এম মনসুর আলীর নাতি তানভীর শাকিল জয়ের সাক্ষাৎকার

‘খুনিদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন তারা’

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় জাতীয় চার নেতাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তারা হলেন— মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী, খাদ্য ও ত্রাণমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ও মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এই চার বীরের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার দিনটি ‘জেলহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়।

জেলহত্যার অন্যতম শিকার এম মনসুর আলীর ছেলে প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিম আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক সংসদ সদস্য এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের ১৩ জুন মারা যান তিনি। আসনটি শূন্য হলে মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয় নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জেলহত্যা দিবস নিয়ে তিনি কথা বলেছেন বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে।

বাংলা ট্রিবিউন: ৩ নভেম্বর জাতির জন্য নিশ্চয় এক অপূরণীয় ক্ষতি। এই দিনে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল আপনার দাদার (এম মনসুর আলী) মতো চার বীর সন্তানের প্রাণ। ঘটনার দিন আপনার দাদার সঙ্গে সবশেষ আপনার পরিবারের কখন এবং কী কথা হয়েছিল?

তানভীর শাকিল জয়: ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর আমার বয়স ছিল মাত্র এক বছর। বাবা-চাচা ও পরিবারের কাছ থেকে যতটুকু শুনেছি, বঙ্গবন্ধুকে ১৫ আগস্ট সপরিবার হত্যার পরেই আমার দাদাসহ জাতীয় চার নেতা কিছুটা আত্মগোপনে চলে যান। কেননা, ওনাদের পেলে হত্যা করা হতে পারে, এমন আশঙ্কা করছিলেন তারা। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগকে আবার পুনর্গঠিত করার চেষ্টা করছিলেন, খুনিদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন তারা। এর কিছুদিনের মধ্যেই আমার দাদাসহ জাতীয় চার নেতাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

একপর্যায়ে খন্দকার মোশতাক তার বেইমানের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য আহ্বান জানান। আমার দাদাকে প্রধানমন্ত্রিত্বের অফার দেন, তিনি সেটি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি মোশতাককে দৃঢ়তার সঙ্গে সেদিন বলেছিলেন, ‘তোমার মতো বেইমানের সঙ্গে মন্ত্রী হওয়ার চেয়ে মৃত্যুই আমার কাছে শ্রেয়।’ আমি যতটুকু জেনেছি, পরবর্তী সময়ে ৩ নভেম্বরের বেশ কয়েক দিন আগে আমার দাদিসহ চাচা দাদার সঙ্গে দেখা করতে যান জেলখানায়। সেই সময় তাদের কাছে দাদা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের হয়তো যেকোনও সময় হত্যা করা হতে পারে। তোমরা মানসিক প্রস্তুতি রেখো।’ তিনি চাচাদের আরও বলেছিলেন, ‘তোমাদের মাকে দেখে রাখবা।’ আমার একমাত্র ফুফুসহ পরিবারের সবাইকে দেখে রাখার জন্যও বলেছেন তিনি। কারাবন্দি দাদার সঙ্গে সবশেষ সাক্ষাতে এভাবেই তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা এবং পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব-কর্তব্য নিয়ে কথা হয়েছিল পরিবারের। তারপর আর কোনও কথা হয়নি।

দাদা এম মনসুর আলীর কোলে তানভীর শাকিল জয়

বাংলা ট্রিবিউন: কখন ও কীভাবে এই ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের খবর পরিবারের কাছে পৌঁছায়?

তানভীর শাকিল: ৩ নভেম্বরের আগে দাদার সরকারি বাসভবন ছেড়ে আমাদের চলে যেতে হয়েছিল। থাকার তেমন কোনও জায়গাও ছিল না। যোগাযোগব্যবস্থা, টেলিফোন সংযোগও তত ভালো ছিল না। আত্মীয়স্বজনের বাসায় দাদি-চাচাদের এক দিন-দুই দিন করে থাকতে হতো। ফলে ৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে তারা খবরটি জানতে পারেননি। পরে আমাদের এক আত্মীয়কে, তিনি সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন, সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন; তাকে জেল কর্তৃপক্ষ ফোন করে এই সংবাদটি দেয় যে তারা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের ডেড বডি নিয়ে যাও। হত্যা করা হয়েছে, সেটি বলা হয়নি। তার কাছ থেকে আমার দাদিসহ চাচারা জানতে পারেন এবং তারা ওই আত্মীয়সহ আরও কয়েকজন কারাগারে গিয়ে দাদার মৃতদেহটি গ্রহণ করেন। পরে অন্য তিন নেতার সঙ্গে বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনাদের পরিবারের পক্ষ থেকে তখন কোনও মামলা করার চেষ্টা বা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কি?

তানভীর শাকিল: ওই সময়ের মানসিক অবস্থা কেমন ছিল, তা তো বুঝতেই পারছেন। তখন সারা দেশে ভয়ের রাজত্ব বিরাজ করছিল। সামরিক কর্তৃপক্ষ লাশ দ্রুত দাফনের জন্য প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করছিল। আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, দাদাকে বনানীতে দাফন করার পর ধানমন্ডি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। পরে ওই ডায়েরির কোনও অস্তিস্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। সামরিক কর্তৃপক্ষের চাপে থানা কর্তৃপক্ষ হয়তো সেটিকে ওই সময় নষ্ট করে ফেলেছিল। তখন কোর্টে মামলা করার মতো কোনও অবস্থা ছিল না। পুরো পরিবারকে হুমকির মুখে রাখা হয়েছিল, আমার বাবার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়েছিল। সেই সময় আমরা কোথাও বিচার চাইতে পারিনি। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশও জারি করা হয় পরে।

বাংলা ট্রিবিউন: তখন পরিবারের সঙ্গে রাষ্ট্রের আচরণ বা ব্যবহার কেমন ছিল?

তানভীর শাকিল: সামরিক কর্তৃপক্ষ ও তাদের গোয়েন্দারা একেবারেই অমানবিক আচরণ করেছে আমাদের পরিবারের সঙ্গে। তারা চার জাতীয় বীরকে হত্যা করলো, আমার বাবা রাজনীতিতে জড়িত থাকায় তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হলো। আমার দাদি, তিন চাচা ও এক ফুফু ছিল, তাদের ওপরও অনেক রকম অত্যাচার-নির্যাতন করা হতো। এমনকি কোনও আত্মীয়র বাসায় আছেন জানলে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন গিয়ে হুমকি দিতো ও বলতো, এদের রাখা যাবে না, সরিয়ে দিতে হবে। এই ধরনের ঘটনা বছরের পর বছর ঘটিয়েছে তারা। আমার দাদা কোনও সম্পদই রেখে যেতে পারেননি। ধানমন্ডিতে একটা সরকারি জায়গা ছিল। চাচা যে চাকরি করবে কোথাও, ভয়ে কেউ চাকরিও দিতো না। হুলিয়া থাকায় বাবাকে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে হলো। তাকেও ধরে নিয়ে মেরে ফেলার আশঙ্কা করা হচ্ছিল। এমন একটি দুঃসহ, অকল্পনীয় ও অমানবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন পার করেছে আমাদের পরিবার।

বাংলা ট্রিবিউন: হত্যাকাণ্ডটি আপনার ও আপনাদের পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের বেড়ে ওঠা বা বিকাশের ওপর কেমন প্রভাব ফেলেছিল?

