতিক সুবিধার মাধ্যমে তালিকায় নাম লেখাচ্ছিল। এটা কিন্তু আমি বলবো—প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাও ছিল, যারা যোদ্ধাদের তালিকায় নাম লেখাচ্ছিল। আবার যে যোদ্ধা ছিল না সেও নাম লেখাচ্ছিল। ফলে সেসময় এটা সামাজিকভাবে গুরুত্ব হারাচ্ছিল। গ্রহণযোগ্যতার অভাব তখনও ছিল। ৭৫ সালের পর আবার নতুন করে তালিকা হওয়া শুরু হলো। যখনই সরকার পাল্টায় তখন আবার নতুন করে তালিকা তৈরি হয়। তো হতে হতে এখন কত হয়েছে, তা আমি জানি না। ট্রেনিংপ্রাপ্তদের যে হিসাব আর তালিকার যে হিসাব, তার মধ্যে ফারাক আছে। ইন্ডিয়ানদের তালিকার সঙ্গে আমাদের হিসাব মিলবে না। আমি মনে করি, তালিকার রাজনীতি একটা আলাদা একটা পরিসর।
বাংলা ট্রিবিউন: এত বছরেও কোনও সরকারই মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে পারলো না বা করলো না। আসলে এই না পারার রাজনীতিটা কী? আপনি কী মনে করেন?
আফসান চৌধুরী: তালিকা তো সুবিধা পাওয়ার জন্য হয়। মানুষ সুবিধা পাওয়ার জন্য যদি তালিকা করে, তাহলে কারা যাবে সেখানে সুবিধা পাওয়ার জন্য! আমি এক নারী মুক্তিযোদ্ধার কথা জানি। তিনি একজন সরাসরি সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা। তিনি তালিকায় নাম লেখানোর জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাকে বলা হয়েছে—তালিকায় নাম দিতে হলে একটু খাতির-টাতির করতে হবে। আমি নিজেই আরেকজনকে চিনতাম যে সরকারি চাকরি করতেন। এটা ৭৭ বা ৭৮ সালের কথা বলছি, বিএনপির আমলে। আমি বললাম, আপনার তো ১২ বছর বয়স ছিল, আপনি কী কাজ করেছিলেন ৭১ সালে? উনি বিব্রত হয়ে বলেন—আমি চিঠি-টিঠি নিয়ে যেতাম। তো এগুলো বলে লাভ নেই।
বাংলা ট্রিবিউন: চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের কবরস্থান দেখতে বিদেশিরা আজও আসেন। অথচ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর ও বধ্যভূমি রয়েছে। সেগুলো যথাযথ সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। সেগুলো প্রপারলি সংরক্ষণ করতে পারলে, নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে অন্যরকম গুরুত্ব পেতো। এ বিষয়টিতে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
আফসান চৌধুরী: আমরা তো একমতই নই যে ইতিহাসে কী হয়েছিল সে সময়। তো এ ধরনের বিভক্তি নিয়ে আমরা কীভাবে গণকবর বা এগুলোকে যত্ন করবো। আমাদের যে সামাজিক ইতিহাস ও রাষ্ট্রিক ইতিহাস—এ দুটোর যে দ্বন্দ্ব, এগুলো তো তারই ফল। আমরা তো একমতই না যে কী হয়েছিল। আমরা তো জানতেও চাই না। আমরা বলি ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ’। এটা আমি মনে করি আমাদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনেনি। কারণ, ‘মহান’ হতে গেলে তখন ওটা নিয়ে আর আলোচনা, সমালোচনা বা গবেষণা হয় না। মানে তখন সবই হতে হবে পজিটিভ। আমরা আগেই বলে দিচ্ছি—সবই পজিটিভ হতে পারে। তাহলে তো গ্রামে যে মানুষটা বা শহরের মধ্যে যে মানুষটা ছিল, যে হয়তো ভালো ছিল না। অথচ মুক্তিযোদ্ধা মানে সে ভালো লোক হয়ে গেলো, আমরা এটা কী বলতে পারি! এটাকে আমরা রাজনীতি করে, এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছি, বিভিন্ন দল করেছি। একদলকে দোষ দেওয়াটা একেবারে অন্যায়। সবাই করেছে। সেটাকে হয় পক্ষে হোক বা বিপক্ষে হোক, যে করেই হোক— বিষয়টিকে আমরা খুব বিতর্কের জায়গায় নিয়ে গিয়েছি। এখন একজনের কাছে শহীদ, অন্যজনের অন্য কিছু।
বাংলা ট্রিবিউন: অনেকে মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ, এই বিতর্কটি ঢালাওভাবে অতিমাত্রায় ব্যবহার করায় পুরো জাতি এখন বিভক্ত। এর কী কোনও সমাধান নেই, নাকি চলতেই থাকবে, আপনি কী মনে করেন?
