কেমন ছিল সাব জেলে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার দুই ঈদ

 

শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াসেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (২০০৭ ও ২০০৮ সাল) দু’টি ঈদ কারাগারে কাটাতে হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদাকে। ওই সময় জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় এই সাব জেল স্থাপন করা হয়েছিল। ঈদের দিন ওই সাব জেলের সামনে নেতাকর্মীরা দুই নেত্রীকে শুভেচ্ছা জানাতে এলেও কাউকে তাদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। তবে বছরের অন্য সময় বাইরের কাউকে তাদের সঙ্গে দেখা করতে না দিলেও কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে দুই ঈদে পরিবারের সদস্যরা সাক্ষাৎ করেছেন।     

শেখ হাসিনার গ্রেফতারের তিন মাসের মাথায়  এবং খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের এক মাসের মাথায় ২০০৭ সালের ১৪ অক্টোবর দেশে পালিত হয় ঈদুল ফিতর। নিয়মিত রুটিনের মতোই জেল জীবনের প্রথম ঈদের দিনটিও সাদামাটাভাবেই শুরু হয়েছিল তাদের। ওইদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে তারা ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। এরপর নফল ইবাদত করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছেন। সকালে কারা কর্তৃপক্ষের  দেওয়া রুটি, সবজি, ডিম ও সেমাই দিয়ে নাস্তা করেন তারা। তবে, খেয়েছিলেন খুব অল্প পরিমাণ।  

সাব জেলে শেখ হাসিনার দুই ঈদ

সেনা সমর্থিত তত্ত্বাধায়ক সরকারের আমলের ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সুধাসদনের বাসা থেকে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার হন শেখ হাসিনা। রাখা হয় সংসদ ভবনে স্থাপিত অস্থায়ী কারাগারে। তিনি মুক্তিপান ২০০৮ সালের ১১ জুন। এই সময়ের মধ্যে দু’টি ঈদ তাকে কাটাতে হয় সাব জেলে। কারাগারে এই দু’টি ঈদই কেটেছে অন্য দশজন বন্দির মতো সাদামাটাভাবে। তাকে সরবরাহ করা হয় অন্য কয়েদিদের মতো জেলখানার ‘উন্নত‘ খাবার।  

শেখ হাসিনার গ্রেফতারের তিন মাসের মাথায় ২০০৭ সালের ১৪ অক্টোবর দেশে পালিত হয় ঈদুল ফিতর। দিনের কোনও এক সময় তৎকালীন আইজি প্রিজন জাকির হোসেন ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন তার সঙ্গে এবং স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নেন। ওইদিন দুই দফায় পাঁচ জন করে ১০ জন আত্মীয় তার সঙ্গে দেখা করেন। সাক্ষাতের সময় পরিবারের পক্ষ থেকে তার জন্য ঈদের নতুন কাপড়, উন্নত খাবার ও ফুল নিয়ে যাওয়া হয়।

কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শেখ হাসিনা (ফাইল ছবি)

সাক্ষাৎকারীদের একজন শেখ হাসিনার নাত-বউ আসমা রহমান ওইদিন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, শেখ হাসিনা ভালো আছেন। দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। পরিবারের পক্ষ থেকে নিয়ে যাওয়া পছন্দের খাবারগুলো সবার সামনেই খেয়েছিলেন। ছেলে-মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে না পেরে তিনি কষ্টে রয়েছেন।

পরে প্রধানমন্ত্রী মৌখিক আবেদনে ঈদের দুই দিন পর ১৬ অক্টোবর প্রবাসে থাকা ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সুযোগ পান। ১৬ জুলাই গ্রেফতার হওয়ার পর এটিই ছিল পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে প্রথম কথা বলার সুযোগ তার। বেলা ২টায় মেয়ে ও সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় ছেলের সঙ্গে ৫ মিনিট করে মোট ১০ মিনিট কথা বলেন। বিশেষ কারাগারের নিচ তলায় কারা কর্তৃপক্ষ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে তিনি কথা বলেন।

সুধাসদনের বাসা থেকে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার সময় (ফাইল ছবি)

 এ বিষয়ে তৎকালীন জিআইজি (প্রিজন) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, মৌখিক আবেদনের ভিত্তিতে মানবিক ও বিশেষ বিবেচনায় কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এতে তিনি টেলিফোনে ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি পুত্রবধূ, জামাতা ও নাতি-নাতনিদের খবর নেন।

