কেমন আছেন কোরআনের হাফেজরা?

হাফেজ গড়তে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করেন হিফজ বিভাগের শিক্ষকরা। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা তারা ছাত্রদের পেছনে নিবেদিত থাকেন। ক্লাসের সময় তো বটেই, বড় দু’টি বিশ্রামের সময়– সকাল ও রাতে ছাত্রদের ঘুমও হয় তাদের তত্ত্বাবধানে। বিকালে যখন খেলাধুলার সময়, তখনও হিফজখানার শিক্ষকরা ছাত্রদের দেখভাল করেন। যাতে ছোট বাচ্চারা পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য বজায় থাকে। 

দেশের প্রায় সব হিফজখানা-ই আবাসিক। ছোট ছোট ছাত্র বাবা-মাকে ছেড়ে এখানে অবস্থান করে। এজন্য হাফেজে কোরআন হিফজ বিভাগের শিক্ষকরা তাদের ‘মা-বাবা’ হয়ে ওঠেন। এক দম্পতির যদি একসঙ্গে দুজন ছোট বাচ্চা থাকে, তাহলে তারা বাচ্চাদের সামলাতে হিমশিম খান, কিন্তু হিফজ বিভাগের একজন শিক্ষক তার তত্ত্বাবধানে থাকা ১০-১৫ বছর বয়সের ২০-২৫ জন শিশু শিক্ষার্থীকে ‘বাবা-মায়ে’র আদরে আগলে রাখেন। কখনও ধৈর্যচ্যুতি ঘটে না, তা নয়; তবে এমনটি হলে আবার সামলে নেন নিজেকে।

যারা শুধু হাফেজে কোরআন নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাকমিল (মাস্টার্স সমমান) পর্যন্ত পড়েননি, তাদের বেশিরভাগই হিফজ বিভাগে শিক্ষকতা করেন। এর বাইরে মসজিদে আজান দেওয়া, রমজানে তারাবি পড়ানো ইত্যাদি সাময়িক ও তুলনামূলক কম সংখ্যক মানুষ এগুলো করেন। এ জন্য আজকের লেখা শুধুই হিফজ শিক্ষক হাফেজে কোরআনদের নিয়ে।

এমনই একজন হিফজ শিক্ষক হাফেজ মাহদি হাসান রাসেল। গত চার বছর ধরে হিফজ বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। এখন তার কর্মস্থল মাগুরার মোহাম্মদপুরের দারুস সুন্নাহ মাদ্রাসা। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম–হিফজ বিভাগে খেদমত (চাকরি) কেমন উপভোগ করছেন। ‘আনন্দ’র কথা জানালেও কিছুটা আক্ষেপ উঠে আসলো তার কণ্ঠে। বললেন, দ্বীনের খাতিরে ও নিজেকে গোনাহ থেকে বাঁচাতে হিফজখানায় চাকরি করছি। এখানে (দারুস সুন্নাহ মাদ্রাসা) আমি তুলনামূলক বেশ স্বস্তিতে আছি। কিন্তু দেশের হিফজ বিভাগের যে ২৪ ঘণ্টার রুটিন, তা পরিবর্তনযোগ্য।’ তার মতে, এমন রুটিনে হিফজ শিক্ষকরা একপ্রকার ‘বন্দি’।

হাফেজ মাহদি হাসানের বেতন ১০ হাজার টাকা। দেশের হিফজ বিভাগের বেতন স্কেল সাধারণত ১০-১২ হাজার টাকার ভেতরেই। এরচেয়ে বেশি আছে, তবে তা খুব কম জায়গায়।

মাদ্রাসায় যারা জামাত বিভাগে শিক্ষকতা করেন, তারা এর পাশাপাশি মসজিদে ইমামতিসহ বাইরের অন্যান্য টুকটাক কাজও করতে পারেন। তাদের বেতন সামান্য হলেও টুকিটাকি কাজ করে আরও যে টাকা তারা পান, তা দিয়ে মোটামুটিভাবে সংসার চালাতে পারেন, কিন্তু হিফজখানার শিক্ষকদের সে সুযোগ নেই। তারা অন্যের সন্তানদের গড়তে জীবন ব্যয় করে দিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু নিজেদের সন্তানদের ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না।

বেলায়েত হুসাইনএমন পরিস্থিতিতে হিফজখানার শিক্ষকদের দু’টি সুবিধার যেকোনও একটি দেওয়া যায়– এমন কথা আলোচনা হয়। তা হলো, হয়তো শিফট পদ্ধতির প্রচলন অথবা বেতন বৃদ্ধি। হাফেজ মাহদি হাসান রাসেল মনে করেন– দ্বিতীয় পদ্ধতিটি বাস্তবায়িত হলেই ভালো।

বেতন বৃদ্ধি হলে এখন যেভাবে হিফজ শিক্ষকরা মানসিকভাবে বন্দি থাকেন, ওটা থেকে রেহাই পাওয়া গেলো না। পক্ষান্তরে যদি শিফট পদ্ধতি চালু হয়–সেক্ষেত্রে তারা মানসিক ও শারীরিক উভয় দিক থেকেই প্রশান্তি লাভ করবেন এবং নিজের পরিবার, স্ত্রী ও সন্তানদেরও সময় দিতে পারবেন।

