মসজিদের শৌচাগার কি নারীরা ব্যবহার করতে পারবেন?

জুমার নামাজের বিরতির জন্য ঢাকামুখী আমাদের বাসটি মানিকগঞ্জে রাস্তার পাশের একটি মসজিদে থামলো। দেখা গেলো– বেশিরভাগ যাত্রী নামাজ পড়লেন এবং কিছু যাত্রী নামাজ না পড়লেও বাস থেকে নেমে মসজিদের শৌচাগারে গেলেন এবং তাদের কয়েকজন রাস্তার পাশে, আবডালে প্রস্রাব সেরে নিলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো—এ সময় কোনও নারী বাস থেকে নামলেন না।

জুমাসহ অন্যান্য নামাজের জন্যও বিভিন্ন সময় আমাদের দেশে বাসের বিরতি দেওয়ার রীতি আছে। তখন বিশেষত পুরুষ যাত্রীরা নামাজ আদায় করতে পারেন, সাথে টয়লেটও সেরে নেন। কিন্তু এক্ষেত্রে নারীরা নামাজ কিংবা টয়লেট—কোনোটারই সুযোগ পান না। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পুরুষের ওপর যেমন ফরজ, ঠিক অনুরূপ নারীর ওপরও নামাজের একই হুকুম ও বিধান। কিন্তু যাত্রাপথে সুযোগ না থাকায় নারীরা নামাজের মতো ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান পরিপালন করতে পারছেন না।

বর্তমান সময়ের বাস্তব চিত্র হচ্ছে—নারীদের বাইরে চলাফেরা বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজকর্মের উদ্দেশ্য ছাড়াও অনেক নারী গ্রাম ছেড়ে শহরে স্বামী-সন্তানসহ বসবাস করছেন। তারা যখন গ্রামের বাড়িতে যান কিংবা ফেরেন, তখন যাত্রাপথে স্বামী-সন্তানেরা নামাজ আদায় করলেও তারা সে সুযোগ পাচ্ছেন না। যদিও কিছু মসজিদে নারীদের স্বতন্ত্র নামাজের জায়গা বরাদ্দ আছে, তবে সংখ্যায় তা খুবই অল্প।13-60ef68a91b95489a128aa5b725ac34e2-fb6941288a77a87c8c90fcbd76d32859

মসজিদে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা না রাখার কারণ তাদের প্রতি বৈষম্য থেকে নয়; বরং ইসলামই বলছে- নারীর নামাজের জন্য উত্তম জায়গা হলো ঘর; মসজিদ নয়। বিষয়টি জায়েজ হলেও রাসুল (সা.) থেকে শুরু করে, পরবর্তী সময়ে সাহবায়ে কেরামও তাদের মসজিদে এসে নামাজ আদায়ে নিরুৎসাহিত করেছেন।

এ প্রসঙ্গে হজরত আবু হুমাইদ আল সাঈদি থেকে বর্ণিত, একবার উম্মে হুমাইদ নামের এক নারী সাহাবি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি আপনার সঙ্গে নামাজ আদায় করতে আগ্রহী।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি জানি তুমি আমার সঙ্গে নামাজ আদায় করতে পছন্দ করো। কিন্তু তোমার জন্য বড় কামরার চেয়ে ঘরের অন্দরমহলে নামাজ পড়া উত্তম। আবার বড় কামরায় নামাজ পড়া উত্তম বারান্দায় নামাজ পড়ার চেয়ে। বারান্দায় নামাজ আদায় করা উত্তম তোমার মহল্লার মসজিদের চেয়ে। মহল্লার মসজিদ উত্তম আমার মসজিদ (মসজিদে নববী) থেকে।’ এ কথা শোনার পর উম্মে হুমাইদ (রা.) তার ঘরের নির্জন স্থানে একটি নামাজের জায়গা বানাতে নির্দেশ দিলেন। সেখানেই আজীবন নামাজ আদায় করতে লাগলেন। এ অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৭০৯০)

আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নারীরা যে অবস্থা সৃষ্টি করেছে, তা যদি রাসুল (সা.) জানতেন, তবে বনি ইসরাইলের নারীদের যেমন নিষেধ করা হয়েছিল, তেমনি তাদেরও মসজিদে আসা নিষেধ করে দিতেন।’ (সহি বুখারি, হাদিস : ৮৬৯) বলা বাহুল্য যে বর্তমান সময়ে নারীদের বেপর্দা চলাফেরা আগের চেয়ে কত গুণ বেড়েছে। তাই এখন নারীদের মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় কতটুকু প্রাসঙ্গিক?

নারীদের মসজিদে গমনে নিরুৎসাহিত করার এরকম আরও অসংখ্য হাদিস বর্ণিত আছে। এজন্যই মূলত মসজিদে নারীদের নামাজের আলাদা জায়গা রাখা হয় না। কিন্তু বাস্তব চিত্র অবলোকনের পর সচেতন আলেমরা বর্তমানে এক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতার কথা ভাবছেন। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলাম রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত প্রসিদ্ধ ইসলামী বিদ্যাপীঠ জামিয়া আরাবিয়া বাইতুস সালামের (বাইতুস সালাম মাদ্রাসা) মুহতামিম ও মেঘনা গ্রুপ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মুফতি মানসুর আহমাদের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘নারীরা স্বাভাবিক অবস্থায় শুধুমাত্র নামাজের উদ্দেশে ঘর ছেড়ে মসজিদে যাবেন না। হাদিসে স্বাভাবিক অবস্থায় ঘরকে নারীর সর্বোত্তম মসজিদ বলা হয়েছে। কিন্তু সফর বা বিশেষ প্রয়োজনে তারা বাইরে বেরুলে তাদের নামাজ যেন কাজা না হয়ে যায় সে উদ্দেশে হাসপাতাল, স্টেশন ও বড় রাস্তার পাশের মসজিদগুলোতে সীমিত পরিসরে হলেও নামাজ, ওজু ও টয়লেটের স্বতন্ত্র ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।

মুফতি মানসুর আহমাদের মতো অভিন্ন মত দিয়েছেন গাজীপুরের বাইতুল হিকমাহ একাডেমির পরিচালক ও বাইতুস শাফিক মসজিদের খতিব মুফতি জোবায়ের আহমাদও। তিনিও বিশেষত উপরোক্ত জায়গাগুলোতে নারীদের জন্য পৃথক শৌচাগারের ব্যবস্থা রাখার প্রতি তাগিদ করেছেন।

আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল- নারীরা মসজিদের শৌচাগার ব্যবহার করতে পারবেন কিনা? কিন্তু এর আগে উপরোক্ত বিষয়টি (নারীদের মসজিদে নামাজ) নিয়ে এত পর্যালোচনার কারণ হলো– মসজিদের শৌচাগার ব্যবহার করতে পারবেন শুধু মুসল্লিরা। মানে যারা নামাজ কিংবা যে কোনও ইবাদতের (তিলাওয়াত, জিকির, দোয়া ইত্যাদি) জন্য মসজিদে আসবেন, শুধু তারাই মসজিদের শৌচাগার ব্যবহার করতে পারবেন। নারীরাও যে মসজিদের মুসল্লি– সেটি সাব্যস্ত করতেই উপরোক্ত আলোচনা।

মসজিদের শৌচাগার ব্যবহার বিষয়ে ভারতের দারুল দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়ায় বলা হয়েছে- ‘যারা নামাজ, তিলাওয়াত, জিকির ও অন্যান্য ইবাদতের জন্য মসজিদে আসবেন, শুধু তাদের জন্যই মসজিদের শৌচাগার ও গোসলখানা ব্যবহার জায়েজ। যারা স্রেফ টয়লেট করার উদ্দেশে আসবেন, তারা মসজিদের শৌচাগার ও গোসলখানা ব্যবহার করতে পারবেন না। শরিয়তে এটি নিষিদ্ধ।’ তবে প্রয়োজন হলে যে কেউ তা ব্যবহার করতে পারবে। তবে গণশৌচাগারের মতো ব্যবহার করার সুযোগ নেই। (দারুল উলুম দেওবন্দের ওয়েবসাইট, সুওয়াল নম্বর : ৪১৬১৩)

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী; শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা।