বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ মসজিদ

অলৌকিক সব গল্প বিবিচিনি শাহী মসজিদকে ঘিরে

বিশ্বে গর্ব করার মতো বাংলাদেশের আছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ স্থাপত্যকলা। শিল্পের এই মাধ্যমে কোনও অংশে কম ছিল না এ অঞ্চল। বাংলাদেশের যে স্থাপনাশৈলী এখনও বিমোহিত করে চলেছে অগণিত ভ্রমণচারী ও মননশীল মানুষকে, তার মধ্যে আছে দেশজুড়ে থাকা অগণিত নয়নাভিরাম মসজিদ। এ নিয়েই বাংলা ট্রিবিউন-এর ধারাবাহিক আয়োজন ‘বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ মসজিদ’। আজ থাকছে বরগুনার বিবিচিনি শাহী মসজিদ।

নদী-সাগরবেষ্টিত দেশের সর্বদক্ষিণের উপকূলীয় জেলা বরগুনা। ঐতিহ্যবাহী এ জনপদে রয়েছে শত বছরের পুরনো স্থাপনা। আর এ তালিকায় সবার আগে আসবে বিবিচিনি শাহী মসজিদের নাম।

বরগুনার বেতাগী উপজেলা থেকে মহাসড়ক ধরে উত্তর দিকে ১০ কিলোমিটার গেলেই বিবিচিনি গ্রাম। দিগন্তজুড়ে সবুজের বর্ণিল আতিথেয়তায় উদ্ভাসিত ভিন্ন এক ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যে উঁচু টিলার ওপর মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে বিবিচিনি শাহী মসজিদ। কথিত আছে, এই মসজিদকে ঘিরেই উপকূলীয় বাংলায় শুরু হয় ইসলামের প্রচার।

প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছরের পুরনো এই স্থাপনা আকারে বড় না হলেও স্থাপত্যশৈলীতে বেশ রাজসিক। এই মসজিদ ঘিরে রয়েছে অনেক অলৌকিক গল্পও।

জানা যায়, সম্রাট শাহজাহানের আমলে শাহ নেয়ামতুল্লাহ নামের এক সাধক পারস্য থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে দিল্লি আসেন। ওই সময় শাহজাহানের দ্বিতীয় ছেলে বাংলার সুবাদার শাহ সুজা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে ইসলাম প্রচারের জন্য শাহ নেয়ামতুল্লাহ তার শিষ্যসহ বজরায় চড়ে গঙ্গা অতিক্রম করে বিষখালী নদীতে নোঙর করেন। তখন শাহ সুজার অনুরোধে গ্রামে এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ তৈরি করা হয়। পরে নেয়ামতুল্লাহর কন্যা চিনিবিবি ও ইছাবিবির নাম মিলিয়ে গ্রামের নাম রাখা হয় বিবিচিনি। মসজিদটির নামও সেখান থেকে নেওয়া।

উল্লেখ্য, শাহ নেয়ামতুল্লাহর নামের সঙ্গে মিল রেখেই বিবিচিনি গ্রামের পাশের গ্রামের নাম রাখা হয় নেয়ামতি।

আরও জানা যায়, ওই সময় বিষখালীর পানি ছিল লবণাক্ত। সুপেয় পানির অভাবে এই এলাকার মানুষ বহু কষ্ট পেতো। শাহ নেয়ামতুল্লাহ এই কষ্ট অনুভব করে তার তসবিহটি বিষখালী নদীতে ধুয়ে দেন। এতেই নাকি পানি হয়ে যায় সুপেয়। আজও সেই পানি তেমনই রয়েছে।

তাছাড়া ওই সময় সুন্দরবন-সংলগ্ন বিষখালীতে ছিল কুমিরের আনাগোনা। শাহ নেয়ামতুল্লাহ আসা পর নাকি বিবিচিনির ধারেকাছেও কোনও কোনও কুমির আসতো না। এসব নানান গল্প এখনও স্থানীয়দের মুখে মুখে।

মুঘল আমলের মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট, প্রস্থ ৩৩ ফুট। দেয়ালগুলো ছয় ফুট চওড়া। দক্ষিণ ও উত্তর দিকে তিনটি দরজা আছে। জাফরি ইটে তৈরি মসজিদটি সমতল থেকে কমপক্ষে ৩০ ফুট উঁচু টিলার ওপর। উচ্চতায় মসজিদটি প্রায় ২৫ ফুট।

দর্শনার্থী ও মুসুল্লিদের জন্য পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে রয়েছে দুটি সিঁড়ি। পূর্ব পাশের সিঁড়িটি ২৫ ধাপের, উচ্চতা ৪৬ ফুট। দক্ষিণের সিঁড়িটি ২১ ধাপের, উচ্চতা ৪৮ ফুট।

Barguna Bibichini Mosque News pic-01 (1)মসজিদের কাছেই ছিল ছোট-বড় তিনটি পুরনো দিঘী। এসব দিঘী নিয়েও আছে অনেক জনশ্রুতি। বড় দিঘীটির নাম ইছাবিবির দিঘী। বর্তমানে এসব দিঘীর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। এ ছাড়া মসজিদের পাশেই আছে তিনটি অন্যরকম কবর। লম্বায় একেকটি ১৪-১৫ হাত। পশ্চিম ও উত্তর পাশের কবরে শায়িত আছেন সাধক নেয়ামতউল্লাহ এবং চিনিবিবি ও ইছাবিবি।

বিবিচিনি শাহী মসজিদের ইমাম মাওলানা আবদুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দর্শনীয় এই মসজিদে প্রতিদিন বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অগণিত নারী-পুরুষ এসে নামাজ আদায় করেন। অনেকেই টাকা-পয়সা দান করেন। প্রতি সপ্তাহে জুমার নামাজেও অনেক মুসুল্লি আসেন।

ঐতিহ্যের সাক্ষী এ স্থাপনায় এখন অযত্ন আর অবহেলার ছাপ স্পষ্ট। মসজিদটির দেয়ালের কিছু কিছু অংশের পলেস্তারা খসে গেলে ১৯৮৫ সালে উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে তা মেরামত করা হয়।

১৯৯২ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের দায়িত্ব নেয় এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। বিশুদ্ধ পানি, অজু ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার নেই এখানে। এ কারণে মসজিদ দেখতে আসা পর্যটকরাও সমস্যায় পড়েন। এর রক্ষণাবেক্ষণে একজন কেয়ারটেকার থাকলেও নেই অন্য কোনও দায়িত্বশীল কর্মী। ঐতিহাসিক স্থাপনাটি সরকারিভাবে সংরক্ষণের দাবি জানান এলাকাবাসী।

বেতাগী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সুহৃদ সালেহীন বলেন, সরকারি স্থাপনা হিসেবে বিবিচিনি শাহী মসজিদের প্রতি স্থানীয় প্রশাসনের বিশেষ নজর রয়েছে। মসজিদটি সংস্কারের জন্য বিভিন্ন সময় উপজেলা প্রশাসন থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।