বাংলা ট্রিবিউনকে আবুল হাসানাত আমিনী

ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো তৃতীয় শক্তি গড়ে তুলছে

আবুল হাসানাত আমিনীবাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলে মনে করেন ইসলামী ঐক্যজোটের ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনী। তিনি জানান, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো তৃতীয় শক্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। আবুল হাসনাত আমিনী একই সঙ্গে আরেকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল খেলাফত ইসলামী বাংলাদেশের আমির। এছাড়া, ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির মহাসচিবের দায়িত্বও পালন করছেন। বর্তমান সময়ের ধর্মভিত্তিক রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে। 

বাংলা ট্রিবিউন: ২০ দলীয় জোট ছেড়ে এসেছেন, ভুল করেছেন বলে মনে হচ্ছে এখন?  

আবুল হাসানাত আমিনী: প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলেরই জোটে যোগ দেওয়ার পেছনে নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য থাকে। জোটবদ্ধ আন্দোলন, নির্বাচন, নির্বাচনে বিজয়ী হলে সরকার গঠন—ইত্যাদি।  ১৯৯৯ সালে চারদলে যোগ দেওয়ার সময় এগুলোকে সামনে রেখেই জোটে গিয়েছিল ইসলামী ঐক্যজোট। এরপর আমরা জোটবদ্ধ হয়ে তৎকালীন সরকার বিরোধী আন্দোলন করেছি, ২০০১ সালে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করেছি, বিজয়ী হয়েছি। ২০০৮ সালেও আমরা জোটবদ্ধ নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। ২০১৪ সালের বির্তকিত নির্বাচনে তো ২০দল অংশই নেয়নি। এরপর জোটের আন্দোলনে ধারাবাহিক ব্যর্থতা, দেশজুড়ে আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা-মামলায় আমরা একটা বৃত্তের ছকে আটকে গিয়েছিলাম। ফলে ২০ জোটেও আমরা তেমন ভূমিকা রাখতে পারছিলাম না। এছাড়া, সারাদেশে দল গোছানোর জন্যও আমাদের একটা অবস্থানে যাওয়া দরকার ছিল। এসব কারণেই মূলত জোট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইসলামী ঐক্যজোটের মজলিসে শুরা। সুতরাং আমরা মনে করি, ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে সঠিক সময়ে আমরা সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছি। দেশের শীর্ষ আলেমরা আমাদের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। ভুল করেছি বলে মনে হচ্ছে না।

 

বাংলা ট্রিবিউন: ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবির মধ্যে বাংলাদেশে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী?

আবুল হাসানাত আমিনী: প্রথমত ধর্মভিত্তিক রাজনীতি মানে আর্দশিক রাজনীতি। যাদের কোনও ধর্ম নেই, তারাই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তোলেন। দ্বিতীয়ত,  বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। এর পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে, স্বাধীনতার পর যতগুলো সরকার এদেশে ক্ষমতায় এসেছে, তারা জনগণের তুলনায় নিজ দল ও কর্মীদের প্রাধান্য দিয়েছে। জনগণের সম্পদ লুটেপুটে খেয়ে এসব দলের নেতারা সমাজে আজ প্রতিষ্ঠিত বড় ব্যবসায়ী, বিশিষ্ট দানবীর পরিচয় বহন করছেন। কিন্তু জনগণ কী পেল? তারা কি শান্তিতে ঘুমাতে পারছে, নিরাপদে চলাফেরা করতে পারছে? তাদের মৌলিক অধিকার ফিরে পেয়েছে? জনগণ এসব দলবাজদের ওপর চরমভাবে ক্ষিপ্ত, বিরক্ত। তারা চায় এদেশে দু’দলের বাইরে তৃতীয় কোন শক্তি ক্ষমতায় আসুক। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো সেই শক্তি গড়ার চেষ্টা করছে। জনগণও তাদের সাপোর্ট করছে।

বাংলা ট্রিবিউন:  ধর্মীয় দলগুলো ধর্মীয় ইস্যুতে যতটা সোচ্চার,  ততটা দেশের বিভিন্ন ইস্যুতে সোচ্চার নয় কেন? দেশের প্রতি ধর্মীয় নেতাদের কোনও দায়বদ্ধতা নেই ? 

আবুল হাসানাত আমিনী: যখন কোনও নাস্তিক-মুরতাদ বা ইসলামবিরোধী শক্তি পবিত্র ধর্ম ইসলাম, নবী করীম (স.), সাহাবায়ে কেরাম, ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কটূক্তি করেন, রাষ্ট্রে ইসলামবিরোধী আইন প্রণয়নের পাঁয়তারা করেন, তখন একজন ওয়ারেসে নবী হিসেবে প্রতিটি ইসলামি দলের নেতাকর্মী, আলেম এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলাকে নামাজ-রোজার মতোই ফরজ মনে করেন। দেশের অন্যান্য ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনে ইসলামি দলগুলো সম্পৃক্ত রয়েছে। হয়তো মিডিয়ায় এর প্রচারটা সেভাবে হচ্ছে না। তবে, এ ব্যাপারে ইসলামি দলগুলোর আরও সচেতন হওয়া দরকার।  

 বাংলা ট্রিবিউন: সমাবেশ আর ওয়াজ মাহফিলের সঙ্গে কোনও পার্থক্য খুজে পাওয়া যায় না কেন?

