বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ মসজিদ

৫০০ বছর আগের মসজিদটি ঘিরে কত গল্প!

বিশ্বে গর্ব করার মতো বাংলাদেশের আছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ স্থাপত্যকলা। শিল্পের এই মাধ্যমে কোনও অংশে কম ছিল না এ অঞ্চল। বাংলাদেশের যে স্থাপনাশৈলী এখনও বিমোহিত করে চলেছে অগণিত ভ্রমণচারী ও মননশীল মানুষকে, তার মধ্যে আছে দেশজুড়ে থাকা অগণিত নয়নাভিরাম মসজিদ। এ নিয়েই বাংলা ট্রিবিউন-এর ধারাবাহিক আয়োজন ‘বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ মসজিদ’। আজ থাকছে ফরিদপুরের সাতৈর শাহী জামে মসজিদ নিয়ে প্রতিবেদন।

শত-সহস্র পীর-আউলিয়ার দেশ বাংলাদেশ। তাঁদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাতেই বাংলায় প্রোথিত হয়েছিল ইসলামের বীজ। তেমনি ফরিদপুরের বোয়ালমারীর সাতৈর অঞ্চলেও ইসলাম প্রচারে এসেছিলেন বেশ কয়েকজন আউলিয়া। যাদের মধ্যে অন্তত ১২ জনের নাম জানা যায়। তারাই আজ থেকে প্রায় পাঁচ শ’ বছর আগে এ অঞ্চলে নির্মাণ করেন সাতৈর শাহী মসজিদ।

অনেকে অনুমাননির্ভর তথ্য দিয়ে বিভিন্ন মুঘল সম্রাটের নামের সঙ্গে মসজিদটির নাম যুক্ত করতে চেয়েছেন। তবে সঠিক দলিল পেশ করতে পারেননি কেউ। ধারণা করা হয় এটি বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদের সমকালীন।

এ ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় ভূষণা রাজ্যের ইতিহাস গ্রন্থের রচয়িতা কবি সমর চক্রবর্তীর কাছ থেকে। ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তিনি জানান, এটি নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের আমলে নির্মিত। ঐতিহাসিক সাতৈর নগরী এখন অবহেলিত জনপদ হলেও বাংলার সুলতানি আমলে ভূষণা রাজ্যের সুপ্রাচীন নৌবন্দর ও প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল সাতৈর ও তার আশপাশের এলাকা। এ মসজিদের পাশ ঘেঁষেই গেছে ঐতিহাসিক গ্রান্ড ট্রাংক রোড। কেউ কেউ মনে করেন, সাতৈর শাহী মসজিদটি শের শাহের আমলের স্থাপনা।

ধারণা করা হয়, আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কোনও এক পীরের সম্মানে মসজিদটি নির্মাণ করেন। ঐতিহাসিক সাতৈর মসজিদ থেকে সামান্য দক্ষিণে একটি ভিটা পাওয়া যায়। এখন তা মৌলভি বাড়ির ভিটা নামে পরিচিত। ভিটাটি প্রাচীনকালের ছোট ছোট ইটে ভরপুর। এখানে কমপক্ষে আটজন সুফি-সাধকের কবর রয়েছে বলে জানা যায়। লাল মাটি আর ছোট ছোট ইট প্রমাণ করে এক সময় কবরগুলো একসময় বাঁধানো ছিল।

মসজিদটির মিনারের গঠনশৈলী ও ইটের আকার দেখে বিশেষজ্ঞমহল এটিকে চতুর্দশ শতকের ইমারত হিসেবে শনাক্ত করেছেন। ঐতিহাসিক মতবিরোধ যাই থাকুক, মসজিদটি যে এর আশপাশে কবরে শায়িত আউলিয়াদের সম্মানের প্রতীক হিসেবে নির্মিত হয়েছিল এ বিষয়ে সবাই একমত। সাতৈর শাহী মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় যেসব ধর্ম প্রচারকের নাম সংরক্ষিত আছে তারা হলেন-

১। হযরত জালাল শাহ বাগদাদি (রহ.)

