বাংলাদেশের যে স্থাপনাশৈলী এখনও বিমোহিত করে চলেছে অগণিত মানুষকে, তার মধ্যে আছে দেশজুড়ে থাকা অগণিত নয়নাভিরাম মসজিদ। এ নিয়েই বাংলা ট্রিবিউন-এর ধারাবাহিক আয়োজন ‘বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ মসজিদ’। আজ থাকছে নওগাঁর ভাঙা মসজিদ।
নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ‘ভাঙা মসজিদ’ অযত্নে অবহেলায় আরও ভাঙতে বসেছে। মসজিদটির অবকাঠামো ছাড়া বলতে গেলে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে ওই কাঠামোতেই প্রাচীন ঐতিহ্যের ছাপ লেগে আছে পরতে পরতে। নান্দনিক নকশা ও সুনিপুণ নির্মাণকাজ বলে দেয়, মুসলিম ইতিহাসের নান্দনিক এ যুগের কথা।
স্থাপত্যকলা, শিল্প-সৌন্দর্যের আধার ধর্মপুরের ভাঙা মসজিদটি ঠিক কতো বছর আগে তৈরি হয়েছিল, এর সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।
এলাকাবাসীর সূত্রে জানা গেছে, কোনও এক সময় প্রাচীন মসজিদটির আশপাশে মুসলিম জনবসতি ছিল। মসজিদের পাশে বিশাল পুকুর থাকার কারণে এখানেই এখানে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। তবে ওই বসতিটি কী কারণে এলাকা ছেড়ে চলে যায় তার তথ্যও জানা নেই।
মসজিদটির গঠন ও স্থাপত্য কৌশল শিল্পসমৃদ্ধ। নয় গম্বুজ বিশিষ্ট বর্গাকৃতির মসজিদটির ভেতর চারটি সুদৃঢ় খিলান আছে। দরজা একটি। দ্বিতল ভবনের ভেতরে মেহরাব ও দেয়ালে অঙ্কিত রয়েছে ফুলদানি ও ফুলের নকশা।
মসজিদটির সিঁড়িসহ প্রবেশপথ, খোলা চত্বর ও মূল ভবন তিনটি অংশে বিভক্ত। বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে ধারণা করা হয় মসজিদটি ৪০০ থেকে ৫০০ বছর আগের।
তবে এটি আশির দশক থেকেই ধীরে ধীরে ধ্বংস হতে শুরু করে। দেয়ালে গজিয়ে উঠেছে গাছপালা, শ্যাওলা। দেখা দিয়েছে বড় ফাটল। নামাজ পড়ার অনুপোযুক্ত বলে এর ভেতর এখন মুসুল্লিও আসেন না।
মসজিদটির পাশের ধর্মপুর পাইকপাড়া মন্ডলপাড়া জামে মসজিদের মুসুল্লি হাকিম আলী (৮৫) বলেন ,আমার নিজের চোখে দেখা। ২০ বছর আগেও অনেক সুন্দর ছিল মসজিদটি। দূর-দূরান্তর থেকে মানুষ আসতো এটি দেখতে।
দুই ঈদের নামাজ হতো এখানে। শেষ ঈদের জামাত হয় ২০০০ সালে। বাপ-দাদার মুখে শুনেছি ১৯২০ সালের ভূমিকম্পে ৯টি গম্বুজসহ মসজিদটির কিছু অংশ ভেঙে যায়। তারপর থেকেই এর নাম হয় ‘ভাঙা মসজিদ’।
এর একটি দরজায় কস্টি পাথরে খোদাই করে আরবি ভাষায় কোরআনের সুরা লেখা ছিল। পাথরটা চুরি হয়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দা কাবুল হোসেন বলেন, প্রাচীন মসজিদটি আমার ধারণা মতে ৩০০ বছর আগেকার হবে। বাপ-দাদারাও বলতে পারবে না এর নির্মাণকাল।
গতবছর সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কিছু লোক এসে গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে মসজিদটিতে পরিচ্ছন্নতার কাজ করেছিল। তারপর আর কেউ খোঁজ নেয়নি।
কাবুল হোসেন আরও বলেন, ‘এই মসজিদে আমি নামাজ পড়েছি। মসজিদটির সংস্কার চাই আমরা। পাশাপাশি ঐতিহ্যও রক্ষা করারও দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের প্রতি অনুরোধ করছি।’
নিয়ামতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মারিয়া জয়া পেরেরা বলেন, ‘মসজিদটির সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরকে গ্রামবাসীর স্বাক্ষরিত চিঠি পাঠিয়েছি। শিগগিরই অধিদফতরের আওতায় আসবে এটি।’
বগুড়া প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর আঞ্চলিক পরিচালক মোছা. নাহিদ সুলতানা বলেন, ‘আনুমানিক ১৭শ খ্রিস্টাব্দের মসজিদটিতে ৯টি গুম্বুজ, ৪টি পিলার ও পশ্চিম দিকে মিহরাবের সন্ধান পাওয়া গেছে। দেখে মনে হয়, এটি মুঘল আমলের। আমরা মসজিদ এলাকা ঘুরে দেখেছি। প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী এটি সংরক্ষণযোগ্য। স্থানীয় লোকজন এবং মুসুল্লিরাও এটি সংরক্ষণের পক্ষে মত দিয়েছেন। মসজিদটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে ঘোষণা করে এর সংরক্ষণের বিষয়টি বিবেচনা করার ব্যাপারে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি।’