বাংলা ট্রিবিউনকে আমির খসরু মাহমুদ

‘দুই নেতা ছিলেন উষ্ণ, বৈঠক ভবিষ্যৎ রাজনীতি গড়ে তোলার মাইলফলক’

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একান্ত বৈঠকের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ‘সহনশীল রাজনীতির যাত্রা শুরু হয়েছে’ বলে মনে করছেন লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। শুক্রবার (১৩ জুন) বাংলাদেশ সময় সাড়ে ৭টার দিকে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে একান্ত আলাপে বিএনপির অন্যতম এই নীতিনির্ধারক বলেন, ‘আজ সকালে (স্থানীয় সময়) লন্ডনে অনুষ্ঠিত প্রায় দেড় ঘণ্টার বৈঠকে বাংলাদেশের দুই নেতা ছিলেন উষ্ণ, আন্তরিক। তাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ দেখেছি। আমরা ভবিষ্যৎ রাজনীতি গড়ে তোলার নিদর্শন দেখলাম।’

বৈঠক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আমির খসরু বলেন, ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নির্মাণের জন্য আজকের দুই নেতার বৈঠকটি খুবই ভালো, খুবই পজিটিভ। দুই নেতার এই বৈঠক বাংলাদেশের আগামী দিনের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ; বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড; দেশের রাজনীতি; জাতি নির্মাণ, দেশ নির্মাণের জন্য এবং নতুন স্বপ্নের বাংলাদেশের জন্য এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।’

‘ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের এই বৈঠক দেশের রাজনৈতিক কালচারের মধ্যে এই যে দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়া; এক জায়গায় আসা; দেশের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়া—এটা তো আমাদের রাজনীতিতে আসতে হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া—এটি দেশের রাজনীতির কালচারের মধ্যে আসতে হবে’, উল্লেখ করেন আমির খসরু। তিনি বলেন, ‘সহনশীলতা, পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধের সংস্কৃতি আমাদের রাজনীতিতে আসতে হবে।’

সরকার প্রধান ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠক কতক্ষণ স্থায়ী ছিল, এমন প্রশ্নের জবাবে আমির খসরু বলেন, ‘সোয়া ঘণ্টার উপরে, প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো হবে।’

সম্প্রতি বিএনপি যেসব বিষয়ে আলোচনা করছে, বন্দর বা করিডর—এসব প্রসঙ্গ বৈঠকে আলোচনায় এসেছে? এমন প্রশ্নের জবাবে আমির খসরু বলেন, ‘এটা তো ওয়ান টু ওয়ান বৈঠক হয়েছে। আমাদের সঙ্গে বৈঠকের প্রথম পর্বে ছিল, যেটাতে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকের পরের অংশটুকু ছিল ওয়ান-টু ওয়ান। সেখানে কী আলোচনা হয়েছে, সেটা আমি বলতে পারবো না।’

‘প্রথম পর্বে, মেইনলি ইলেকশন নিয়ে কথা হয়েছে। ডেট (নির্বাচনের তারিখ) নিয়ে আলোচনা হয়েছে’, জানান সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু। 

বৈঠকের পর দুই নেতাকে কেমন দেখলেন? এমন প্রশ্নে আমির খসরু জানালেন, ‘খুবই খুবই খুবই উষ্ণ, তাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য আমরা জাতীয় ঐক্যের একটা ভালো নিদর্শন দেখলাম আজ।’

বৈঠকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অবস্থান, আগামী নির্বাচনে দলটির কী ভূমিকা থাকতে পারে— এমন প্রশ্নে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এখানে (বৈঠক) আলোচনায় আসেনি।’

বিচার প্রসঙ্গ এসেছে কিনা জানতে চাইলে উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিচার তো, ওগুলো তো বলাই আছে। বিচার, সংস্কার, এগুলো তো চলমান প্রক্রিয়া।’

তারেক রহমান দেশে কবে ফিরবেন, এর জবাবে আমির খসরুর উত্তর, ‘সেটা বলতে পারবো না। আমারটা বলতে পারবো। উনার সিদ্ধান্ত তো উনি নেবেন। আমি দুই-তিনদিন পর ফিরবো।’

ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক সম্পর্কে আমির খসরু উল্লেখ করেন, ‘এই বৈঠক একটি বড় পদক্ষেপ; মাইলস্টোন, মাইলফলক।’

‘প্রধান উপদেষ্টা ইম্প্রেসড’

শুক্রবার সকালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা উল্লেখ করেন, ওয়ান টু ওয়ান বৈঠকে আরও নানা কিছু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। 

‘ড. ইউনূস তারেক রহমানের প্রতি খুব ইমপ্রেসড’ বলে বৈঠকের পর জানান স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য। এই বৈঠকের পর স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হবে। তবে, এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত জানা যায়, আজ কোনও বৈঠক হচ্ছে না। সামনের সপ্তাহের শুরুতেই এই বৈঠকের ফলোআপ মিটিং ডাকতে পারেন তারেক রহমান। 

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে একাধিক সদস্যসহ মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্যের লন্ডন যাওয়ার কথা শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত আমির খসরুকে আমন্ত্রণ জানান তারেক রহমান।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টার দফতর থেকে বিএনপির একাধিক সদস্যকেও লন্ডনে যেতে ‘আনঅফিসিয়ালি ইনসিস্ট’ করা হয়।

‘আলোচনায় বন্দর বা করিডর ইস্যু ছিল কিনা’

স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বৈঠকে আগে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছিলেন, তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। রুলস অনুযায়ী বৈঠকের খুব বেশি তথ্য বাইরে প্রকাশের সুযোগ নেই, বলে জানান কোনও কোনও সদস্য। 

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক শেষে গণমাধ্যমে পাঠানো এক যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়, বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে তারেক রহমানের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে।

যৌথ বিবৃতিতে কেবল নির্বাচনের বিষয়টিই এসেছে, অন্য বিষয়গুলো ছিল কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সেটা বলতে পারবো না।’

এদিকে বৈঠকের পর এক বিবৃতিতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারপ্রধানকে ‘আন্তরিক ধন্যবাদ’ জানান। এটি ‘স্বস্তির বার্তা ও নতুন আশার আলো’ বলে অভিহিত করেন এই নেতা। 

‘বিরল বৈঠক’

বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, রাজনীতির ইতিহাসে সরকারের প্রধানের সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতার এ ধরনের বৈঠক বিরল। আগামী প্রজন্মের জন্য এই বৈঠকটি অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। তার ভাষ্য, ‘এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে দেশের সামগ্রিক রাজনীতির পরীক্ষা আরও বেড়েছে।’

শায়রুল কবির খান বলেন, ‘গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা এবং আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণে শীর্ষ দুই নেতার আন্তরিক প্রচেষ্টা সফল হবে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়ার সময়ে এ ধরনের বৈঠক হয়নি। তবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদের মধ্যস্থতায় শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে বৈঠক হয়েছিল বলে জানা যায়। 

অবশ্য সরকারপ্রধান থাকাকালে শেখ হাসিনা ফোন করে সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন খালেদা জিয়াকে। যদিও তিনি তা কর্মসূচিগত কারণ দেখিয়ে বর্জন করেন। 

সর্বশেষ ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। ওই নির্বাচনটি ‘রাতের ভোট’ বলে অভিযোগ করে প্রত্যাখ্যান করেছিল তৎকালীন বিরোধী দলগুলো। ওই নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ধানের শীষ মার্কা নিয়ে নির্বাচন করে। 

বিএনপির দায়িত্বশীলরা মনে করছেন, তারেক রহমানের সঙ্গে সরকারপ্রধানের এই বৈঠকের পর বিএনপির ওপর দায়িত্ব ও চাপ বেড়েছে। বিশেষ করে সহনশীলতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা; জামায়াতের রাজনৈতিক কৌশল ও নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অবস্থান কী হবে, এ নিয়ে অনেকটাই পরীক্ষার মধ্যে যেতে হবে বিএনপিকে।