বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা ও দলটির শুভানুধ্যায়ীদের পর্যবেক্ষণ—দীর্ঘ ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা, অনেক দিনের নেতৃত্বের জট, স্বপ্নভঙ্গের কারণেই প্রার্থীদের সংখ্যা বেড়েছে। আর এই সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে কেউই লালিত স্বপ্ন চোখের সামনেই ভেঙে পড়ুক, এমনটি চাইছেন না। মূলত এ থেকেই সংঘর্ষের উদ্ভব। প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে ফেলার জন্য এই হিংসাত্মক কৌশল অবলম্বন করছেন কেউ কেউ। যদিও কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড কঠোরভাবেই বার্তা দিয়ে রেখেছে—দলীয় মনোনয়নের বাইরে গিয়ে কেউ নির্বাচনে আগ্রহ দেখালে কঠোরভাবে তা দমন করা হবে।
বুধবার (২৮ নভেম্বর) মনোনয়নপত্র ফরম জমা দেওয়ার শেষ সময় পার হয়েছে। এখন চলবে যাচাই-বাছাই। ইতোমধ্যে দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্তি নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি প্রার্থীদের মধ্যে আন্তঃকোন্দলের ঘটনা ঘটেছে। মুন্সীগঞ্জে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী মিজানুর রহমান সিনহা ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আলী আজগর রিপন মল্লিকের পক্ষের লোকজন সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে বুধবার। এদিন দুপক্ষের প্রায় ১০ জন নেতাকর্মীর আহত হওয়ার খবর এসেছে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে।
জানা গেছে, পিরোজপুর-ভাণ্ডারিয়া আসনে থানা বিএনপির সভাপতি আহমেদ সোহেল মনজুর সুমনকেও দলীয় মনোনয়ন দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলেও মুস্তাফিজুর রহমান ইরানকে পাওয়া যায়নি। একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে পটুয়াখালী-৩ (দশমিনা- গলাচিপা) আসনে। সেখানে আওয়ামী লীগ থেকে সদ্য যোগ দেওয়া গোলাম মাওলা রনিকে মনোনয়নের দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়ভাবে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে। (গোলাম মাওলা রনির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে স্থানীয় বিএনপি)।
যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটির দুই নেতা, ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একাধিক নেতার ভাষ্য—গোলাম মাওলা রনি বিএনপিতে কেবল সংসদে যেতেই এসেছেন। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পরই তিনি বিএনপিতে আসেন। এতে দলে ও দলের বাইরে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
স্থায়ী কমিটির দুই সদস্যের বক্তব্য—গোলাম মাওলা রনির যোগদানের ঘটনা স্থায়ী কমিটির তিন নেতার আগ্রহে হয়েছে।
দলের অভ্যন্তরে কোন্দলের পাশাপাশি ভিন্ন দলের প্রার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। অভিযোগ আছে— সিলেটে ডিসি অফিসের সামনে বিকল্পধারার প্রেসিডিয়াম সদস্য শমসের মবিন চৌধুরীর গাড়িতে লাথি মেরেছেন স্থানীয় বিএনপির অতি উৎসাহী নেতাকর্মীরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পেশিশক্তির এই রাজনৈতিক কৌশল পরিহার না করলে দেশীয় রাজনীতি থেকে সহিংসতা সহজেই দূর করা সম্ভব না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক অধ্যাপক বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উত্তরণের পথ দেখছি না। তারা পক্ষপাতদুষ্টতার একাধিক প্রার্থী দিয়েছে। মনোনয়নপত্র বাতিল করে দিতে পারে। তবু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভালো লোকের পক্ষেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে গুণগত পরিবর্তন আনতে চাইলে ভালো প্রার্থী দিতে হবে। একাধিক দিয়েছে, কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। অনেকে চরমভাবে বিতর্কিত। গুণগত পরিবর্তন আনতে চাই, সেরকম ব্যক্তিদের মনোনয়ন দিতে হবে।’
বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ এক্ষেত্রে খুঁজে পেয়েছেন ইতিবাচক দিক। তাদের দাবি—দীর্ঘদিন পর জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়েই নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন চিন্তার সঞ্চার ঘটানো সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে যেহেতু নির্বাচনকে আন্দোলনের অংশ হিসেবেই নেওয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা হওয়ার বিষয়টিকে বড় করে দেখছেন কোনও কোনও নেতা।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। মনোনয়নের প্রতিযোগিতা এখানে থাকবেই। দীর্ঘদিন পর নির্বাচন। নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হয়েছে। তবে সতর্ক থাকতে হবে—সরকারের লোকজন যেন দলে কোনও ষড়যন্ত্র প্রবেশ করাতে না পারে।’
ছাত্রদল নেতা সায়মন কবির শাওন মনে করেন, ‘পুরো দল হাইকমান্ডের নির্দেশে ঐক্যবদ্ধ আছে। আর নির্বাচনের সময় সব দলেই বিরোধ হয়। এটা স্বাভাবিক রাজনৈতিক আচরণ, বরং সরকারি দলের লোকজন সংঘর্ষে জড়িয়েছে। বিএনপি ঐক্যবদ্ধ আছে।’
মনোনয়ন প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে আগামী সাত দিনের মধ্যে অবশ্য বিএনপির দলীয় এই বিরোধ চূড়ান্ত রূপ নিতে পারে জোটে ও ফ্রন্টেও। এই মুহূর্ত কিছু কিছু স্থানে জোট ও ফ্রন্টের নেতা, কোনও স্থানে দলীয় জোট ও ফ্রন্টের আগ্রহীরা মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন। সে কারণে বিশ্লেষকরা মনে করেন—আগামী দিনে মনোনয়নকেন্দ্রিক বিরোধ মিটিয়ে নির্বাচনি প্রচারণায় নামতে হবে বিএনপিসহ বাকিদের। ইতোমধ্যে অবশ্য ২০ দলীয় জোটের কোনও কোনও কেন্দ্রীয় নেতাকে অবাঞ্ছিত করা হয়েছে। ফলে আসনের তাপ এখন উত্তাপ ছড়াবে দলের কেন্দ্রেও। ইতোমধ্যে হবিগঞ্জ-৪ আসনে জোটের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের। সেখানে তার প্রতিদ্বন্দ্বী আছেন সৈয়দ ফয়সাল। এই আসনে জোটগতভাবে এগিয়ে আছেন আহমদ আবদুল কাদের। তবে যদি বিএনপি জোটগত মনোনয়ন না দেয়, সেক্ষেত্রে এই আসনে বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নিতে পারে। এমনকি আসন সমঝোতা না হলে খেলাফত মজলিস পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে, এমন ইঙ্গিত আছে দলটির একাধিক প্রভাবশালী নেতার।
মনোনয়ন নিয়ে বিরোধ হলেও কিছু কিছু জায়গায় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সম্প্রীতির বিষয়টি ওঠে এসেছে। এমন একটি ঘটনা চট্টগ্রামের— আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের এম এ লতিফের শুভেচ্ছা বিনিময় হয়েছে। তেমনি আছে অভ্যন্তরীণ নেতাদের মধ্যেও সৌহার্দ্যের ছটা। বুধবার নেত্রকোনায় বিএনপির দুই মনোনয়ন প্রত্যাশী একসঙ্গে ফরম জমা দিয়েছেন, একইভাবে মানুষের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিমিয় পর্বও সেরেছেন একত্রে।
শায়রুল কবির খান বলেন, ‘তারা দুজনেই এলাকায় নজির স্থাপন করেছেন। দুজনেই প্রার্থী হতে আগ্রহী। তাদের মধ্যে যিনি দলীয় মনোনয়ন পাবেন, তিনি নির্বাচন করবেন। আরেকজন দলের পক্ষে কাজ করবেন।’