যে ভালোবাসায় জান্নাত মেলে

ভালোবাসা মহান আল্লাহর এক অনন্য দান। প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে কমবেশি ভালোবাসা বিদ্যমান। ভালোবাসার কারণেই পৃথিবী টিকে আছে। এই ভালোবাসার এমন কিছু ক্ষেত্র আছে, যা মানুষকে জান্নাতের পথ দেখায় এবং দুনিয়া ও আখিরাতে প্রশান্তির কারণ হয়। একজন একনিষ্ঠ মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিৎ বৈধ ক্ষেত্রগুলোতে ভালোবাসা প্রদর্শন করা এবং অবৈধ ক্ষেত্রগুলোতে ভালোবাসা আদান-প্রদান থেকে বিরত থাকা। কারণ ভালোবাসারও দু’টি দিক আছে– বৈধ ও অবৈধ। এক্ষেত্রেও বৈধ দিকটি অবলম্বন করা বুদ্ধিমানের কাজ। নইলে দুনিয়া ও আখিরাতে আমাদের আফসোস ও শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে, যা থেকে আমরা সবাই বাঁচতে চাই।

ভালোবাসার ক্ষেত্রে অবৈধ দিকগুলোতে আল্লাহর অবাধ্যতা রয়েছে। আর একজন প্রকৃত মুসলিম কখনোই আল্লাহর অবাধ্য হবে না। কারণ আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর অবাধ্যতায় মানুষের কোনও আনুগত্য নেই। আনুগত্য শুধুমাত্র উত্তম কর্মে।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস: ৪৩৪০)

মা-বাবার প্রতি ভালোবাসা জান্নাতের পথ দেখায়

বৈধ ভালোবাসা প্রদর্শনের অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। যেমন মা-বাবার প্রতি ভালোবাসা। বাবা-মার প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন ও উত্তম আচরণের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহ্’ শব্দটিও বলো না, তাদেরকে ধমক দিও না এবং তাদের সঙ্গে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বলো। তাদের সামনে ভালোবাসার সঙ্গে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বল– হে প্রভু, তাদের উভয়ের প্রতি রহম করো, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৩-২৪)।

হাদিস শরিফেও বাবা-মাকে ভালোবাসার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এমনই একটি হাদিস হলো– ‘হজরত কা’ব ইবনে উজরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের বললেন, তোমরা মিম্বরের কাছে সমবেত হও। আমরা সবাই সেখানে উপস্থিত হলাম। যখন তিনি মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলেন, তখন বললেন, আমিন, যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন, বললেন, আমিন; যখন তিনি তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন, বললেন, আমিন।

হজরত কা’ব ইবনে উজরা (রা.) বলেন, যখন তিনি (মিম্বর থেকে) অবতরণ করলেন, আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আজ আমরা আপনাকে এমন কিছু কথা বলতে শুনেছি, যা ইতোপূর্বে কখনও শুনিনি।

উত্তরে তিনি বললেন, জিবরাইল (আ.) আমার নিকট আগমন করেছিলেন, যখন আমি প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলাম, তখন তিনি বললেন, ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি যে রমজান মাস পেলো, তবু তার গুনাহ মাফ হলো না। আমি বললাম, আমিন।

যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম, তখন বললেন, ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি, যার নিকট আপনার নাম উচ্চারিত হলো অথচ সে আপনার প্রতি দরুদ পাঠ করলো না। আমি বললাম, আমিন। যখন তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম, তখন বললেন, ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি, যে বৃদ্ধ পিতামাতা উভয়কে অথবা একজনকে পেলো অথচ তারা উভয় তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারলো না।

অর্থাৎ তাদের খেদমত-ভালোবাসার মাধ্যমে নিজেকে জান্নাতবাসী করতে পারলো না। আমি বললাম, আমিন। (মুসলিম শরিফ, হাদিস : ২৫৫১)

সন্তানের প্রতি ভালোবাসা

সন্তান জন্মের সংবাদে রাসুল (সা.) আনন্দিত হতেন। হজরত আবু রাফে (রা.) যখন রাসুল (সা.)-কে তার পুত্র ইবরাহিমের জন্মের সুসংবাদ দেন, তখন তিনি খুশি হয়ে তাকে একজন দাস বা সেবক দান করেন। প্রিয় নবী (সা.) তার সন্তান-সন্ততি ও পরিবারের সবাইকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। এ প্রসঙ্গে হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তুলনায় পরিবার-পরিজনের প্রতি অধিক স্নেহ-মমতা পোষণকারী আর কাউকে দেখিনি।’ (আল আদাবুল মুফরাদ: ৩৭৬)

স্বামী-স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা

পৃথিবীতে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক। সুখে-দুঃখে তারা দুজনে একসঙ্গে সারাটি জীবন কাটিয়ে দেয়। তাদের পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, আর (আল্লাহর) এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই চিন্তাশীলদের জন্য এতে নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ (সুরা রোম, আয়াত : আয়াত ২১) একইসঙ্গে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের ভালোবাসাকে ওলামায়ে কেরাম ইবাদত আখ্যা দিয়েছেন। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাদের স্ত্রীদের জন্য উত্তম। আর আমি আমার স্ত্রীদের জন্য তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি।’ (তিরমিজি)

বন্ধুত্ব ও বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা

ইসলামে বন্ধুত্ব স্থাপনে বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। সৎ ব্যক্তিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের নির্দেশনা দিয়ে হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘মানুষ তার বন্ধুর স্বভাবী হয়, তাই তাকে লক্ষ্য করা উচিত, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে।’ (তিরমিজি) কেননা বন্ধুত্ব নির্বাচনে ভুল হওয়ার কারণেও অনেকে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তি সেদিন নিজের দুই হাত দংশন করতে করতে বলবে, হায় দুর্ভাগ্য, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম!’ (সুরা ফুরকান, আয়াত : ২৮) এক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরাও যদি আল্লাহর অবাধ্যতা ও কুফরিতে লিপ্ত থাকে, তাহলে তাদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব রাখা যাবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা নিজ পিতা ও ভাইদের অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরকে ভালোবাসে।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ২৩)

বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা শুধু আল্লাহর জন্য

কোরআন ও সুন্নাহ অনুসারে একজন মুমিন মুসলমানের বন্ধু হবে আরেকজন মুমিন মুসলমান। যারা একে অন্যকে ভালোবাসবে এবং পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্ব রাখবে শুধু আল্লাহর জন্য। এখানে অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকবে না। প্রকৃত মুমিনের পরিচয় তুলে ধরে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসে, আর আল্লাহর জন্য কারো সঙ্গে বিদ্বেষ পোষণ করে এবং আল্লাহর জন্যই দান-খয়রাত করে আবার আল্লাহর জন্যই দান-খয়রাত থেকে বিরত থাকে, সে যেন ঈমান পূর্ণ করলো।’ (মিশকাত, হাদিস : ৩০) পবিত্র কোরআনে আল্লাহ-তায়ালা মুমিনকে মুমিনের বন্ধু আখ্যায়িত করেছেন এবং তাদের করণীয় কী সে সম্পর্কেও বলেছেন, ‘আর ইমানদার একে অপরের বন্ধু। তারা ভালো কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠিত করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও রাসুলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করে। তাদের ওপর আল্লাহতায়ালা অনুগ্রহ করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী সুকৌশলী। (সুরা তওবা, আয়াত : ৭১) আল্লাহ আমাদের সবাইকে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা সঠিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার তাওফিক দিন। আমিন।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী; শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা।