কোরবানি না দিয়ে ওই টাকা কি গরিবদের দান করা যাবে?

মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। এই ঈদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, পশু কোরবানি করা। ইসলামি শরিয়তে সামর্থ্যবানদের জন্য কোরবানি ওয়াজিব করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘কাজেই আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করুন এবং কোরবানি করুন।’ (সুরা কাউছার, আয়াত : ২)

আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল (সা.) ১০ বছর মদিনাতে ছিলেন ও কোরবানি দিয়েছেন’ (সুনানে তিরমিজি :১৫০৭)। অন্য একটি হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোরবানির ঈদের দিন মানুষের সব নেক আমলের মধ্যে সর্বাধিক প্রিয় আমল হলো- কোরবানি করা...।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১২৬) 

কোরবানির ফজিলত সম্পর্কিত আরও একাধিক আয়াত ও হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এ সত্ত্বেও অর্থনীতির বর্তমান নাজুক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে এবং বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অসহায়ত্বের কথা ভেবে সাধারণ মানুষের কেউ কেউ কোরবানি না করে ওই টাকা গরিবদের দান করার কথা বলে থাকেন। কিন্তু বাস্তবে শরিয়ত কি কোরবানি না দিয়ে ওই টাকা গরিবদের দেওয়ার অনুমতি দেয় কিনা, তা নিয়ে কথা হয় দেশের তিন জন বিশিষ্ট আলেমের সঙ্গে।

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ

এই তিন আলেমের একজন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর ড. এবিএম হিজবুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোরআন ও সুন্নাহ দ্বারা একথা প্রমাণিত যে, যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব তাকে কোরবানি আদায় করতেই হবে। কোরবানি আদায় না করে তিনি যদি ওই টাকা কোথাও সদকা করেন বা দান করেন, তাহলে সেটা দান হবে এবং দানের সওয়াবও পাবেন। কিন্তু কোরবানির যে দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত ছিল, সেটা আদায় হবে না। এটা স্পষ্ট।’

তবে কেউ যদি কোরবানি উপলক্ষে দান-সদকা আরও বিস্তৃত করতে চান, তাদেরও চমৎকার একটি পরামর্শ দিয়েছেন প্রবীণ এই ইসলামি স্কলার। তিনি বলেন, ‘তবে হ্যাঁ, কেউ যদি আর্তমানবতার সেবায় কোরবানির টাকা দিয়ে সহযোগিতা করতে চান, তাহলে তিনি কোরবানির ওই টাকা ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত এলাকা বা যুদ্ধ বিধ্বস্ত কাঙ্ক্ষিত স্থানে কোরবানির উদ্দেশ্যে প্রেরণ করবেন এবং তা দিয়ে পশু ক্রয় করে তার নামে কোরবানি করা হবে এবং পশুর মাংস ওই স্থানের গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।’

দেশের গ্রামে-গঞ্জে এমন অনেক জায়গায় অনেক মানুষ আছেন, যারা অর্থাভাবে কোরবানি করার সামর্থ্য রাখেন না এবং বছরে একবারও তাদের মাংস খাওয়ার সুযোগ ঘটে না। এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে কোরবানিও আদায় হবে, আবার গরিবদের সহায়তাও হয়ে যাবে বলে মনে করেন ড. এবিএম হিজবুল্লাহ। 

মুফতি মানসুর আহমাদ

বিষয়টি নিয়ে প্রায় অভিন্ন মত দেন রাজধানীর প্রসিদ্ধ ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া আরাবিয়া বাইতুস সালামের অধ্যক্ষ ও মেঘনা গ্রুপ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মুফতি মানসুর আহমাদ। বিস্তারিত বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘আমাদের জীবনে নানা প্রকার দুর্যোগ আসবে, এটা বাস্তবতা। আর দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যেরও প্রয়োজন। সামর্থ্যবানদের জন্য বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো ঈমানি, নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। কিন্তু কোরবানি না দিয়ে ওই টাকা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের দান করার চিন্তা সঠিক নয়। কারণ কোরবানি ইসলামের একটি প্রতীকী ইবাদত। এর রয়েছে স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য।’

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘দুর্যোগগ্রস্ত ও অভাবগ্রস্ত মানুষের সহযোগিতার জন্য ইসলাম অন্য দুটি আমল নির্দেশ করেছে। এক. নফল সদকা (দান)। আমাদের সমাজের বহু মানুষ ১০-২০ টাকা ফকির মিসকিনকে দান করে কিংবা মসজিদ-মাদরাসার দান বাক্সে ফেলে মনে করেন তিনি নফল সদকার হক আদায় করে ফেলেছেন। নফল সাদাকার পরিমাণ কী হবে এবং তা কতটা স্বপ্রণোদিত হয়ে আদায় করতে হবে, তা আমরা অনেকেই জানি না বা জানার চেষ্টা করি না। সাহাবায়ে কেরামের মতো আমরা যদি গুরুত্বের সঙ্গে নফল সদকার হক আদায় করতাম, তাহলে দুর্যোগগ্রস্তদের সংকট এর মাধ্যমে অনেকাংশে লাঘব করতে পারতাম। দুই. অসহায় মানুষের অর্থসংকট দূর করতে ইসলাম বিত্তশালীদের ওপর জাকাত ফরজ করেছে। বছরের শেষে একবার যাকাতযোগ্য সম্পদের আড়াই ভাগ আদায় করতে হবে। জাকাত কেবল রমজান মাসে ফরজ হয় না। অর্থবছর পূর্ণ হলে বছরের যে কোনও সময়ে জাকাত ফরজ হয়। ধরুন, এক কোটি টাকার মালিক একশত মুসলিমের এই মাসে জাকাতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। তাদের জাকাত বাবদ আদায়যোগ্য টাকার পরিমাণ হবে আড়াই কোটি টাকা। এই ১০০ জনের জাকাতের টাকা যদি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত লোকদের মাঝে বিতরণ করা হয়, তাহলে ভাবুন তো কতটা প্রভাব পড়বে?’

‘তাছাড়া জাকাত তো অগ্রীমও আদায় করা যায়। প্রয়োজনে এমনটাও করতে পারেন। প্রতিবছর ঈদুল আজহা এলে যারা কোরবানির টাকা দান করতে বলেন, তারা কিন্তু জাকাত আদায়ের ব্যাপারে কথা বলেন না’, যোগ করেন মুফতি মানসুর আহমাদ।

মুফতি মামুন আব্দুল্লাহ কাসেমী

কিন্তু পরিস্থিতি যদি এমন হয়- কোনও ব্যক্তি প্রতি বছর ওয়াজিব পরিমাণের চেয়ে বেশি সংখ্যক পশু কোরবানি করে থাকেন। কিন্তু হঠাৎ বন্যা কিংবা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলো। এ কারণে তিনি শুধু ওয়াজিব পরিমাণ কোরবানি করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন এবং অতিরিক্ত কোরবানির টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের দান করে দেবেন। সেক্ষেত্রে কী হবে- এ বিষয়ে মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ ঢাকার অধ্যক্ষ ও মিরপুরের চাঁদতারা জামে মসজিদের খতিব মুফতি মামুন আব্দুল্লাহ কাসেমী বলেন, ‘কোরবানির টাকা দিয়েই দান করতে হবে; কথাটি কেন আসছে? কোরবানি একটি ওয়াজিব ইবাদত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটির মাধ্যমে অভাবগ্রস্তদের পাশেও দাঁড়ানো যায়। যারা অতিরিক্ত কোরবানি করেন, তারা ওই টাকা অপচয় করছেন না; বরং ওই অতিরিক্ত কোরবানির মাংসও কোনও অসহায় গরিবকে দিয়ে তার মুখে হাসি ফোটানো হচ্ছে। তাহলে কেন একটি ভালো কাজের বদলে আরেকটি ভালো কাজের কথা আসছে? অথচ বলা উচিৎ, আমি অমুক অমুক (অনর্থক বিষয়) কাজের জন্য যে টাকাগুলো খরচ করবো ভেবেছিলাম, তা দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের দিয়ে দেবো।’ 

কোরবানি না দিয়ে ওই টাকা গরিবদের দান করা যাবে কিনা, এ বিষয়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া আল্লামা মোহাম্মদ ইউসুফ বানুরি টাউনের একটি বিশেষ ফতোয়া আছে। ওই ফতোয়ায় বলা হয়েছে, ‘যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব, তার জন্য কোরবানি না করে ওই টাকা গরিবদের দান করা সহি নয়। এরূপ করলে কোরবানি আদায় হবে না। (তবে কেউ যদি এমনটি করে), তাহলে সে দান করার সওয়াব পাবে বটে, কিন্তু ওয়াজিব আমল ত্যাগ করার কারণে তাকে গোনাহগার হতে হবে।’

ওই ফতোয়ায় আরও বলা হয়েছে, ‘কোরবানি একটি স্বতন্ত্র ইবাদত আর গরিবদের দান করা আরেকটি ইবাদত। এক ইবাদতের জন্য আরেক ইবাদত ছেড়ে দেওয়া সঠিক নয়। কোরবানির দিনগুলোতে সামর্থ্যবানের ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব আর সদকা তো সারা বছরই দেওয়া যায়।’

ফতোয়াটির শেষে একটি হাদিস জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যার বাংলা অর্থ এরকম- ‘(রাসুল সা:-এর বাণী) যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করবে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।’ (মুসনাদে আহমদ : ২/৩২১)

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী; শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা।