এজেন্ট চিন্তায় বিএনপি

বিএনপিএকাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীবাছাই এখনও শুরু করেনি বিএনপি। এরইমধ্যে এই নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন চিন্তা যুক্ত হয়েছে দলটির নেতকর্মীদের মধ্যে। নেতারা মনে করছেন, নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রগুলোকে বিএনপির এজেন্টশূন্য করতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তাদের অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দলের এই উদ্দেশ্য হাসিল করতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সুনির্দিষ্টভাবে বিনেপির সক্রিয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে।  

বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিযোগ, গত ১ ও ৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে ‘রাজনৈতিক মামলা ও হয়রানি করা হবে না’ মর্মে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও গত ২০ দিনে পাঁচশতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

একটি সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী রাজনৈতিক জোটের  সক্রিয় নেতাকর্মী বিশেষ করে ভোটকেন্দ্রের আশেপাশের এলাকার নেতাকর্মীদের আইনের আওতায় আনার পরিকল্পনা অন্তত একমাস আগের।

ইতোমধ্যে সরকারের প্রভাবশালী দু’টি সংস্থা সারাদেশে ভোটকেন্দ্রের আশেপাশের এলাকার নেতাকর্মীদের নাম, তাদের বিরুদ্ধে বিগত দিনের মামলা, বর্তমান অবস্থা, সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা, সংখ্যালঘু ভোটারের সংখ্যা, আনুমানিক বিরোধী জোটের ভোট, সরকারি দলের ভোট, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নাম, আর্থিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থান, পেশীশক্তির ব্যবহারসহ নানা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের কিছু-কিছু জায়গায় বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আগের করা মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে আসামিদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

গত কয়েকদিনে বিএনপির গুলশানের কার্যালয়ে নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অনেকেই এ অভিযোগ করেছেন—তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা চলছে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে কয়েক দফায় আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করেছে বিএনপি।

বুধবার (২১ নভেম্বর) সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) মনোনয়নপ্রত্যাশী পাঁচজনসহ গ্রেফতার হওয়া ৫২৯ জন নেতাকর্মীর একটি তালিকা জমা দিয়েছে বিএনপি। দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মামলা ও তথ্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা সালাহ উদ্দিন খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল এই তালিকা জমা দেয় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) কাছে। এ নিয়ে তৃতীয় দফায় গ্রেফতার ও মামলাভুক্ত নেতাকর্মীদের তালিকা ইসিতে জমা দিলো  বিএনপি। গ্রেফতার হওয়া মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন, বাগেরহাট-৪ আসনে বিএনপি নেতা ইব্রাহিম হোসেন, গাইবান্ধা-২ আসনে দলের গ্রাম সরকার বিষয়ক সম্পাদক আনিসুজ্জামান খান বাবু, নেত্রকোনা সদর-২ আসনের ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি আনোয়ারুল হক রয়েল, ঢাকা মহানগর-১০ আসনের ঢাকা দক্ষিণ মহানগর দক্ষিণ যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শেখ রবিউল আলম রবি ও যশোর জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আবুবক্কর আবু।

বিএনপির নেতাকর্মীরা বলছেন, বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোর বিএনপির যেসব নেতাকর্মীর নাম পোলিং এজেন্টের তালিকায় ছিল, তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা মনে করছেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে যেভাবে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, এর ফলে নির্বাচনে পোলিং এজেন্ট দিতে সমস্যায় পড়তে হবে।

বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব নেতাকর্মী আগামী সংসদ নির্বাচনে ভোটের মাঠে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিতে পারেন এবং ভোট কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যেসব নেতাকর্মীকে এখন গ্রেফতার করা হচ্ছে। তাদের নামে থাকা পুরনো মামলাগুলোরও অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হচ্ছে। এই কারণে নেতাকর্মীরা আতঙ্কে রয়েছেন।

কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর-নিকলী থানার নেতা, সাবেক মেয়র এহসান কুপিয়ার বলেন, ‘আমি ছাত্রদল করি। এলাকায় এখনও গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত আছে। যেসব নেতাকর্মী আগামী নির্বাচনে প্রার্থীর এজেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এ রকম নেতাকর্মী গ্রেফতার করা হচ্ছে। তাদের নামে বিভিন্ন মামলার অভিযোগপত্র দিচ্ছে পুলিশ।’

ফেনী জেলা ছাত্রদলের কর্মী আহসান উল্লাহ বলেন, ‘এখন এলাকায় গ্রেফতার কমেছে। তবে নেতাকর্মীদের নামে থাকা পুরনো মামলাগুলোয় অভিযোগপত্র দেওয়া হচ্ছে। এসব মামলায় সেসব নেতারা রয়েছেন, যারা আগামী নির্বাচনের প্রার্থীর প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিতে পারেন এবং পোলিং এজেন্ট হতে পারেন। ফলে নির্বাচনের আগে গ্রেফতার করা হলে পোলিং এজেন্ট সংকটে পড়তে হবে বিএনপিকে।’

বিএনপির সাবেক সাংসদ আবুল কালাম আজাদের ব্যক্তিগত সহকারী আমিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনের কাছে অভিযোগ করেন, ‘গত ৬ নভেম্বর আবুল কালাম আজাদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনদিনের রিমান্ডশেষে এখন তিনি কাশিমপুর কারাগারে।’

যুবদল নেতা মাসুদ বলেন, ‘আমরা যা দেখছি তা যদি আইওয়াশ না হয়, তাহলে আগামী নির্বাচনে একটি রেজাল্ট আসবে। কারণ বিএনপির পক্ষে মানুষের নীরব সমর্থন আছে, তারা ভোট দিতে পারলে আমাদের পক্ষে ভালো ফল আসবে। তবে এখন পর্যন্ত পুলিশের যে আচরণ তাতে কোনও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার লক্ষণ নেই। কারণ এখনও বিএনপির প্রার্থী থেকে শুরু করে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত আছে। এভাবে গ্রেফতার চলতে থাকলে নির্বাচনে প্রার্থী এবং ভোটের দিন পোলিং এজেন্ট দেওয়ার লোকও খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে।’

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তরের ৩৯ নং ওয়ার্ড যুবদলের সহ-সভাপতি মানুন বলেন, ‘কোন কোন এলাকায় কারা কারা বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল করেন তাদের নামের তালিকা, ফোন নাম্বার পুলিশকে দিয়েছেন প্রতিটি ওয়ার্ড ও থানা আওয়ামী লীগের নেতারা। সেই তালিকা অনুযায়ী নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।  বিভিন্ন  পুরনো মামলায় তাদের নাম নতুন করে যোগ করা হচ্ছে। এর ফলে নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালানো এবং ভোটের দিন পোলিং এজেন্ট দিতে সমস্যা পড়তে হবে।’

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার চলছে। এখন এভাবে গ্রেফতার চললে তো নির্বাচনে দলীয় পোলিং এজেন্ট দিতে সমস্যা হবে এটাই স্বভাবিক।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় দেশবাসী দেখেছে, কীভাবে বিএনপির পোলিং এজেন্টদের গ্রেফতার করা হয়েছে।’ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার সেই রকম কোনও অশুভ পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে কিনা, তা নিয়ে বিএনপির সন্দেহ রয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।