কোরবানির অর্থ হলো ত্যাগ। অর্থাৎ আল্লাহর দেওয়া ধনসম্পদ থেকে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে তাকওয়া অর্থাৎ আল্লাহর ভয় অর্জন করা। এ ছাড়াও কোরবানি শব্দটির বহুবিধ অর্থ রয়েছে। তবে আমরা অনেকেই সাধারণত ঈদুল আজহায় পশু জবাইকে কোরবানি বলে থাকি। আসলে কোরবানির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হলো আমাদের অর্জিত প্রিয় বস্তু আল্লাহর রাস্তায় বিসর্জন দেওয়া।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআনুল কারিমের সবচেয়ে ছোট সূরা আল কাউসারে সবচেয়ে অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমলের নির্দেশ দিয়ে বলেন, (হে নবী) আমি অবশ্যই তোমাকে (নেয়ামতে পরিপূর্ণ) কাউসার দান করেছি। অতএব (আমার স্মরণের জন্য) তুমি সালাত কায়েম করো এবং (আমারই উদ্দেশে) তুমি কোরবানি করো। (সূরা কাউসার : ১-৩)
ইসলামের পরিভাষায় কোরবানি হচ্ছে জিলহজ মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আজহার দিন থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কার লাভের আশায় পশু জবাই করার মাধ্যমে ত্যাগের অনুশীলন করা।
সূরা কাউসারে উল্লিখিত আয়াতের কোরবানি শব্দটির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে— রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অত্যধিক পরিমাণ নেয়ামত ও মর্যাদা দানের আশ্বাস ও নিশ্চয়তা প্রদানের পর পরবর্তী এ আয়াতে চক্রান্তকারীদের সব ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাসূলের প্রতি অনুগ্রহ, মর্যাদা ও সম্মান প্রদানের কথা ঘোষণা হয়েছে৷ বিনিময়ে আল্লাহর শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য আল্লাহর ইবাদত ও আল্লাহর উদ্দেশে ত্যাগ ও কোরবানির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নিষ্ঠা ও একাগ্রচিত্তে এবং নির্জনে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হতে বলা হয়েছে। আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি, দীনতা, হীনতা ও বিনয় প্রকাশের জন্য একাগ্রচিত্তে নামাজ আদায় করতে ও একমাত্র আল্লাহরই সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ত্যাগ ও কোরবানি করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহর রেজামন্দির উদ্দেশ্যে মোশরেকদের সব পদ্ধতি পরিহার করে, শিরকমুক্তভাবে পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে নামাজ আদায়, জবাই বা কোরবানির সময় গায়রুল্লাহর নামে, দেবদেবীর নামে বলিদান প্রথা বর্জন করে জীবজন্তু একমাত্র আল্লাহরই নামে কোরবানি ও জবাই করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর দুটো নির্দেশের পুনরুল্লেখের মাধ্যমে একমাত্র সব ইবাদত আল্লাহরই উদ্দেশে নিবেদিত করা এবং একমাত্র আল্লাহর নাম ছাড়া অন্য কারও নামে জবাই না করা, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অপর কারও নামে জবাই করা প্রাণী নিষিদ্ধ হওয়াই প্রমাণিত হয়েছে।
আয়াত থেকে এ মর্মেও এ শিক্ষাই আমরা খুঁজে পাই যে শিরকের সংমিশ্রণ ও প্রভাবমুক্ত অকৃত্রিম ও খালেস তাওহিদ একমাত্র ইসলামি জীবন দর্শনেই নিহিত রয়েছে। তাদের শুধু কল্পনা ও অনুভূতি নয়, শব্দ ও তত্ত্বের মধ্যেই নয়; বরং সমগ্র জীবনধারায় তাওহিদের মূর্ত প্রকাশ, জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে দিবালোকের মতো নির্ভেজাল ও অকৃত্রিম তাওহিদের অমলিন জ্যোতি একমাত্র দ্বীন ইসলামের মধ্যেই পাওয়া যায়।
দুনিয়াতে যারা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পাগলপারা তারা কখনও ত্যাগের মহিমা ছেড়ে ভোগের নেশায় মত্ত থাকতে পারে না। মুমিন মুসলমান কখনও হাসি-তামাশায় মশগুল হয়ে আল্লাহ তায়ালার ক্রোধের উদ্রেক করে শরিয়তের সীমা লঙ্ঘন করতে পারে না। তাই নিজের ব্যাপারে সে সতত সতর্কতা অবলম্বন করে। এই চেষ্টা-প্রচেষ্টাই কোরবানি তথা ত্যাগের অনুপম মহিমা।
আর যারা যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে চায় তারা কখনও ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে পাপের দরিয়ায় ডুব দিয়ে বিপথগামী হয় না। কখনও ভুল হয়ে গেলে তারা তাওবাহ-ইস্তেগফার করে প্রবৃত্তির করাল গ্রাস থেকে আল্লাহ তায়ালার প্রতি ফিরে আসে। আর এটিই হচ্ছে হৃদয়ের ত্যাগতিতিক্ষা তথা কোরবানি।
দুনিয়ার চাকচিক্য হলো নিছক মায়া-মরীচিকা। তাই এই ছলনায় মগ্ন না হয়ে আল্লাহ তায়ালা এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশিত পথে চলাই কেরবানি তথা ত্যাগের মূল শিক্ষা। এক কথায় বলা যায়, আল্লাহর রাস্তায় চলাই আসল কোরবানি।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত—তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হে উম্মাতে মুহাম্মাদি! আল্লাহর কসম, আমি যা জানি তা যদি তোমরা জানতে তাহলে তোমরা অবশ্যই হাসতে কম এবং কাঁদতে বেশি করে। (বুখারি-১০৪৪)
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।