একান্ত সাক্ষাৎকারে সাবেক ডেনিশ প্রধানমন্ত্রী পল নায়রুপ

বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে ডেনমার্কের

বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে ডেনিশ সরকার এবং সেখানকার ব্যবসায়ীদের। বাংলাদেশ একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং এই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। এ দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য ডেনিশরা শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা করতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী পল নায়রুপ রাসমুসেন। বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ঢাকা-কোপেনহেগেন সম্পর্ক, জলবায়ু পরিবর্তন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও অসহিষ্ণু সমাজের বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন’র দশম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগ দিতে বাংলাদেশে এসেছেন পল নায়রুপ রাসমুসেন। ১৯৯৭ সালের শুরু থেকে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বর্তমানে ৭৯ বছর বয়সী এই রাজনীতিক দেশটির অন্যতম রাজনৈতিক দল ‘পার্টি অব ইউরোপিয়ান সোশালিস্ট’-এর সভাপতিও ছিলেন।

ইউরোপের উত্তর-পশ্চিমের দেশটির সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সামনের দিনগুলোতে ডেনিশ সরকার এবং ব্যবসায়ীরা আরও বেশি করে বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী হবে। এটি শেষ নয়, বরং শুরু। ডেনমার্কের বড় কোম্পানি; যেমন জাহাজ পরিবহন সংস্থা মায়ের্কস, আরলা, নোভো নরডিস্ক বাংলাদেশে ব্যবসা করছে এবং এর মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। ডেনিশ শিক্ষকরাও প্রযুক্তি ও প্রকৌশল জ্ঞানে দক্ষ এবং তারা বাংলাদেশে এসে এখানকার শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে পারে। এর ফলে এখানে বিভিন্ন পণ্যের উদ্ভাবন আরও বৃদ্ধি পাবে।’

পল নায়রুপ রাসমুসেন (ছবি: নাসিরুল ইসলাম)

ডেনমার্কসহ উত্তর ইউরোপের দেশগুলোতে এখন একটি নতুন চিন্তা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার প্রযুক্তি ও শিক্ষায় বেশি সহযোগিতা করলে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন বেশি হয়। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, শিক্ষায় বিশেষ করে নারী শিক্ষায় অবদান রাখলে বাংলাদেশে বেশি করে উদ্ভাবন হবে। যেহেতু এই উদ্ভাবন বাংলাদেশিরা নিজেরাই করবে, ফলে ওই সব জিনিস বিদেশ থেকে কিনতে হবে না।’

বাংলাদেশকে ‘সুপেয় পানির’ স্বর্গ হিসেবে অভিহিত করে ডেনিশ রাজনীতিবিদ বলেন, ‘এখানে প্রচুর পরিমাণে সুপেয় পানি উৎপাদন করা সম্ভব। নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে বর্ষা মৌসুমের পানি ধরে রেখে সেটিকে সুপেয় পানিতে রূপান্তর করা সম্ভব এবং ওই পানি রফতানিও করা যেতে পারে। আমরা বর্ষা মৌসুমের পানি ধরে রাখার জন্য নতুন প্রযুক্তি তৈরিতে বিনিয়োগ করতে পারি।’

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ

স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রাষ্ট্রটির সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী কথা বলেন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গেও। তিনি বলেন, ‘বর্তমান বিশ্ব একটি ঝড়ের মতো পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পুরনো যে বৈশ্বিক ব্যবস্থা সেটি ভেঙে পড়ছে এবং বড় শক্তিগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের মাঝে একটি নতুন ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের বোঝা জরুরি যে বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি ঝড়ো পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা যায় এবং এটির প্রভাব শুধু ইউরোপে নয়, এখানেও (বাংলাদেশ) অনুভূত হচ্ছে। ইউরোপে সংঘাতময় পরিস্থিতি এবং একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন, মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, আয় বৈষম্যের কারণে সাধারণ মানুষ হতাশ হয়ে পড়ছে এবং এরফলে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হবে এ ধরনের একটি মানসিক চাপের মধ্যে আছেন তারা।’

পল নায়রুপ রাসমুসেন (ছবি: নাসিরুল ইসলাম)

তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের কারণে সবসময় এবং প্রতিটি জায়গায় পরিবর্তন আসছে।’

যুদ্ধের বিষয়ে তিনি বলেন, ইউক্রেন সংঘাত একটি অন্যায্য যুদ্ধ এবং এ মুহূর্তে যদি ওই দেশের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করা না হয়, তবে আমাদের সবার প্রতি যে দায়িত্ব রয়েছে সেটি আমরা পালন করবো না। হাল ছেড়ে দেওয়া বা নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়া বা ভ্লাদিমির পুতিনকে এমন ধারণা দেওয়া যে তারা ইউক্রেন দখল করতে পারবে, এটি হলে গোটা পশ্চিম ইউরোপের যেকোনও দেশ আক্রান্ত হতে পারে এবং তারা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। ন্যাটোর মাধ্যমে সমর্থন অব্যাহত রাখা ছাড়া আমাদের আর কোনও সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না।

সামাজিক অসহিষ্ণুতা

সারা বিশ্বেই সামাজিক অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, প্রসঙ্গটি নিয়েও কথা বলেন পল নায়রুপ রাসমুসেন। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সমাজে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে এবং এর অন্যতম কারণ হচ্ছে বৈষম্য। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অবাধ ব্যবহারের কারণে ঘৃণা ও মিথ্যা বক্তব্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে।’

পল নায়রুপ রাসমুসেনের সঙ্গে কথা বলছেন প্রতিবেদক (ছবি: নাসিরুল ইসলাম)

তিনি বলেন, ‘এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে আমরা কখনোই ছিলাম না। দেশের অভ্যন্তরে এবং এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের বৈষম্য বাড়ছে এবং এখন আমরা দেখছি জাতীয়তাবাদের প্রসার।‘

অসহিষ্ণুতার আরেকটি কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটিকে নিয়ন্ত্রণ করার রেগুলেশন দরকার। সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহার করে ভীতি ও ঘৃণা বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে এবং এটি প্রতিরোধের জন্য নিয়ন্ত্রণ দরকার।’