নাখোশ রওশনপন্থীরা, এরশাদের নতুন সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়

রওশন এরশাদ ও এইচএম এরশাদ

দেড় মাসের ব্যবধানে ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরকে দ্বিতীয় দফায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার এই ‘হঠাৎ’ সিদ্ধান্তে নাখোশ রওশনপন্থীরা। তবে অতীতের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এ সিদ্ধান্তকেই শেষ বলে মানছেন না তারা। তাদের আশা, আবারও এরশাদের মতের পরিবর্তন হবে। জিএম কাদেরকে সরিয়ে তাদের পক্ষভুক্ত কাউকে দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসাবেন দলটির চেয়ারম্যান। তবে, জাতীয় পার্টির মধ্যপন্থীরা বলছেন ভিন্ন কথা। বয়সের ভারে ন্যুব্জ ও শারীরিকভাবে অসুস্থ এরশাদ নতুন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে আর চিন্তা করবেন কিনা তা নিয়ে তাদের সংশয় রয়েছে।

অতীতের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে জাতীয় পার্টির রওশনপন্থী নেতারা বলছেন, এরশাদ সাহেব কখনোই নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেননি। বিভিন্ন ঘটনা ও সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের দেওয়া সিদ্ধান্ত নিজেই পরিবর্তন করেছেন। সেই সূত্রে জিএম কাদেরকে নিয়ে এরশাদ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেখানে পরিবর্তন এলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অবশ্য যদি কোনও কারণে তিনি নতুন করে কোনও সিদ্ধান্ত দিতে না পারেন, সেই ক্ষেত্রে তাদের দলের আগামী কাউন্সিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

রওশনপন্থীদের দাবি, দলে তাদের অবস্থান দৃঢ় এবং নেতাকর্মীর বেশিরভাগই তাদের সঙ্গে রয়েছেন। ফলে কাউন্সিল হলে জিএম কাদেরের পক্ষে চেয়ারম্যান হওয়া সম্ভব নয়।

জিএম কাদেরের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার বিষয়ে জানতে চাইলে রওশনপন্থী জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের খটকা লেগেছে এত রাতে কেন কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার ঘোষণা দিতে হবে। স্যার (এরশাদ) চাইলে এটা সকালবেলাও করতে পারতেন। উনাকে আমরা দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছি। সেই ক্ষমতাবলে তিনি জিএম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেছেন। তাছাড়া স্যার এখনও তো চেয়ারম্যান আছেন, বিরোধীদলীয় নেতা আছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় পার্টির এই সংসদ সদস্য বলেন, জিএম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা দলের জন্য ভালো নাকি মন্দ তা সময় বলে দেবে। কারণ, দলের ৩২ বছরের ইতিহাসে অনেক মহাসচিব বদল হয়েছে, যা অন্য কোনও দলে হয়নি। এটাও তারই ধারাবাহিকতা।

তিনি আরও বলেন, আমাদের কাউন্সিলের দুই বছর হয়ে গেছে। এই বছরের শেষের দিকে আরেকটা কাউন্সিল হওয়ার কথা রয়েছে।

কাউন্সিলের মাধ্যমে জিএম কাদেরের চেয়ারম্যান হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু জানতে চাইলে ফখরুল ইমাম বলেন, এটা তো বলা মুশকিল। কারণ, আমাদের দলে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি অনেকে আছেন। স্যার যখন কাউন্সিলে চেয়ারম্যানের পদ উন্মুক্ত করে দেবেন, তখন তো অনেকে চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য প্রার্থী হবেন। দলের প্রায় ১৪ হাজার কাউন্সিলর আছেন। তারা কাকে ভোট দিয়ে চেয়ারম্যান করবেন সেটা তো এখন বলা মুশকিল।

রওশনপন্থী দলটির আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএম ফয়সাল চিশতী বলেন, এই বিষয় নিয়ে মন্তব্য করার এখনও সময় আসেনি। তাহলে আপনারা কি জিএম কাদেরকে মেনে নিয়েছেন জানতে চাইলে চিশতী বলেন, এই বিষয় নিয়ে মন্তব্য করলে তো বিপদ। সুতরাং এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাই না।

জিএম কাদেরের ঘনিষ্ঠ জাতীয় পার্টির একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদ সবাইকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেও অনেকে তা অমান্য করেন। কিন্তু, জিএম কাদের তার নির্দেশমতো মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন এবং নির্বাচন করেননি। সে কারণে এখন তাকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে আমাদের নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পুরস্কার দিয়েছেন বলে মনে করি।

গত জানুয়ারি মাসে জিএম কাদেরকে নিজের অবর্তমানে দলের দায়িত্ব পালনের সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর গত ২২ মার্চ আবারও তাকে সরিয়ে দেন এরশাদ। একইসঙ্গে সংসদের উপনেতার পদ থেকেও তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনা তুলে ধরে ওই প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, ওই সময় দলের একটি অংশ এরশাদ সাহেবকে ভুল বুঝিয়ে ওই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিলেন। পরে ভুল বুঝতে পেরে তাকে কো-চেয়ারম্যানের পদ ফেরত দেন। এখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে আস্থাকে আরও দৃঢ় করেছেন।

জাপার একটি সূত্র জানায়, এরশাদের অবর্তমানে জিএম কাদেরকে যারা চেয়ার‌ম্যান হিসেবে মেনে নিতে চাইবেন তারা সংখ্যায় খুব বেশি নন। সরকারপক্ষ তাদেরকে যদি সহযোগিতা করে তাহলে শেষ পর্যন্ত তিনি এই দলের চেয়ারম্যান থাকবেন।

জিএম কাদেরকে জাপা’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ার‌ম্যান করার যে ঘোষণা দিয়েছেন এরশাদ, সেই সিদ্ধান্ত আবার পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই বিষয়ে তো বলা মুশকিল। এর আগেও জিএম কাদের এই দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে স্যার (এরশাদ) তাকে সরিয়ে দেন। এখন আবার সেই দায়িত্ব দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘স্যার ব্যক্তিগতভাবে খুবই অসুস্থ। আমি দু’দিন আগেও স্যারকে দেখে এসেছি। তবে শারীরিকভাবে অসুস্থ হলেও স্মৃতিশক্তি নিয়ে কোনও ঝামেলা নেই। উনার মস্তিষ্ক খুবই ভালোভাবে কাজ করছে। তিনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আশা করি সেখানে অটল থাকবেন। কারণ, বারে বারে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন দলের জন্য ভালো হয় না। অবশ্য পরিস্থিতির কারণে অনেক সময় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয়।’

এরশাদের এই সিদ্ধান্তে রওশনপন্থীরা যে মনঃক্ষুণ্ন তা স্বীকার করে মাসুদ উদ্দিন বলেন, সবাই পার্টির চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য। কারও কোনও আপত্তি থাকলেও পার্টির স্বার্থে তা ভুলে গিয়ে চেয়ারম্যানের দেওয়া সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া ভালো হবে। আর কাউন্সিলে কী হবে সেটা এখন বলা সম্ভব নয়।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জাতীয় পার্টি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দল। উনি যতদিন থাকবেন তার সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিতে বাধ্য। সেটাই হলো দল। এটা নিয়ে বাইরে কথা বলার কিছু নেই। গত ৪ মে রাত ১১টায় এক সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ ঘোষণা দেন, আমার অসুস্থতার জন্য পার্টির কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিঘ্ন হচ্ছে। পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত জিএম কাদের পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন।’