‘সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না’

ব্যক্তির বিনির্মাণ ও তার সফলতায় ইসলামি বিধান পরিপালন খুবই সহজ ব্যাপার, তা এই কারণে যে ইসলাম প্রকৃতি ও মানবতার ধর্ম। তার প্রতিটি শিক্ষা ও নির্দেশনা মানবপ্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও সহায়ক। ইসলামি জীবনদর্শন ও শরিয়তের দেখানো পথ অনুসরণে জীবনের সবক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন সম্ভব।

ইসলামি জীবনবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো– মা-বাবার অধিকার নিশ্চিত করা, বড়দের শ্রদ্ধা, ছোটদের প্রতি স্নেহ ও ভালোবাসা এবং স্বজন ও প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার ইত্যাদি। এক্ষেত্রে গায়ের রঙ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বিবেচ্য নয়।

ইসলামে বংশের বিভাজন, বয়স্ক বাবা-মায়ের প্রতি বিতৃষ্ণা-অবহেলা ইত্যাদির কোনও স্থান নেই। প্রত্যেককে তার প্রাপ্য অধিকার প্রদানে গুরুত্বারোপ করে ইসলাম। হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা পরস্পর সালাম বিনিময় করো।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস: ৭৩) অন্যকে সালাম দেওয়া মানে তার শান্তি কামনা করা। এখানে ছোট বড়কে, কালো ফর্সাকে, গরিব ধনীকে সালাম দেবে—এমন কথা বলা হয়নি; বরং সবাই সবাইকে সালাম দিবে। এতে পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে।

মানুষের সঙ্গে বসবাস, চলাফেরা ও সদ্ব্যবহারের প্রতি গুরুত্বারোপ করে মহানবী (সা.) বলেন, যে মুসলমান সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে এবং তাদের থেকে পাওয়া বেদনাদায়ক বিষয়াবলির ওপর ধৈর্য ধারণ করে, সে ওই মুসলমান থেকে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ যে একাকী জীবনযাপন করে এবং মানুষের বেদনাদায়ক কথায় ধৈর্য ধারণ করে না। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ২৫০৭)

তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো।’ (আল মুজামুল কাবির লিত-তাবারানি, হাদিস: ২৯৮)। মহানবী (সা.) বলেন,  মুসলমান ভাইয়ের সাথে সদ্ব্যবহার তোমাদের জন্য সদকা স্বরূপ।’ (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ১৯৫৬)

ইসলামে বিশেষত মা-বাবার সঙ্গে সদাচার বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম ও ইসলামি সভ্যতায় বাবা-মায়ের মর্যাদা ও সম্মানের প্রতি ইঙ্গিত করে পবিত্র কোরআনে একাধিক নির্দেশনা এসেছে। রাসুল (সা.) বলেন, বাবা জান্নাতের দরজাগুলোর মধ্যে মধ্যবর্তী দরজা। (আল মুসতাদরাক আলাস-সাহিহাইন, হাদিস: ২৭৯৯)।

তিনি আরও বলেন, বাবার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং বাবার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ১৮৯৯)

বড়দের সঙ্গে উত্তম আচরণ ও সদ্ব্যবহার সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যে নওজোয়ান কোনও বয়স্ক ব্যক্তিকে তার বয়সের কারণে সম্মান করবে, আল্লাহতায়ালা তার বার্ধক্যেও এমন মানুষ তৈরি করে দেবেন, যে তাকে সম্মান করবে ও তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ২০২২)।

রাসুল (সা.) অন্যত্র ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ এবং বড়দের সম্মান করে না, তার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস : ১৯১৯)

প্রতিবেশী ও স্বজনদের খেয়াল রাখা এবং তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার ইসলাম ও ইসলামি সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রাসুল (সা.) বলেন, সে তো মুমিন-ই নয়- যে নিজে পেটপুরে খেলো কিন্তু তার প্রতিবেশী অভুক্ত রইলো। (আল মুসতাদরাক আলাস-সাহিহাইন, হাদিস: ৭৩০৭)।

আল্লাহর রাসুল আরও বলেন, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে উত্তম প্রতিবেশী হলো ওই ব্যক্তি যে আপন প্রতিবেশীর কাছে উত্তম। (সহি ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৫১৮)

বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখা সদাচারের অন্তর্ভুক্ত এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা এর বিপরীত; অর্থাৎ অসদাচারের শামিল। যারা বন্ধু ও স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, ইসলামে তাদের কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস : ৫৯৮৪)

সমাজ সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও সদ্ব্যবহারের ওপর টিকে থাকে। আর এগুলোর মূল উপাদান যখন অনুপস্থিত হয়ে পড়ে, তখন সমাজে ফাটল দেখা দেয়। ভালোবাসা ও সদ্ব্যবহারের শক্তিশালী উপাদান হলো- আত্মত্যাগ ও কোরবানি। এজন্য পবিত্র কোরআনে আত্মত্যাগের প্রশংসা করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘...আর তারা (আনসাররা) তাদেরকে (অর্থাৎ মুহাজিররা) নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেয়, নিজেরা যতই অভাবগ্রস্ত হোক না কেন।...’ (সুরা হাশর, আয়াত: ৯)। এটি প্রাচীন ইসলামী সভ্যতা ও মুসলিম সমাজের ওইসব গুণাবলির ছোট্ট একটি গুণ, যেটি সেই সোনালি সমাজের অংশ ছিল। এ কারণেই অপরিচিত দুইটি দল; আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

সুতরাং আমাদেরও উচিত সবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা- এতে ইসলামি জীবনাদর্শ পরিপালনের জন্য যেমন আমরা আল্লাহর কাছে পুরস্কৃত হবো, তেমনি দুনিয়ায় আল্লাহ আমাদের সম্মানের মতো মহাদৌলত দান করবেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সদ্ব্যবহারকারী হিসেবে কবুল করে নিন। আমিন।

লেখক : শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