তবে প্রচলিত পদ্ধতিতে হিফজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের নানা সুবিধার কথাও স্বীকার করলেন হাফেজ মাহদি হাসান রাসেল। সুবিধাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো–শিক্ষার্থীরা একই শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে থাকলো। এতে তাদের পড়াশোনার উন্নতি ও অগ্রগতিতে উন্নতি হয় এবং এটা পরীক্ষিতও। মূলত শিক্ষার্থীদের সুবিধার্ধেই দেশব্যাপী এই পদ্ধতির অনুসরণ।

তবে শিফট পদ্ধতি চালু করলেও এই সুবিধা ধরে রাখা সম্ভব। সেক্ষেত্রে হাফেজ মাহদি হাসানের পরামর্শ হলো– শিফট পদ্ধতি চালু করার পর এই সুবিধা  (শিক্ষার্থীদের একই শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে রাখা) কায়েম রাখতে হলে শিক্ষকদের স্থায়ীভাবে নিয়োগ দিতে হবে। তার মতে– একজনের জায়গায় যদি শিফট পদ্ধতিতে দু’জন শিক্ষক পাঠদান করেন এবং তারা দু’জনেই স্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ছয় মাস একই হিফজ বিভাগে পড়াতে থাকেন, তাহলে তারা দু’জনেই সমানভাবে প্রতিটি ছাত্রের ব্যাপারে ধারণা লাভ করতে পারবেন। এতে শিক্ষার্থীদের উন্নতিতে তেমন অসুবিধা দেখেন না তিনি।

কিন্তু প্রাইভেট হিফজ মাদ্রাসাগুলোর কর্তৃপক্ষের যে মানসিকতা, তাতে শিক্ষকদের স্থায়ী নিয়োগের ব্যাপারটি বেশ কঠিন বলে মনে করেন হাফেজ মাহদি হাসান। তিনি জানান, হিফজ বিভাগে শিক্ষকদের স্থায়ীভাবে নিয়োগ না হওয়ার দু’টি কারণ– প্রথমত, তারা হিফজখানা পরিচালনায় স্বাধীনতা পান না। এক্ষেত্রে নিজেরাই অন্যত্র ‘ভালো’ কোনও জায়গায় চলে যান। দ্বিতীয়ত, বছরান্তে যখন বেতন বৃদ্ধির সময় আসে, তখন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ গড়িমসি করেন। এমনকি বেতন বৃদ্ধির কথা বললে, তারা এক বছর চাকরি করা ওই শিক্ষককে অব্যাহতি দিতেও পিছপা হন না। কারণ, ওই বেতনেই, ক্ষেত্র বিশেষ এর চেয়ে কমেও নতুন আরেকজন শিক্ষক তারা পেয়ে যাবেন নিশ্চিত।

খেয়াল করলে দেখা যায়, যে শিক্ষার্থীর হিফজ শেষ করতে দুই বছর লাগার কথা, শিক্ষক পরিবর্তনের কারণে, তার সময় ব্যয় হচ্ছে তিন বছর। এমনটি দেশের অনেক মাদ্রাসায়-ই ঘটছে। এখানে কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের কথা বিবেচনা না করে নিজেদের স্বার্থটাই দেখেন বলে মনে হয়। এজন্য মাহদি হাসান রাসেল বলেন, ‘একটি আদর্শ হিফজ বিভাগ গড়ে তুলতে হলে ছাত্র ও শিক্ষক উভয়ের ন্যায্য অধিকার সুষমভাবে বণ্টন করতে হবে। সেটা সম্ভব শিফট পদ্ধতিতে।’ তবে এটি তিনি এ বিষয়ে যারা জ্যেষ্ঠ, তাদের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিলেন।

কুমিল্লা সদরের পরিপাটি একটি মাদ্রাসা আন-নুর তাহফিজুল কোরআন ইনস্টিটিউট। এখানে পড়াতে সাধারণত একটি ছাত্রের অভিভাবকের মাসে ৬ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। মাদ্রাসাটির শিক্ষক হাফেজ মাওলানা আব্দুর রহমান। তিনি বেতন পান ১৫ হাজার টাকা। তিনিও প্রায় হাফেজ মাহদি হাসান রাসেলের মতামতেরই সমর্থন করলেন। মাদ্রাসায় থাকা-খাওয়ার পাশাপাশি এই বেতন পেয়ে তিনি তার অন্য হাফেজ বন্ধুদের তুলনায় কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করেন। তাকে প্রশ্ন করলাম– যদি আপনার দু’টি ‍উপযুক্ত সন্তান থাকতো এবং তাদেরকে আপনার এই মাদ্রাসায় কিংবা এরকম কোনও মাদ্রাসায় পড়াতেন, তাহলে তো তাদের পেছনে মোট ১২ হাজার টাকা ব্যয় হতো। তাহলে কিভাবে এই বেতনে চলতেন? তখন তিনিও তুলনামূলক বেশি বেতন পেয়েও হতাশাই ব্যক্ত করলেন। বললেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে বেতনটা আরেকটু বেশি হলে ভালো হতো। তবে আল্লাহর শুকরিয়া যে, তিনি আমার দ্বারা তার কোরআনের খেদমত নিচ্ছেন এবং এটিই (কোরআনের খেদমত) জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া বলে আমি মনে করি।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা