সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন পেতে বাধা নেই হিজড়াদের

সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচনে অংশ নিতে চান হিজড়ারাও

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) পাঁচজন। হিজড়ারা সংরক্ষিত আসনে মনোনীত হতে পারবেন কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বলে উল্লেখ করে তারা বলছেন, ‘আমরা রূপান্তরিত নারী হিসেবে জীবন-যাপন করি। কাজেই আমাদের অধিকার আছে।’ নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলছে, এখন পর্যন্ত যেসব হিজড়া নারী হিসেবে ভোটার তালিকায় নিবন্ধিত হয়েছেন তারা এই সুযোগটি নিতে পারবেন।

ইসি’র অতিরিক্ত সচিব মোখলেসুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভোটার নিবন্ধনের সময় নারী হিসেবে নিবন্ধিত হয়ে থাকলে সংরক্ষিত আসনে ভোট করতে আইনি কোনও বাধা নেই। ইসি গত জুলাইয়ে হিজড়াদের ভোটার হিসেবে নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এখনও এই কার্যক্রম শুরু হয়নি। সে হিসেবে এখনও কেউ তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে নিবন্ধিত হয়নি।’

ইসি ২০১৮ সালের ১০ জুলাই হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে ভোটার তালিকায় নিবন্ধন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সময় ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জানিয়েছিলেন, ‘নতুন করে যখন ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হবে তখন হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে নিবন্ধন করা হবে। তবে বিদ্যমান তালিকায় হিজড়ারা যে লিঙ্গের পরিচয়ে ভোটার হয়েছেন তাদেরটা সেভাবেই থাকবে। এক্ষেত্রে কমিশন নিজে থেকে কিছু করবে না। তবে কেউ আবেদন করে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে তথ্য সংশোধন করতে চাইলে, তা করা হবে।’

প্রসঙ্গত, ইসি’র ওই সিদ্ধান্তের পর থেকে এখনও কোনও ভোটার তালিকা হালনাগাদ করেনি। এছাড়া হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার জন্য ভোটার নিবন্ধন ফরমে যে প্রয়োজনীয় সংশোধনের দরকার রয়েছে সেটাও কমিশন এখনও শেষ করতে পারেনি।

কমিশন সূত্রে জানা গেছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় মনোনয়ন ফরমে তৃতীয় লিঙ্গ রাখার বিধান যুক্ত করার চিন্তা করা হয়েছিল। কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গের জন্য আলাদা কোনও ভোটার তালিকা না থাকায় কমিশন সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। এর আগে সরকারের মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি গেজেট প্রকাশ করা হয়।

মনোনয়ন প্রত্যাশীরা জানিয়েছেন, তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতিই তাদের দায়বদ্ধতা বাড়িয়েছে। এজন্যই  একাদশ সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দৃশ্যমান প্রতিনিধিত্ব থাকা জরুরি।

তারা বলছেন, ২০১৩ সালে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে তাদেরকে যে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে সেটি তাদের দায়বদ্ধতা বাড়িয়েছে। তবে কেবল কমিউনিটির নয়, অন্য সব নাগরিকের জন্যই প্রতিনিধিত্বশীলতা নিয়ে হাজির হতে চান ময়ূরীসহ তার ৫ সহযোদ্ধা।

কী বিষয়ে কাজ করা জরুরি সে বিষয়ে বলতে গিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশী পার্বতী বলেন, ‘অবশ্যই কমিউনিটির সদস্যদের নিয়ে কাজ করবো। তবে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলে আমি এলাকার সব নারী পুরুষ তৃতীয় লিঙ্গের যারা আছেন সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চাই। সমাজে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নে কাজ করতে চাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমরা যে অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছি সেসব সমাধানের চেষ্টা করবো। নিজেকে একজন মেয়ে হিসেবেই দাবি করেছি সবসময়। এর আগে কোনও সুযোগ ছিল না, স্বীকৃতি ছিল না। এরপরও অনেকে ভাবছেন আমরা কীভাবে এই নির্বাচন করবো? কিন্তু আইনেই সেটি সম্ভব।’

মনোনয়ন প্রত্যাশী নাদিরা এর আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচন করেছেন। তিনি বলেন, ‘এই প্রথম আমরা সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য নমিনেশন কিনেছি। আমরা এর আগে কখনোই তৃতীয় লিঙ্গের কেউ মনোনয়ন চায়নি। আমরা ৫ জন এবার মনোনয়ন ফরম কিনেছি।’

কোন আগ্রহের জায়গা থেকে সংসদ সদস্য হতে চান-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কমিউনিটির অবহেলিত, বঞ্চিত সদস্যদের নিয়ে কাজ করতে চাই। তৃতীয় লিঙ্গের কেউ ভালো জায়গা, সম্মানের জায়গায় যেতে পারে না। তাদের তো ট্র্যাকে আনতে হবে। ২০১৩ সালে যেহেতু স্বীকৃতি পেয়েছি, প্রধানমন্ত্রী আমাদের মা। উনি আমাদের সামনের দিকে আনার যে চেষ্টা করছেন। তারই অংশ হিসেবে আমরা মনোনয়ন চাইতে পেরেছি। আমাদের কমিউনিটির মানুষদের মানবাধিকার যেন লঙ্ঘন না হয় আমি সেদিকে নজর দিতে চাই।’

মনোনয়ন প্রত্যাশী ময়ূরী নারী হিসেবে মনোনয়ন নিয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের কমিউনিটির সিস্টেম নাই। আমাদের অনেক হয়রানি করা হয়।  পড়ালেখা, কাজের ক্ষেত্রে আমাদের অধিকারের জন্য যেন একটা দিকনির্দেশনা থাকে সেজন্য কাজ করতে চাই। আমি ১৫ বছর যাবত কমিউনিটির ভেতরে কাজ করছি। আমার ইচ্ছে, বাংলাদেশে হিজড়াদের সম্পর্কে কেউ জানেই না তাই তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্যই আমি এই উদ্যোগ নিয়েছি।’