বেঙ্গির মায়ের এক ডিমের মসজিদ!

বিশ্বে গর্ব করার মতো বাংলাদেশের আছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ স্থাপত্যকলা। শিল্পের এই মাধ্যমে কোনও অংশে কম ছিল না এ অঞ্চল। বাংলাদেশের যে স্থাপনাশৈলী এখনও বিমোহিত করে চলেছে অগণিত ভ্রমণচারী ও মননশীল মানুষকে, তার মধ্যে আছে দেশজুড়ে থাকা অগণিত নয়নাভিরাম মসজিদ। এ নিয়েই বাংলা ট্রিবিউন-এর ধারাবাহিক আয়োজন ‘বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ মসজিদ’। আজ থাকছে হবিগঞ্জের বেঙ্গির মায়ের মসজিদ।
 
হবিগঞ্জ জেলা সদর থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরের নিভৃত পল্লী প্রজাতপুর। এখানেই এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন এক মহীয়সী নারী। স্বামীর অঢেল সম্পদ থাকলেও তা ছুঁয়ে দেখেননি। নিয়ত (মানত) করেছিলেন নিজের আয়েই গড়ে তুলবেন একটি মসজিদ। ঘটনা আজ থেকে ১১৯ বছর আগের। ওই নারীকে সবাই বেঙ্গির মা নামে চেনে। তার নামেই মসজিদের নাম বেঙ্গির মায়ের মসজিদ। শত বছর পরও মসজিদে নামাজ পড়ছে মুসুল্লিরা। দেওয়ালে লেখা আছে- প্রজাতপুর ও লালাপুর জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠাতা বেঙ্গির মা।

একটি মাত্র ডিম দিয়ে শুরু করেছিলেন মসজিদ নির্মাণের বাসনা। এ কারণে মসজিদটিকে ‘এক আন্ডার মসজিদ’ নামেও ডাকে অনেকে। একটি ডিম থেকে কী করে মসজিদ হলো? ঘটনা হার মানাবে গল্পকেও।

জানা যায়, হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের প্রজাতপুর গ্রামের কৃষক সরফ উল্লার স্ত্রী বেঙ্গির মা ১৯০২ সালে প্রজাতপুর ও লালাপুর গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মসজিদ নির্মাণ শেষে তিনি প্রথম এর নাম রাখেন ‘এক আন্ডার মসজিদ’। সবার মনে প্রশ্ন, এমন নাম কেন? ঘটনা বেঙ্গির মা নিজেই খুলে বলেছিলেন।

এলাকাবাসীকে তিনি জানান, একটি মুরগির ডিম মসজিদের নামে মানত করেন তিনি। ওই ডিম একটি মুরগির নিচে রাখেন তা দেওয়ার জন্য। ডিম ফুটে বের হয় একটি ছানা। ওটা বড় হলে পরে ওটা থেকে পাওয়া যায় আরও ৭টি ডিম। ৭টি ডিম থেকেই আসে আরও ৭টি ছানা। একপর্যায়ে মুরগির খামার গড়ে তোলেন বেঙ্গির মা। ওই খামারের মুরগি বিক্রি করে জমাতে শুরু করেন টাকা। ওই আমলেই জমিয়ে ফেলেন এক লাখ টাকা। এরপর পুরোটাই খরচ করেন মসজিদ নির্মাণে।

নিঃসন্তান বেঙ্গির মায়ের এ ঘটনা জানাজানি হলে মসজিদটির নাম ছড়িয়ে পড়ে। শত বছর পরও এ কাহিনি সবার মুখে বেশ তরতাজা। অনেকেই বললেন, এমন ঐকান্তিক ইচ্ছাশক্তির নজির ইতিহাসে আর নেই।

প্রজাতপুর ও লালপুর গ্রামবাসী ২০০৯ সালে মসজিদটির বর্ধিত অংশ সংস্কার করেছেন। কিন্তু বেঙ্গির মার মূল মসজিদটি এখনও আছে। চলতি বছরে নতুন করে রং করা হয়েছে।

‘এক আন্ডার মসজিদ’-এর খতিব মাওলানা আলমাছ উদ্দিন বলেন, ‘আমি মসজিদ নির্মাণে বেঙ্গির মার গল্প শুনে অবাক হয়েছি। নিয়ত থাকলে কী না হয়।’

বেঙ্গির মার এক উত্তরপুরুষ প্রজাতপুর গ্রামের রাকিল হোসেন বলেন, ‘আমার পূর্বপুরুষ নিঃসন্তান সরফ উল্লার স্ত্রী বেঙ্গির মা এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। বাবার কাছ থেকেও শুনেছি বেঙ্গির মা একটি ডিম থেকেই এই মসজিদ নির্মাণের টাকা জমান।’

বর্তমানে এলাকাবাসী চাঁদা তুলে মসজিদের সংস্কার করেছেন। মসজিদের মোতাওয়াল্লি লন্ডন প্রবাসী আবদুল হারিছ। তিনি দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা যায়নি।

প্রজাতপুর গ্রামের নিয়মিত মুসুল্লি উলফর উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের গ্রামের বেঙ্গির মা এমন একটি কাজ করেছেন, যা সারা জীবনে ভোলার মতো নয়। বেঙ্গির মা তার সেই খামারের একটি টাকাও সংসারের কাজে ব্যয় করেননি। পুরোটাই দিয়েছেন মসজিদের জন্য।’

মসজিদ পরিচালনা কমিটিতে রয়েছেন বেঙ্গির মার বংশধর রূপ উদ্দিন, লন্ডন প্রবাসী আবদুল হারিছ, ব্যবসায়ী হেলিম উদ্দিন, রাকিল হোসেন ও শামীনুর মিয়া। কমিটির একাধিক সদস্যের মতে, বেঙ্গির মার এক আন্ডার মসজিদটি পর্যটকদের জন্য একটি আশ্চর্যজনক স্থাপত্য। তারা আশা করছেন সরকার এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেবে।