বিস্ময়কর হলেও সত্য—পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয় এমন মৃত্যু প্রায় অসম্ভব। যেমন, ব্রিটেনে স্বাস্থ্য নিরাপত্তাজনিত কারণে বৈধ ব্যবহারের জন্য হলেও শক্ত খোলস ছাড়া দা, ছুরি বা কাঁচির মতো কোনও ধারালো অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ। ব্রিটেনের মতো দেশগুলোয় ছোট-বড় সব পেশার সঙ্গে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ইস্যুটি সম্পৃক্ত। এক্ষেত্রে আলী আহমদ প্রধানীয়ার মতো মজুরদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা সরকারের পাশাপাশি বক্স আলী বেপারীর মতো মালিকদের দিতে হয়। যেমন, অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে একটি মাঝারি আকৃতির মুদি দোকানেও অগ্নিনিরোধক পানি, গ্যাস ও ফেনার সিলিন্ডার এবং অগ্নিনিরোধক জ্যাকেটসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকবে। অগ্নিকাণ্ডকালে ব্যবসা ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জায়গাসহ একটি অতিরিক্ত (ফায়ার এক্সিট) দরজা থাকবে। তদুপরি, নিয়োগদাতা তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল ব্যক্তিকে অগ্নিকাণ্ডকালে করণীয় সকল বিষয় সম্পর্কে প্রশিক্ষিত রাখবেন। আর খাবারের দোকান, রেস্তোরাঁ, গার্মেন্টস, কারখানা প্রভৃতি বিশেষ ব্যবসা কেন্দ্রের জন্য রয়েছে বিশেষ-বিশেষ আইনকানুন, যা সরকারের কঠোরতা ও আইনের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধার কারণে পুরোদমে কার্যকর রয়েছে।
অথচ অভ্যাসের কারণে স্বাস্থ্য নিরাপত্তাজনিত এমন বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব না দেওয়া বাংলাদেশের সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। যেমন, অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশু মৃত্যুহার কমানোর ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে আমাদের প্রশংসা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়লেও এখনও এক থেকে চার বছরের মোট শিশুমৃত্যু ৪৩% (আইসিডিডিআর,বি, ২০১৪) পানিতে ডুবে। এমন কথা উন্নত দেশের মানুষদের কাছে মনে হবে বানানো গল্পের মতো। স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এতটাই পিছিয়ে আছি আমরা। শুধু তাই নয়, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদন (২০১৫) আনুযায়ী বাংলাদেশে এখনও পাঁচ বছরের নিচের ১৮% শিশু মৃত্যুবরণ করে অজানা কারণে। একটু ভাবলেই, অনুমান করা সম্ভব—অশিক্ষা, কুসংস্কার ও মা-বাবার স্বাস্থ্যজ্ঞানের অভাবের মতো বিষয়গুলো কোনও না কোনওভাবে এমন মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে।
এবার আসা যাক, এমন কিছু ট্র্যাজেডির কথায়, যা প্রতিরোধযোগ্য অথচ প্রতিবছর ভৌতিক নাটকের মতো বাংলাদেশে মৃত্যুহার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। বাস খাদে পড়ে যাওয়া, যাত্রীভর্তি লঞ্চ ডুবে যাওয়া, পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ও ভবন ধ্বসের মতো ঘটনাগুলো যেন নিয়ম করে প্রতিদিন, প্রতিমাসে ও প্রতি বছরে ঘটেই যাচ্ছে। অথচ স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা বিধান মেনে রুটিন-মাফিক সাবধানতা অবলম্বন করলে নিমতলী ও রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির মতো দুর্ঘটনাগুলোও এড়ানো যেত।