আবুল হাসানাত আমিনী: সমাবেশ আর ওয়াজ মাহফিলের শব্দগত ও   উদ্দেশ্য-লক্ষ্যে তেমন পার্থক্য নেই। তবে স্থানকালপাত্র ভেদে কিছুটা পার্থক্য তো রয়েছেই। ধর্মীয় দলের সমাবেশের মূল উদ্দেশ্য থাকে দাবি আদায়, ইস্যু সম্পর্কে সরকার ও জনগণকে সচেতন করা, নাস্তিক্যবাদ-সাম্রাজ্যবাদ ও দেশবিরোধী শক্তিকে রুখে দাঁড়াতে উপস্থিত শ্রোতা ও দেশবাসীর প্রতি থাকে জোর আহ্বান জানানো। অন্যদিকে, ওয়াজ মাহফিলের উদ্দেশ্য থাকে মুসলমানদের হেদায়েতের দাওয়াত, ইহকাল-পরকাল, জান্নাত-জাহান্নামসহ ধর্মীয় বিষয়ে শ্রোতাদের জ্ঞান দেওয়া। একইসঙ্গে ইসলাম না মানার কুফল সম্পর্কিত বিষয়গুলো জানানো। এ কারণেই উভয় মজলিসেই প্রচুর লোক সমাগম হয়, তাই অনেকে ওয়াজ মাহফিলকেও সমাবেশ মনে করেন। এতে দোষের কিছু নেই।

 বাংলা ট্রিবিউন:  ধর্মভিত্তিক দলগুলো নতুন নেতৃত্বে সংকটে ভুগছে বলে মনে করেন কি?

 আবুল হাসানাত আমিনী: বিগত কয়েক বছরে আল্লামা মুফতী ফজলুল হক আমিনীসহ বেশ কয়েকজন নেতার মৃত্যুর পর একটা শূন্যতা তো অবশ্যই তৈরি হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, এ সংকট সাময়িক। অতীতেও এমন সংকট ছিল। পরবর্তী সময়ে সেই গ্যাপ পূরণ হয়েছে।

 বাংলা ট্রিবিউন: এক সময় হাফেজ্জী  ‍হুজুর, শায়খুল হাদিস, মুফতী আমিনী  আন্দোলন করলে প্রভাব থাকত, যা এখন নেই। বর্তমানে কি  জনসমর্থন কমছে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর?

 

আবুল হাসানাত আমিনী: দেখুন, বর্তমানে দেশ কঠিন সময় অবস্থা পার করছে। কোনও রাজনৈতিকদল সেভাবে মাঠে নামতে পারছে না। অন্যদিকে, ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারাদেশের লাখ-লাখ আলেমের মাথার ওপর ঝুলছে মিথ্যা মামলার ঝুলি, গ্রেফতারি পরোয়ানা। এই অবস্থায়ও কিন্তু আমরা প্রতিবাদ করে যাচ্ছি, করে যাব। আর ইসলামি দলগুলো শক্তি হারায়নি। তবে সময়ের ব্যবধানে বলতে পারেন, আন্দোলনে কৌশল পরিবর্তন করছেন তারা। শীর্ষ ইসলামি নেতৃবৃন্দ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। সময় হলে আবারও আন্দোলনের ডাক দেবেন। আমরা বিশ্বাস করি, খুতবা নিয়ন্ত্রণ, মসজিদে নজরদারি এদেশের আলেম, ইমাম-খতিবরা কোনওভাবেই মেনে নেবেন না। সরকারও এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেবে না। 

 বাংলা ট্রিবিউন: মানুষের ধর্ম পালনের জন্য সংবিধানে  রাষ্ট্রধর্ম থাকা কি জরুরি?

আবুল হাসানাত আমিনী: নাস্তিক্যবাদী অশুভচক্র সংবিধান থেকে ইসলামের নাম-নিশানা মুছে দিতে  পাঁয়তারা করছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকলে অন্য ধর্মের মানুষও তাদের ধর্ম পালন করতে পারবেন নিবিঘ্নে। একমাত্র ইসলামই অন্য ধর্মের অধিকার নিশ্চিত করেছে। কোনও অবস্থাতেই সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন হতে দেওয়া যাবে না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেওয়া হবে না।

 বাংলা ট্রিবিউন: মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি দেশের ইতিহাসসহ দেশ সম্পর্কিত বিষয়গুলো ছাত্রদের জানা উচিত বলে মনে করেন কি? 

আবুল হাসানাত আমিনী: এ দেশের বেফাকভুক্ত কওমি মাদরাসাগুলোয় ধর্মীয়শিক্ষা অর্থাৎ কোরআন, হাদিস, ফেকাহ, যুক্তিবিদ্যা, অলঙ্কার শাস্ত্রের পাশাপাশি  বেফাক প্রণীত বাংলা, অংক, ইংরেজি, ইতিহাস, ভূগোল পড়ানো হচ্ছে। এসব বইয়ে দেশের স্বাধীনতা পূর্ববতী ও পরবর্তী ইতিহাস, ঐতিহ্য, গল্প-কবিতা সন্নিবেশিত রয়েছে। তবে দেশে এর বাইরে আরও অনেক আঞ্চলিক বোর্ড রয়েছে, সেসব বোর্ডের অধীনেও অসংখ্য কওমি মাদ্রাসা পরিচালিত হচ্ছে। তাদের সিলেবাসের ব্যাপারে আমাদের ধারণা নেহাত কম। তবে আমরা মনে করি, প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করা যেমন দরকার, ঠিক তেমনি প্রত্যেক নাগরিকেরও নিজ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে জানা উচিত।

/এমএনএইচ/