আফসান চৌধুরী: জাতি দুভাগে না অনেক ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এই বিভক্ত কারা হয়েছে? এটা তারা হয়েছে যারা ৭১ সালের ইতিহাস চর্চা বা ৭১ সালটাকে নিয়ে রাজনৈতিক বা অন্য সুবিধা ভোগ করতে পারে, বা অসুবিধায় পড়েছে এই সময়ে, তারা এটাকে নিয়ে রাজনীতি করে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এসব নিয়ে আগ্রহ অত্যন্ত কম। আমরা একপেশে ইতিহাস চর্চা করি। তারপরে রাষ্ট্রীয় ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক, ঝগড়া। যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে একটা জিনিস হবে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে আরেকটা জিনিস হবে, অন্য কেউ যদি ক্ষমতায় আসে—তাহলে আরেকটা জিনিস হবে। পাবলিক কি এর কোনও প্রতিবাদ করছে, না। পাবলিকের কাছে ৭১ সাল, ডিসেম্বর মাস হোক বা মার্চ মাস হোক— একটা আনুষ্ঠানিকতার বিষয় হয়ে গেছে। তার অন্তরের যে ৭১, সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। আমি আজকেও বলছিলাম—মানুষের যে এই ধারণা হয়ে গেছে—একপাক্ষিক একটা ইতিহাস, এটা কিন্তু বড় ক্ষতি হয়েছে। ইতিহাস তো আর দেশপ্রেমের জায়গা না। ইতিহাস চর্চাও দেশপ্রেমের জায়গা নয়। দেশপ্রেম করতে গেলে হাজারটা জায়গা আছে, আর ইতিহাস চর্চার সবচেয়ে বড় দেশপ্রেম হচ্ছে সত্যি কথা বলা। কিন্তু আমরা কি ক্ষমতা রাখি সেটা বলার ও শোনার?
প্রত্যেকটা যুদ্ধে প্রত্যেকটা মানুষেরই এই জিনিসটা আছে। আমরা নিজেরাও তো দুটো দেখেছি। কিন্তু আমরা এমন একটা আবরণ তৈরি করে ফেলেছি যে ইতিহাসের বন্দিশালা থেকে নিজেরাই মুক্ত হতে পারছি না। তো আমরা ৭১-এর ইতিহাস বললে, আমরা কী বলবো। আমি একজনকে বলছিলাম, ‘রকমারি’তে নারীদের ওপর যে বই আছে তার প্রায় সব হলো ধর্ষণের বই, কী অদ্ভুত একটা দেশ, যেখানে একজন নারীর ধর্ষণের শিকার হওয়া ছাড়া আর কোনও পরিচয় নেই। আমি একেবারে নাম দিয়ে বলছি—হালিমা পারভীন, তার মতো এমন যোদ্ধা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পাওয়া যাবে না। এই হালিমা পারভীনকে পাকিস্তান আর্মি ধরে নিয়ে গিয়েছিল যুদ্ধের ময়দান থেকে। তারা জেলে নিয়ে গিয়ে তার ওপরে নির্যাতন করেছিল। সেই হালিমা পারভীনকে লোকে বলেছিল যে আপনার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দরকার নেই, ‘ধর্ষিতা’ পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তো দেখতেও চাই না, আমরা তো নারীর ভূমিকাকেও জানতে চাই না। যুদ্ধের সময় যদি নারী পরিবার ও সংসারগুলোকে টিকিয়ে না রাখতো, তাহলে কোন বাংলাদেশ থাকতো ?
বাংলা ট্রিবিউন: মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন প্রজন্মের আবেগ-উপলব্ধি-চিন্তা সম্পর্কে আপনি পর্যবেক্ষণ করেছেন কিনা, তাদের ভাবনায় মুক্তিযুদ্ধ কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে?
আফসান চৌধুরী: আমি যেটা দেখতে পাই, তাদের মধ্যে অনীহা। এর কারণ ৫০ বছর ধরে কিছুটা হলেই—এটা হচ্ছে ইতিহাস, আবার কিছু দিন পরে ওটা হচ্ছে ইতিহাস, তার কিছু দিন পর আবার এটা ইতিহাস না। এরকম করায় ওদের ইতিহাস চর্চায় বিষয়ে একটা বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়ে গেছে। একাত্তরকেও তারা বোঝা মনে করে। কারণ আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটা দুর্বল হয়ে গেছে। বাচ্চারা মনে করে— গ্রেট লিবারেশন ওয়ার, আমরা যেমন বলি ‘মহান’ মুক্তিযুদ্ধ। মহান তো বলার দরকার নেই, দলীয়করণ করার তো প্রয়োজন নেই আমাদের ইতিহাসকে। ইতিহাস তো ইতিহাসের মতোই থাকবে। ইতিহাসে যেটা ঘটেছে সেটাই ঘটেছে এবং সেটা খারাপ ভাবার কিছুই নেই। এটা ভালো ভাবার বা খারাপ ভাবার দরকার নেই। ইতিহাস তো ইতিহাস, আমরা তো ওই জিনিসটা করিনি বা করার হয়তো অবস্থা আমাদের নেই। করার হয়তো পরিসর নেই, হয়তো রাষ্ট্র খুব দুর্বল। বাংলাদেশের রাষ্ট্র কিন্তু দুর্বল। বাংলাদেশের সমাজ অনেক সবল। ৭১ সাল থেকে যদি দেখি, বর্তমান ২০২৪ সালে মধ্যে সাতবার অভ্যুত্থান হয়েছে এবং সশস্ত্র। তবে বাংলাদেশের সমাজ এখনও বহাল তবিয়তে অত্যন্ত সবলভাবে আছে। এ কারণে আমার মনে হয়—এই দুটো পরিসরের তুলনা করলে, বাংলাদেশ কিন্তু আছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। বাংলাদেশ আছে গ্রামে। আর গ্রামের ইতিহাস না জানার ফলে আমাদের যেটা হয়ে গেছে, আমরা খুব স্বল্প কিছু মানুষের নাটক টেলিভিশনে, সিনেমা থেকে আরম্ভ করে উপন্যাসগুলো পড়ি আর ভাবি—এটাই ছিল একাত্তর। ৭১-কে জানতে হলে তো ৭১-এ যেতে হবে।
বাংলা ট্রিবিউন: জয় বাংলা স্লোগান এখন তো বেশ আলোচিত বিষয়… এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
আফসান চৌধুরী: এটা হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা বা অসুবিধা যাই হোক— আমরা একাত্তর নিয়ে রাজনীতি করি এবং রাজনীতির বাইরে গিয়ে আর কিছু করি না। আমরা যদি রাজনীতির বাইরে গিয়ে কিছু করতাম, তাহলে এই সমস্যা আর থাকতো না। এবং আমাদের এই সমস্যার ফলে যে জিনিসটা হয়েছে, আমরা এটা থেকে উত্তরণ করতে পারছি না। আমরা ‘জয় বাংলা’কে সরকারের স্লোগান তৈরি করে ফেলেছি। এটা বানাবার কী দরকার ছিল। স্লোগান রাজনৈতিক কারণে বানিয়েছে। তার পরে এখন কী হলো, এটা আর জাতীয় স্লোগান নাই। কেন? সেই একই বিষয়, রাজনীতি। জয় বাংলা জাতীয় স্লোগান না। তাতে কী জয় বাংলা বলতে কারও অসুবিধা আছে। এটা তো মূল বিষয় না। এই যে জিনিসটা আমরা প্রাধান্য দিয়েছি, গুরুত্ব দিয়েছি, এর ফলে মূল বিষয়গুলো আমরা ভুলে যেতে বসেছি। আসল সমস্যা হচ্ছে ইতিহাস নিয়ে রাজনীতি চর্চা করা।
বাংলা ট্রিবিউন: একজন গবেষক হিসেবে বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাঠকদের বিশেষ কিছু বলতে চান?
আফসান চৌধুরী: না, পাঠকদের কিছুই বলতে চাই না। আমি বলবো যে ইতিহাস চর্চা একটা ক্রিটিক্যাল বিষয়। পরের প্রজন্ম যদি এটা চর্চা করতে চায়, আমার মতো যারাই আছেন বয়স্ক মানুষ, ৭১ সালে যারা ছিলেন, আমাদের তথ্যগুলো সংগ্রহ করা দরকার। যদি কিছু বাকি থাকে, আমাদের তথ্যগুলো সংগ্রহ করুক, পরের প্রজন্ম এসে করুক, মুক্ত মন নিয়ে। আমাদের পক্ষে মুক্ত মন নিয়ে গবেষণা করা মনে হয় না সম্ভব। আর লোকজন এত রাজনীতি করে যে ৭১-এর ইতিহাস চর্চার বিষয়টি রাজনৈতিক চর্চায় পরিণত হয়েছে, ইতিহাস চর্চা আর নেই।