২। হযরত জায়েদ শাহ্ বাগদাদি (রহ.)

৩। হযরত বোখারি শাহ বাগদাদি (রহ.)

৪। হযরত সুফি বুট্টি শাহ বাগদাদি (রহ.)।

৫। হযরত শাহ মইজউদ্দীন তেগ বোরহানি ইয়ামানি (রহ.)।

৬। হযরত শাহ সুফি মুছি হাক্কানি (রহ.)।

৭। হযরত শায়েখ শাহ আলি ছতরি (রহ.)।

৮। হযরত শাহ কলিমুল্লাহ (রহ.)।

৯। আবদুল্লাহিল কাফি (রহ.)।

১০। হযরত আবদুল্লাহিল সাফি (রহ.)।

১১। হযরত লাল শাহ (রহ.)।

১২। হযরত উড়িয়ান শাহ (রহ.)

হযরত শায়েখ শাহ আলি ছতরি (রহ.) চতুর্দশ শতকে এদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য এসেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তিনি সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। হযরত শায়েখ শাহ আলি ছতরির (রহ.) ত্যাগী জীবনযাত্রায় আকৃষ্ট হয়ে সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ তার মুরিদ হয়েছিলেন বলে কিছু দলিলে উল্লেখ আছে।

মসজিদটির দক্ষিণ পাশে প্রাচীনকালের ছোট ছোট ইটে বাঁধানো দুটো কবর রয়েছে। একটি হযরত শাহ কলিমুল্লাহর (রহ.), অপরটি হযরত মইজউদ্দীন কানি শাহ’র (রহ.)। মসজিদের পূর্বপাশে রয়েছে হযরত শাহ কলিমুল্লাহর (রহ.) সহোদর হযরত লাল শাহ (রহ.)-এর কবর।

দুই সহোদর হযরত আবদুল্লাহিল কাফি (রহ.) ও হযরত আবদুল্লাহিল সাফি (রহ.)-এর মাজার সাতৈরের কাছে ধোপাডাঙ্গা গ্রামে অবস্থিত। মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫) তারা দুজন ইসলাম প্রচারের জন্য এ এলাকায় আসেন। এ এলাকায় ইসলাম বিস্তারে তারা বিশেষ অবদান রেখেছিলেন।

ঐতিহাসিক সাতৈর শাহী মসজিদের পূর্ব পার্শে শায়িত রয়েছেন হযরত লাল শাহ্ (রহ.)। হযরত উড়িয়ান শাহ্ (রহ.)-এর কবর দুধ পুকুরের উত্তর-পশ্চিমে। দ্বাদশ শতকে বাংলায় ইসলাম প্রচারের মানসে আসেন তিনি।

received_1787828484722928প্রথম দিকে এ অঞ্চলে ইসলামের বাণী প্রচারে হযরত উড়িয়ান শাহ’র (রহ.)-এর বিশেষ অবদান রয়েছে। তখনকার ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু-বৌদ্ধ অধ্যুষিত ও বিরূপ ভাবাপন্ন এলাকায় ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে প্রচণ্ড বাধার মুখে পড়েছিলেন তিনি। তাকে অত্যন্ত বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে তৌহিদের বাণী প্রচারে ব্রতী হতে হয়েছিল। আঞ্চলিক লোকগাঁথা থেকে জানা যায়, তিনি ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় ধর্মযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। তার মস্তকের কবর ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় আর বাকি দেহের কবর সাতৈরে।

কথিত আছে, শত্রুবাহিনী যখন তার শিরশ্ছেদ করে, মস্তকহীন দেহ নিয়ে ঘোড়া ছুটে আসে সাতৈর। তখনও সন্ধা হয়নি। ওই সময় নাকি তার মস্তকহীন দেহ থেকে আওয়াজ আসে- আসরের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি অজুর পানি দাও। খাদেম অজুর পানি না দিয়ে প্রশ্ন করেন- হুজুর আপনার মাথা কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে খাদেম ও ঘোড়ার মস্তক দেহ থেকে আলাদা হয়ে যায়।

