রমজানে যেভাবে পাপ মোচন হয়

রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের পবিত্র মাহে রমজানে সিয়াম সাধনায় ব্রত মুসলিম উম্মাহ। যে পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ইসলামের ভিত্তি দাঁড়িয়ে, তার একটি রোজা। নামাজের পরই রোজার স্থান। মানুষের দৈহিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির লক্ষে এ মাসের রোজা মুমিনের জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। সংযম, সহিষ্ণুতা ও আত্মশুদ্ধির অনন্য চেতনায় ভাস্বর মাহে রমজান।

এ মাসের প্রথম ১০ দিন রহমত, মধ্য ১০ দিন মাগফিরাত এবং শেষ দিনগুলো গুনাহ থেকে মুক্তি লাভের মধ্য দিয়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তির পয়গাম বয়ে আনে। অন্যান্য মাস অপেক্ষা রমজান মাসের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ এই যে, এ মাসেই বিশ্ব মানবতার মুক্তি সনদ পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে।

রমজান মুমিন জীবনে যেমন অফুরন্ত সাওয়াব ও তাকওয়া অর্জনের সুযোগ বয়ে আনে, তেমনি গুনাহ তথা পাপ মোচনেরও সর্বোত্তম মাস। যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহকে রাজি ও খুশি করার নিয়তে রোজা রাখবে, কোরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার এবং সাধ্যমতো দান-সদকা করবে, স্বভাবতই তিনি গুনাহ থেকে দূরে থাকবেন। আর রোজাদারগণ গুনাহ থেকে মুক্ত থেকেই বসে থাকেন না, বরং নাজাতের এই মাসে অতীতের কৃত গুনাহের জন্যও খালেস মনে আল্লাহর দরবারে বার বার তাওবা করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আর আল্লাহ তাআলা রমজানের বরকতে বান্দার তাওবা সহজেই কবুল করে তার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, “আর তিনিই (আল্লাহ) তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন এবং পাপগুলো ক্ষমা করে দেন”। (সুরা আশ শুরা, ১৫ আয়াত)।

হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রাযি.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন কেউ রমজানের প্রথম দিন রোজা রাখে, তখন তার আগের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। এমনিভাবে রমজান মাসের সমস্ত দিন চলতে থাকে এবং প্রতিদিন তার জন্য ৭০ হাজার ফেরেশতা সকালের নামাজ থেকে শুরু করে তাদের পর্দার অন্তরালে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার ক্ষমার জন্য দোয়া করতে থাকে’। (কানজুল উম্মাল, কিতাবুস সাওম)।

হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যখন রমজানের প্রথম রাত আসে তখন বিতাড়িত শয়তান ও দুষ্টু জিনদের শৃঙ্খলিত করা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয়। জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। আর একজন ঘোষক ঘোষণা দিতে থাকেন- ‘হে সৎকর্মশীল! অগ্রসর হও। হে অসৎকর্মশীল! থামো। মহান আল্লাহ রমজানের প্রতি রাতে অনেক মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস-১৬৪২)।

এই হাদিস থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, রমজানে রোজাদারের নেক কাজ বেশি হয়, গুনাহ কম হয় এবং অতীতের কৃত গুনাহ ক্ষমা করে জাহান্নাম থেকে আল্লাহ তাআলা তাকে মুক্ত করেন।

হাদিস শরীফে আরও ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে (তথা ঈমান ও ইখলাসের সাথে সওয়াবের আশায়) রমযানের রোজা রাখবে, তার অতীত গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (বুখারি, হাদিস-৩৮)।