ওই বছর ২১ ডিসেম্বর উদযাপিত কোরবানির ঈদেও শেখ হাসিনাকে কাটাতে হয় সাব জেলে। রমজানের সময় অসুস্থতার জন্য আসতে না পারলেও কোরবানির ঈদে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন তার স্বামী মরহুম ড. ওয়াজেদ মিয়া। এছাড়া চাচি বেগম জেবুন্নেছাও দেখা করেছেন। তারা বাসা থেকে রান্না করে খাবার নিয়ে এসেছিলেন।

দুই ঈদেই সাব জেলের সামনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা জড়ো হন। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মতিয়া চৌধুরী, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, লতিফ সিদ্দিকী, স্থপতি ইয়াফেস ওসমানসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী বিশেষ কারাগারে কাঁটাতারের বেস্টনির সামনে জড়ো হন। তারা নেত্রীর জন্য আনা ফুলের স্তবক কারা-পুলিশের মাধ্যমে পৌঁছে দেন।

সাব জেলে খালেদা জিয়ার দুই ঈদ

২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভোরে খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের বাসভবন থেকে গ্রেফতারের পর সোজা নিয়ে যাওয়া হয় সিএমএম আদালতে। আদালতে জামিন না মঞ্জুর হলে তাকে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত সাব জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই কারাগারে ৩৭২ দিন কাটানোর পর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তি পান। কারাবন্দি থাকাকালেই তার মায়ের মৃত্যু হয়।

খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার সময় (ফাইল ছবি)সাব জেলে থাকার সময় প্রথম পালিত হয় রোজার ঈদ, ২০০৭ সালের ১৪ অক্টোবর।  ওই দিন সাব জেলের নিয়মিত রুটিনের মতোই জেল জীবনের প্রথম ঈদের দিনটিও শুরু হয়েছিল। ওইদিন খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের স্ত্রী ও তাদের সন্তরা দেখা করেন। তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোও তখন জেলে ছিলেন।

দুই দফায় পাঁচ জন করে ১০ জন আত্মীয় তার সঙ্গে দেখা করেন। সাক্ষাতের সময় পরিবারের পক্ষ থেকে তার জন্য ঈদের নতুন কাপড়, উন্নত খাবার ও ফুল নিয়ে যাওয়া হয়।

এরপর ২০০৭ সালের ২১ ডিসেম্বর কোরবানির ঈদও ওই সাবজেলেই পালন করেন।

সাব জেলে থাকার সময় ২০০৮ সালের ১৮ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার মা বেগম তৈয়বা মজুমদার দিনাজপুরে নিজ বাসভবনে মারা যান। তার লাশ হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। পরদিন  (১৯ জানুয়ারি)  খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি পেয়ে মইনুল রোডের বাসায় গিয়ে মায়ের লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

সাব জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর হাত নেড়ে নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন খালেদা জিয়া

 এ বিষয়ে বিএনপির মিডিয়া উইং সদস্য শায়রুল কবির খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ দিন খালেদা জিয়ার সঙ্গে নেতাকর্মীরা খুব বেশি দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারেননি। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এরপর আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে যতটুকু পারা যায় সালাম দিয়েছিলাম।

কারাগারে শেখ হাসিনা  ও খালেদা জিয়ার ঈদ কাটানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ওই সময়ের জিআইজি প্রিজন ও বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দু’জনই ওই সময় সাব জেলে ছিলেন। তারা দু’জনই নিয়মিত নামাজ পড়তেন। ইবাদত করতেন। ঈদের দিনের শুরুটাও তাদের ইবাদতের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। ঈদের দিন অন্য বন্দিদের যে খাবার দেওয়া হয়, কারাগারের পক্ষ থেকে তাদের দু‘জনকেও সেই খাবার দেওয়া হয়। তবে, তাদের আত্মীয়-স্বজনদের ঈদের দিন দেখা করতে দেওয়া হয়েছিল। তারা তাদের জন্য খাবারও নিয়ে এসেছিলেন। দু’জনই সেই খাবারের সামান্য কিছু নিজেদের জন্য রেখে বাকিটা কারারক্ষীদের দিয়ে দিয়েছিলেন।’

এক প্রশ্নের জবাবে শামসুল হায়দার বলেন, ‘পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি, দুই নেত্রীকে সার্বিক সহযোগিতা করার। তারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হওয়ার পরও কোনও বাড়তি সুযোগ দেওয়া হয়নি। জেল কোড অনুযায়ী যে সুযোগ পাওয়ার সেটাই পেতেন। তবে, তারা আমাদের চাকরির সীমাবদ্ধতা জানতেন বলে কখনও বাড়তি সুবিধা চাননি। আমাদের ওপর চাপ আসতে পারে, এমন কোনও চাওয়া-পাওয়া তারা কখনও প্রকাশ করেননি।’