অনেকের ধারণা, শত্রুবাহিনীর কেউ উড়িয়ান শাহকে অনুসরণ করে সাতৈরে পৌঁছে খাদেম ও ঘোড়ার শিরশ্ছেদ করে পালিয়ে যায়। ঘটনা যাই হোক, হযরত উড়িয়ান শাহ (রহ.)-এর দেহের কবরের পাশে সেই খাদেম ও ঘোড়ার কবরও অক্ষত আছে।

বর্গাকার মসজিদটি বাইরের দিক থেকে প্রতিপাশে ১৭.৮ মিটার এবং ভেতরে ১৩.৮ মিটার। মোট ৯টি কন্দাকৃতির গম্বুজ রয়েছে। ভেতরে আছে পাথরের তৈরি চারটি স্তম্ভ। দেয়াল ও দেয়ালসংলগ্ন মোট ১২টি পিলার রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের মসজিদগুলোর মতো তিনটি মিহরাব আছে। কেন্দ্রটি তুলনামূলকভাবে বড়।

মসজিদটি সম্পর্কে অনেক জনশ্রুতি ও কুসংস্কার চালু আছে। যা বিশ্বাস করে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে বহু লোক নানা মানত নিয়ে আসে। যেমন-

·         মসজিদটি আল্লাহর হুকুমেই এক রাতে মাটি ফেটে গজিয়ে উঠেছিল।

·         মসজিদের ভেতরের চারটি খুঁটি বিভিন্ন সময়ে হাসি-কান্নার মতো শব্দ করে।

·         এ মসজিদের ধূলি গায়ে মাখলে রোগ সেরে যায়।

·         মসজিদে এসে মানত করলে নিঃসন্তানদের সন্তান হয়।

তবে, এখনকার অনেক আলেমই এগুলোকে কুসংস্কার, বানোয়াট ও ইসলামের পরিপন্থী বলেছেন।

এ মসজিদকে ঘিরে একটি মেলাও হতো। শিরকের ছড়াছড়ি দেখে স্থানীয় আলেমরা সেটাও বন্ধ করে দিয়েছেন। তবে সংস্কারের নামে মসজিদটির ঐতিহাসিক কাঠামো বিনষ্ট করার অভিযোগ তাদেরও। প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্যের তোয়াক্কা না করে টাইলস আচ্ছাদিত করা হয়েছে মসজিদটিকে।

সংস্করণের নামে বর্ধিত অংশও বানানো হয়েছে। ঐতিহাসিক এই স্থাপনার সঙ্গে সমন্বয় না রেখে নির্মিত বর্ধিত অংশ কেবল সৌন্দর্যই নষ্ট করেনি, ঐতিহাসিক এই মসজিদের সঙ্গে উপহাস করা হয়েছে বলেও মন্তব্য অনেকের।

ঐতিহাসিক মসজিদটি নিয়ে স্থানীয়দের কিছু অভিযোগও রয়েছে। সাতৈর বাজার বণিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আতিয়ার রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, মসজিদের ব্যক্তিগত সম্পদ হিসেবে প্রায় ৬০/৭০ টি দোকান ঘর রয়েছে। এগুলোর আয়-ব্যয়ের হিসাব জানতে পারে না কেউ।

চলতি মাসে মসজিদের উন্নয়নের কথা বলে প্রায় শতবর্ষী একটা গাছও কাটা হয়েছে। সবমিলিয়ে দীর্ঘদিন যারা মসজিদটির পরিচালনায় রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছেন বলেও জানান আতিয়ার রহমান।

ঐতিহাসিক মসজিদটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঝোটন চন্দ্র বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মসজিদটি জেলার মধ্যে একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। গতবছরে মসজিদের মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে বেশকিছু দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেগুলো পাকাপোক্ত করে নির্মাণ করা হয়েছে। মুসুল্লিদের জন্য একটি টিনের শেড নির্মাণ, একটি দাতব্য চিকিৎসালয় এবং ঐতিহ্য ঠিক রেখে আলাদা একটি বহুতল ভবন নির্মানের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।