তবে তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে তারা বলছেন, ‘এমনিতেই তারেক রহমানের বিষয়ে একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি জনমনে রয়েছে। এরপর দলের সংকটময় মুহূর্তে বিদেশ থেকে দলের নেতৃত্ব দেওয়া কতটা সম্ভব হবে তা বলা মুশকিল।’
তাদের মতে, বিএনপি সাময়িক সমস্যায় পড়লেও দলটির নিশ্চিহ্ন হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। বরং খালেদা জিয়ার জেলে যাওয়ার সূত্রে তার ও বিএনপির প্রতি জনগণের সহানুভূতি আরও বৃদ্ধি পাবে। তারা মনে করেন, জেলে যাওয়ার বিষয়টি আগে থেকে আঁচ করতে পেরে দল কীভাবে চলবে, তার একটি দিকনির্দেশনা খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই দিয়ে গেছেন। আর সেই নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালিত হলে তারা নিশ্চয়ই টিকে থাকবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মতে, বিএনপির বিষয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করার সময় এখনও আসেনি। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার রায় নিয়ে আপিল বিভাগে যাওয়ার পরে নিশ্চিত হওয়া যাবে সংকট দীর্ঘ নাকি স্বল্পমেয়াদি হবে।’ তিনি মনে করেন, বিএনপির সামনে দুটি রাস্তা- একটি হলো নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করে আইনিভাবে মোকাবিলা করে দলীয় প্রধানকে মুক্ত করা এবং নির্বাচনমুখী হওয়া। এই পথেই বিএনপির লাভবান হওয়ার সুযোগ বেশি। আর দ্বিতীয় পথটি হচ্ছে, রাজপথের সংগ্রাম। এটা করতে গেলে তা সহিংস রূপ নেওয়ার আশঙ্কাই বেশি। এক্ষেত্রে তারা রাজনীতিতে যেমন পিছিয়ে পড়বে, তেমনি মামলা-মোকদ্দমার মুখোমুখি হতে হবে।
বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ায় বিএনপি সংকটে পড়েছে। তবে দলটির বড় জনসমর্থন রয়েছে, এজন্য তাদের সবার আগে নির্বাচনের ব্যাপারে ইতিবাচক হতে হবে। নির্বাচনে যাবো না, এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। ক্ষমতায় যেতে পারবে না নিশ্চিত হলেও তাদের উচিত হবে নির্বাচনে যাওয়া। কারণ, নির্বাচনে না গেলে তাদের টিকে থাকাটা কষ্টকর হবে।’
খালেদা জিয়ার অবস্থানকে ইতিবাচক মন্তব্য করে এই বিশ্লেষক বলেন, ‘গতকালকে (বৃহস্পতিবার) দেখলাম খালেদা জিয়া ঠাণ্ডামাথায় রায় মেনে নিলেন। কোনও উত্তাপ দেখালেন না। সবাইকে শান্ত থেকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে নির্দেশনা দিলেন। এটা সত্যিই ইতিবাচক। তার প্রতিফলন আজকে (শুক্রবার) ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মুখেও শুনলাম, ‘সহিংস নয়, অসহিংস আন্দোলন করবো।’ সত্যিই অহিংস আন্দোলনের বিরাট একটি শক্তি রয়েছে। তারা ২০১৪ সালে বাস পুড়িয়ে মানুষের বিরাগভাজন হয়েছে, এই উপলব্ধিটা সম্ভবত তাদের মধ্যে এসেছে।’
বিএনপির বিষয়ে কনক্লুসিভ ওয়েতে এই মুহূর্তে বলার সময় আসেনি, বলেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নিজামউদ্দিন আহমেদ। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপি বিভক্ত হবে, এমন আশঙ্কার সঙ্গেও একমত নন এই শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দল বিভক্ত হবে- আমার মতে এটা সম্ভব নয়। অতীতে বাংলাদেশে কখনও বিভক্তির রাজনীতি দাঁড় করানো যায়নি।’
খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দল কীভাবে চলবে তার একটি নির্দেশনা বিএনপিতে রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখছি জেলে যাওয়ার আগে তিনি একাধিক সভা করেছেন। সেখানে নিশ্চয়ই নির্দেশনা দিয়েছেন তার অনুপস্থিতিতে কী করে সংগঠন চলবে। আমার মনে হয়, বিদেশ থেকে নির্দেশ দিয়ে খুব বেশিদূর যাওয়ার সুযোগ কম। আমার মতে, এখানে একটি যৌথ নেতৃত্ব তৈরি হতে পারে।’
জেলে যাওয়ার কারণে খালেদা জিয়ার প্রতি জনগণের সহানুভূতি বাড়বে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আপনার একজন শত্রুও যদি কিছুটা বিপদে পড়ে তখন কেন যেন একটু হলেও মায়া লাগে। অতএব, অন্যরা কে কী মনে করছে তা জানি না, আমার মতে বিএনপির দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা কম।’
বিএনপির সংগঠন নিয়ে অনেকের নানা ধরনের বক্তব্য রয়েছে উল্লেখ করে নিজামউদ্দিন বলেন, ‘দল হিসেবে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা কম। তাদের তৃণমূলের সংগঠন নেই। আবার একেবারেই যে তা ঠিক, তাও নয়। যদি তাই হয় তাহলে তারা এতবার ক্ষমতায় এলো কী করে? এটা সত্য যে, বিএনপির শক্তি হলো অ্যান্টি আওয়ামী লীগ সেন্টিমেন্ট। আর এই সেন্টিমেন্ট যে এখনও নেই সেটা তো নয়। এই সেন্টিমেন্টই সব সময় বিএনপিকে ক্ষমতায় নেয়।’
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ে ছাত্রদল থেকে নেতৃত্ব উঠে আসার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আগে বিভিন্ন দল ছেড়ে আসা নেতারা বিএনপিতে নেতৃত্ব দিলেও গত ২০/৩০ বছরে তাদের নিজস্ব একটি নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে। তাদের সাংগঠনিক অবস্থান কিন্তু এরইমধ্যে তৈরি হয়েছে। তাদের একটি বড় ভোটব্যাংকও রয়েছে। হয়তো এটা আওয়ামী লীগের মতো নয়।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমান বলেন, ‘খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ায় বিএনপিকে এখন উচ্চ আদালতে যেতে হবে। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করতে হবে। বিএনপির প্রতি জনগণের সমর্থন আছে। খালেদা জিয়ার জেলে যাওয়ার ঘটনায় ওই সমর্থনে কোনও ঘাটতি হবে বলে মনে হয় না। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিটা এখনও বেগম জিয়ার পক্ষে আছে বলে আমার বিশ্বাস। কোনও ধরনের সহিংস রাজনীতিতে তারা উসকানি দেবে না।’
নির্বাচন বিষয়ে বিএনপিকে ইতিবাচক হতে হবে মন্তব্য করে বলেন, ‘একটা বিষয় ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী যেমন একটি ফ্যাক্টর, তেমনটি বিএনপিও একটি ফ্যাক্টর। বিএনপি চেয়ারপারসন এখন একটি দায়ে অভিযুক্ত হয়ে জেলে গেছেন। কিন্তু এই রায়টি চূড়ান্ত নয়। উচ্চ আদালত থেকে এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত আমরা বলতে পারবো না যে, খালেদা জিয়া সত্যিকার অর্থে অভিযুক্ত।’
তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা দলের দিক থেকে সঠিক অবস্থান বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘দলের সেকেন্ডম্যান হিসেবে তাকেই এই দায়িত্ব দেওয়ার কথা। তবে দেখার বিষয় যে, তিনি কতটা সঠিকভাবে দলকে পরিচালনা করতে পারেন । তিনি বিতর্কিত। তাকে নিয়ে নানা কথাবার্তা রয়েছে। এখন দেখতে হবে এই বিষয়গুলো কাটিয়ে উঠে কীভাবে দলের নেতৃত্ব দেন। সিনিয়র নেতাদের তিনি কীভাবে পরিচালনা করেন তা দেখতে হবে। দীর্ঘদিন দলের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকায় একটি গ্যাপ হয়েছে, সেটাও ঘুচাতে পারবেন কিনা দেখার বিষয়।’