ভবন নির্মাণবিধি মেনে চলা দেশ চিলিতে ২০১৪ সালে ৮.২ মাত্রার ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হওয়া সত্ত্বেও মানুষ মারা গিয়েছিল মাত্র ৬ জন আর ২০১০ সালে ৭ মাত্রার একটি ছোট ভূমিকম্পে ভবন নির্মাণবিধি না মেনে চলা দেশ হাইতিতে মানুষ মারা গিয়েছিল প্রায় তিন লাখ। স্বাস্থ্য নিরাপত্তাবিধি মেনে চলার গুরুত্ব বোঝার জন্য বাংলাদেশের কাছে এটি একটি চমৎকার উদাহরণ।
বাংলাদেশের মৃত্যুহার লাঘবে বাধা দিয়ে যাচ্ছে এমন আরেকটি কারণ হলো—পূর্ব প্রস্তুতি ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার প্রতি ঔদাসীন্য। টাকার মায়া কিংবা অসতর্কতার কারণে কম দামি বা ত্রুটিযুক্ত খাবার খাওয়া, সময়মতো স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করানো এবং অপরিচ্ছন্ন ও বিশৃঙ্খল জীবন-যাপনের কারণগুলো এর আওতায় পড়ে। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে স্পষ্ট করা যেতে পারে। বরিশালের গৃহিনী রাহেলা ২০০১ সালে অসুস্থ হলে ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখেন, তিনি হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত। ডাক্তারের পরামর্শে ঘরের সবার পরীক্ষা করে দেখা গেল যে রাহেলার স্বামী ও তিন সন্তান সবাই এই ভাইরাসে আক্রান্ত। রাহেলার পরিবারের সবার চিকিৎসার জন্য ডাক্তার যে ওষুধ লিখে দেন, তা অপেক্ষাকৃত দামি হওয়ায় ঘরের অন্য সবাই ওষধ চালিয়ে গেলেও রাহেলা এক সময় ওষধ বন্ধ করে দেন। এরপর ২০০৬ সালে রাহেলার লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে। গৃহিনী রাহেলাকে বাঁচানোর জন্য তার পরিবার সিঙ্গাপুরে নিয়ে তাকে বাঁচানোর উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ক্যান্সারের শেষ পর্যায়ে থাকায় সিঙ্গাপুরের ডাক্তাররাও রাহেলাকে বাঁচাতে অপারগতা প্রকাশ করে। দেশে ফেরার এক মাসের মাথায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন রাহেলা। অথচ, দামের দিকে না তাকিয়ে ওষুধ চালিয়ে গেলে রাহেলাকে কোটি টাকার ঝুঁকিতেও পড়তে হতো না, পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো সুস্থ-সবলভাবে বেঁচেও যেতেন।
বাংলাদেশে মৃত্যুহার লাঘবে আরেকটি বাধা হলো আবহাওয়া। তথ্য ঘাটলেই দেখা যাবে—বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস কিভাবে প্রায়ই মহামারি রোগের চেয়েও বেশি প্রাণ নিয়ে যায়। যেমন, ১৯৭০, ১৯৮৮ এবং ১৯৯১ সালের বন্যা। এই বছরগুলোয় প্রতিকূল আবহাওয়ায় ‘অতিরিক্ত উষ্ণ ও আর্দ্রতা’র বৈশিষ্ট্যটি সবার চোখ এড়িয়ে মেশিনের মতো রোগজীবাণুর বিস্তার ঘটিয়ে বছর বছর প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। অতিরিক্ত উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার কারণেই এদেশে হেপাটাইটিস বি, রোটা ভাইরাসের জীবাণু দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। গরমের সময় ডায়রিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধিই তার প্রমাণ।
একাধিক গবেষণাপত্র থেকে পাওয়া আঁতকে ওঠার মতো একটি খবর হলো—বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৭% থেকে ১০% হেপাটাইটিস বি-এর মতো জীবন-নাশক ভাইরাসে আক্রান্ত। এদেশে প্রতিবছর যত মানুষ ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, তাদের অধিকাংশই হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত থাকে।
লেখক: প্রধান নির্বাহী, ফুল-পাখি-চাঁদ-নদী।
ইমেইল- sea.sky.rafi@gmail.com
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।