তানভীর শাকিল: এত অল্প বয়সে দাদাকে হারিয়ে আমার শৈশব-কৈশোর তো একেবারে নষ্টই হয়ে গেছে। ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করে প্রথমে আমার বাবা সে দেশে চলে গেলেন, পরে আমার আম্মা ও আমাকে নিয়ে গেলেন। তিনি অনেক কষ্টে আমাকে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাবার কাছে যান। ওখানে আষু বাবু নামের এক ব্যক্তির গোয়ালের পাশে একটা রুমে আমাদের থাকতে হয়েছে। সেখানে বাবার কোনও চাকরি করার সুযোগ ছিল না। ফলে রিফিউজির মতো চরম অর্থনৈতিক কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এর মধ্যেই ওখানে একটি স্কুলে পড়াশোনা করতাম। ১৯৭৯ সালে যখন আব্বা দেশে চলে আসেন, তখন তাকে গ্রেফতার করা হয়। আরেকটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যাই আমরা। ঢাকায় কোথায় থাকবো, কী করবো? এভাবে ৮ থেকে ১০ বছর গেলো। খুব অনিশ্চিত অবস্থার মধ্য দিয়ে আমি বেড়ে উঠেছি। শেখ রাসেল যে স্কুলে পড়তো, সেখানে আমিও পড়াশোনা করতাম। স্কুলে বঙ্গবন্ধুর নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করা যেতো না। এভাবে আমার হাই স্কুল পর্যন্ত চলেছে। সেই দুঃসহ স্মৃতিগুলো এখনও মনে পড়ে, আমাকে আন্দোলিত করে এবং অনেকভাবে প্রভাবিত করে।

বঙ্গবন্ধুর কোলে তানভীর শাকিল জয়
বাংলা ট্রিবিউন: প্রতিবছর জেলহত্যা দিবস পালনের সময় আপনার ও পরিবারের সদস্যদের অনুভূতিগুলো কেমন হয় কিংবা অতীতের সেই স্মৃতিগুলো কীভাবে সামনে আসে?

তানভীর শাকিল: আমার দাদাসহ জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হলো। কিন্তু এর বিচারটি পর্যন্ত আমরা চাইতে পারলাম না। এর থেকে বেদনার, যন্ত্রণায় আর কিছু হতে পারে না। হাই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করলাম, তখন (১৯৯৬) বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ২১ বছর পর রাষ্ট্রক্ষমতায় এলেন। ওই সময় আমরা সত্যিকার অর্থে কিছুটা নিঃশ্বাস নিতে পারলাম। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল হলো, আমাদের মনে আশার সঞ্চার হলো, এবার বিচার হবে, শেখ হাসিনা এই বিচার শুরু করবেন। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসে, ২০০৪ সালে নিম্ন আদালতে জেলহত্যা মামলার রায়ে কে এম ওবায়দুর রহমান, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ বিএনপির যারা জড়িত, তাদের সবাইকে খালাস দেওয়া হয়।

ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় ২০০৮ সালে হাইকোর্টে যে রায় দেওয়া হয়, সেখানে দুঃখজনকভাবে কর্নেল ফারুক, রশিদসহ সরাসরি খুনিদেরও অব্যাহতি দেওয়া হয়। এভাবে দিনের পর দিন চলে যায়, খুনিরা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায়, বিদেশে চলে যায়, ভালো চাকরি করে আর আমরা বিচারালয়ে বিচার পাচ্ছি না। গত ১৩ বছরে সর্বোচ্চ আদালতে সেটির একটি সুষ্ঠু বিচার হয়েছে। কিন্তু জেল হত্যা মামলার ১০ জন আসামি এখনও বিদেশে পলাতক আছে, যারা স্বীকৃত খুনি। ৩ নভেম্বর এলেই সবচেয়ে বেদনা দেয় এই বিষয়গুলো। এই খুনিদের ফেরত দেওয়ার জন্য সব সময় বাইরের রাষ্ট্রগুলোর কাছে আপিল করি। তবে আমাদের সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

একটি বিষয় হলো, জাতীয় চার নেতার ইতিহাস, তাদের অবদান, বঙ্গবন্ধুর সহচর থাকা, মুজিবনগর সরকার— এই বিষয়গুলো যেন আরও বেশি প্রচারিত হয়, সেই আবেদন রাখছি। গত সংসদ অধিবেশনে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি করেছিলাম, একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের পেছনের কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচন করা দরকার। এটি তো দেশি-বিদেশে ষড়যন্ত্র…।

তিনি বলেন, আইনমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, এই ডিসেম্বরের মধ্যেই কমিশনটি গঠন করা হবে। সেই সঙ্গে পলাতক খুনিদের দেশে এনে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর দাবি জানাচ্ছি।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনাকে ধন্যবাদ।

তানভীর শাকিল: আপনাকে ও বাংলা ট্রিবিউনকে ধন্যবাদ।