মাহে রমজানে মুসলমানগণ কেন রোজা রাখেন? কেন তারা পানাহার ত্যাগ করেন? প্রচণ্ড গরমেও রোজাদার পানি পান করেন না। তীব্র ক্ষুধায়ও খাবার গ্রহণ করেন না। অথচ সবকিছু হাতের নাগালেই থাকে। চাইলেই সে যে কোনোকিছু গ্রহণ করতে পারে। এমনিভাবে রোজাদার আরও অনেক ধরনের কষ্ট করে। অনেক কিছু সয়ে নেয়। তারপর দিনভর রোজার উপবাস সত্ত্বেও অন্য যেকোনও সময়ের তুলনায় অধিক ইবাদত, তিলাওয়াত ও জিকির আজকার বেশি করেন, দান-সদকা করেন, গুনাহ থেকে দূরে থাকেন। তারপর দিনভর রোজা রেখে ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও রাতে তারাবিহ পড়েন। এসব কেন করেন? উত্তর পরিষ্কার—এগুলো করে থাকেন শুধু আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে। তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। তাঁর কাছ থেকে সওয়াব পাওয়া এবং অতীতের কৃত গোনাহ থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাত পাওয়ার আশায়। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াত এবং হাদিসে রাসুলের ভাষ্যে আল্লাহ তাআলা রোজাদারকে গুনাহ মাফ ও জান্নাত দানের প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়েছেন।

সুতরাং গুনাহ মোচনেরও সর্বোত্তম মাস হলো রমজান। রমজানের দিনগুলোতে আমরা যদি একান্তই আল্লাহর জন্য রোজা রাখি এবং নিজের দোষ-ত্রুটির ক্ষমা চাই, তাহলে আল্লাহ আমাদের অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে বান্দা আল্লাহর জন্য এক দিন রোজা রাখে আল্লাহ তাআলা তার চেহারা থেকে আগুনকে দূরে সরিয়ে দেন।’ (সহিহ মুসলিম)।

রমজানের শেষ ১০ দিন হলো নাজাত লাভের। এই দশদিনে ইতিকাফ ও লাইলাতুল কদর রয়েছে। এতে রোজাদারগণ বেশি বেশি ইবাদত, ইস্তিগফার ও গুনাহ থেকে পানাহ চেয়ে থাকেন। আর আল্লাহ তাআলা রোজাদারগণের ফরিয়াদ কবুল করে গুনাহ মাফ করেন।

যেমন লাইলাতুল কদরের ফজিলত প্রসঙ্গে কোরআন মাজিদে সুরাতুল ক্বদরে বর্ণিত আছে, এক হাজার মাস বা তিরাশি বছর চার মাস ইবাদতের চেয়ে সে এক রাতের ইবাদতের সাওয়াব অনেক বেশি। কত বেশি তার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। দুই গুণ বা তিন গুণ বা দশ গুণ বা একশ’ গুণও হতে পারে।

বুখারি ও মুসলিম শরিফের হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি শবে কদরে দণ্ডায়মান থাকে অর্থাৎ ইবাদত করে দ্বিনের হুকুম মনে করে এবং সাওয়াবের নিয়তে, তবে তার অতীতের কৃত সকল গুনাহ্ মাফ হয়ে যায়। (বাইহাক্বি শরিফ)।

অন্যদিকে ইতিকাফের ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিনের ইতিকাফ করলো, আল্লাহ পাক তার ও দোজখের মধ্যখানে এমন তিনটি পরিখা তৈরি করে দেবেন, যার একটি থেকে অপরটির দূরত্ব হবে পূর্ব ও পশ্চিমেরও বেশি।’ (তিরমিজি ও বায়হাকি)।

তাহলে লাগাতার ১০ দিন ইতিকাফকারী কতোটা ফজিলতের অধিকারী হবেন, তার পরিসীমা নেই। জাহান্নাম থেকে মুক্ত করার অপর অর্থ হলো তাকে সকল প্রকার গুনাহ থেকে মুক্ত করা হবে। এভাবেই মাহে রমজানের রোজা মুমিন জীবনে রহমত ও বরকত অর্জন এবং গোনাহ মুক্তির মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে নাজাত লাভের পুরস্কার বয়ে আনে।

লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা এবং খতি, তিস্তা গেট জামে মসজিদ, টংগী, গাজীপুর।