বিরোধী দলগুলোর বাইরে সরকারঘেঁষা অন্তত দুটি জোট আছে, যারা এখন অকার্যকর। ঘরোয়াভাবে কর্মসূচি পালন করলেও মাঠে-ঘাটে বা রাজপথে নিষ্ক্রিয় রয়েছে বি চৌধুরীর যুক্তফ্রন্ট। কোনও কার্যক্রম নেই জিএম কাদেরের জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত জাতীয় জোটের।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৩৯টি। গত নির্বাচনের সময় প্রায় ১৪টি দল সক্রিয় ছিল। বিদ্যমান জোটগুলোতে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনের সংখ্যা প্রায় ১৫২টি। জোটগুলো হচ্ছে— ১৪ দলীয় জোট, ২০ দলীয় জোট, সম্মিলিত জাতীয় জোট, গণতান্ত্রিক বাম জোট, যুক্তফ্রন্ট, জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স, জাতীয় ইসলামী মহাজোট, বাংলাদেশ জাতীয় জোট (বিএনএ), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-এনডিএফ, গণতান্ত্রিক জোট, প্রগতিশীল জোট, হুদা জোট ও বিজেপি।
‘বিএনপির কারণে ঐক্যফ্রন্ট নিষ্ক্রিয়’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতারা অভিযোগ করেছেন— একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফলের পর দুই জোটের অন্যতম প্রধান শরিক বিএনপি কার্যত ভেঙে পড়েছে। ঐক্যফ্রন্টকে কেন্দ্র করে দলটিতে তিনটি ধারা সৃষ্টি হয়েছে। এই মুহূর্তে দলটির প্রধান চিন্তা কারাগারে থাকা দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি। জোট ও ফ্রন্টের নেতারা ধারণা করছেন— সরকার আইনি পথে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিরুদ্ধে। সরকারের তরফে তার প্যারোল নিয়ে নমনীয়তা রয়েছে। এ কারণে কোনও আন্দোলনে না গিয়ে খালেদা জিয়াকে সমঝোতার মধ্যদিয়ে মুক্ত করতে চাইছে বিএনপি। ( পড়ুন: প্যারোলেই মুক্তি চাইতে হচ্ছে খালেদা জিয়াকে?)
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১০ জুন ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত ছিল পরে বৈঠক হবে, কামাল হোসেন দেশে আসার পর। কিন্তু এরপর বিএনপি আর মিটিং ডাকেনি। আর দৃশ্যত মনে হচ্ছে, বিএনপি ফ্রন্টকে সক্রিয় রাখতে চাইছে না। ফলে শরিক দলগুলো নিজেদের উদ্যোগে যতটুকু সম্ভব কাজ করছে। এ ছাড়া, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে বিএনপির মধ্যে তিনটি ধারা রয়েছে। একেকটি ধারা একেক রকম মত পোষণ করে।’
বিএনপির একটি দায়িত্বশীল পক্ষ জানিয়েছে, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের বাস্তবতা ছিল। নির্বাচনের পর হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ পরিস্থিতি থেকে বেরুতে হলে ফ্রন্টকে নতুনভাবে সাজাতে হবে। বিশেষ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আ স ম রব, মাহমুদুর রহমান মান্নাকে একটি জায়গায় আনতে হবে।’
এ বিষয়ে ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি তাদের কাজে ব্যস্ত রয়েছে। তারা বড় দল, তারা নিজেদের গুছিয়ে আনার পর ফ্রন্টকে সক্রিয় করা হবে।’
২০ দলীয় জোটের ভেতরে জোট!
২০ বছরের জোট ২০ দলীয় জোট। সময়ের পরিক্রমায় চার দলীয় জোট, ১৮ দলীয় জোট হয়ে এখন ২০ দলীয় জোট। গত ২৭ জুন নতুন করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ১৮ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ নামে নতুন সংগঠনের ঘোষণা দেন এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব) অলি আহমদ। এই মঞ্চে কল্যাণ পার্টি, জাগপা, খেলাফত মজলিসের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। (নতুন নির্বাচন ও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’র ঘোষণা অলির)
বিএনপির সাড়া না পেয়ে ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন অলি আহমদ। গত মাসের শেষদিকে যোগাযোগ করেন মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে (পড়ুন: এবার মান্নার বাসায় অলির দূত, আজ দুই দলের সংবাদ সম্মেলন)। তবে সেখানেও তিনি খুব একটা সাড়া পাননি।
২০ দলীয় জোটের সঙ্গে শুরু থেকেই আছে খেলাফত মজলিস। দলটির মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জোট তো হয় নির্বাচনকেন্দ্রিক। আমাদের দেশে নির্বাচনের পরও জোট ক্রিয়াশীল থাকে। কিন্তু এর কোনও কারণ নেই। দুনিয়াব্যাপী যে জোট হয়, তা নির্বাচনকেন্দ্রিকই হয়। বাংলাদেশে জোটের একটা বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। তবে এখন যে ২০ দলীয় জোট আছে, সেটা কিন্তু কার্যক্রমে নেই। তার কারণ হচ্ছে— জোটের প্রধান নিয়ামকশক্তি যারা, তারা যদি জোটকে সক্রিয় করতে না চায়, তাহলে অন্য দলগুলোর কিছু করার থাকে না। এ কারণে বড় দলগুলো যখন সক্রিয় হবে, জোটগুলোও তখন সক্রিয় হবে।’
২০ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যেও বিএনপিকে নিয়ে সমালোচনা আছে। সংসদে যোগ দেওয়ার ঘটনায় এরইমধ্যে জোট ছেড়েছেন বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ।
জোটের সাবেক এক নেতা মনে করেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সরকারের স্ট্র্যাটেজিক ব্যাপার। সরকার যদি মনে করে তাকে এখন ছেড়ে দিয়ে পরে আবার কোর্টের পথে রাখবে, সেটি হতে পারে। আবার যদি মনে করে, এখন ছেড়ে দেবে, পরে নির্বাচনের সময় আবার ধরে নিয়ে যাবে; এই বাস্তবতায় বিএনপির করণীয় কিছু নেই।’
বি চৌধুরীর জোট প্রেস রিলিজে!
গত বছরের ১৪ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের যাত্রাই শুরু হয়েছিল বিভক্তি দিয়ে। জাতীয় প্রেস ক্লাবে আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে না এসে বিকল্প ধারার সভাপতি বি চৌধুরী সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, ‘বিএনপিকে এককভাবে ক্ষমতায় বসানোর ষড়যন্ত্রে নেই বিকল্প ধারা।’ (পড়ুন: বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর চক্রান্তে বিকল্পধারা নেই: মেজর মান্নান)
পরে এই বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনি ঐক্য করে। তার ছেলে মাহী বি চৌধুরী এখন দলটির দুজন এমপির একজন।
২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর আ স ম আবদুর রবের বাসায় বি চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে ঘোষণা হয়েছিল যুক্তফ্রন্টের। (পড়ুন: নতুন জোট ‘যুক্তফ্রন্ট’: চেয়ারম্যান বি. চৌধুরী, নেই ড. কামাল)
যুক্তফ্রন্টের ঘরোয়া প্রোগ্রাম হয় মাঝে মাঝে। বি চৌধুরীর প্রেস সেক্রেটারি জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত প্রেস রিলিজ দিয়ে অনুষ্ঠানের খবর পাঠানো হয় গণমাধ্যমে। যুক্তফ্রন্ট গঠনে অন্যতম উদ্যোক্তা মাহী বি চৌধুরীও এখন আর ফ্রন্টের মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন না। এছাড়া, ফ্রন্টের অভ্যন্তরে নীতি বিষয়ক সমস্যা আছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রক্রিয়ায় বি চৌধুরী স্বাগত জানালেও জেবেল রহমান তা প্রত্যাখ্যান করেন।
কিছু জোট হাওয়া
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে ছয়টি রাজনৈতিক জোট গঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে মিছবাহুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স, নাজমুল হুদার নেতৃত্বাধীন জাতীয় জোট (বিএনএ) লাপাত্তা। ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স-এর কো-চেয়ারম্যান এম এ আউয়াল এ প্রতিবেদককে তাদের জোট দলে রূপান্তর হবে— এমন তথ্য দিলেও গত কয়েক মাসে এর কোনও বাস্তবতা মেলেনি। এ ছাড়া, আয়কর আইনজীবী অ্যাডভোকেট জাকির হোসেনের নেতৃত্বে প্রগতিশীল জোট, শেখ ছালাউদ্দিন ছালুর নেতৃত্বে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, আলমগীর মজুমদারের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক জোটগুলোর কোনও কার্যক্রম নেই।
২০১৭ সালে ২০ সেপ্টেম্বর জনৈক মিঠুন চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ জনতা পার্টি—বিজেপি গঠিত হয়। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আদিবাসী পার্টি ও সমমনা অর্ধ-শতাধিক সংগঠনের উদ্যোগে বিজেপি গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। পরে ওই বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন মিঠুন চৌধুরী। নিখোঁজ হওয়ার ১৮ দিন পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয় দলটির সভাপতি মিঠুন চৌধুরী ও যুব শাখার প্রধান অজিত কুমার দাসকে। এই জোটের কোনও কার্যক্রম নেই।
ব্যতিক্রম বাম গণতান্ত্রিক জোট
বাম দলগুলোর আরও দুটি জোট রয়েছে। সিপিবি-বাসদ ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা মিলে গঠন করা হয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। এই জোটের দুটি উপজোট রয়েছে। সেগুলো হলো— সিপিবি-বাসদ ও বাম মোর্চা। বাম মোর্চার শরিক সংগঠনগুলো হলো— বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলন, বাসদ (মার্ক্সবাদী)।
বাম গণতান্ত্রিক জোট গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে এ সরকারের আমলে প্রথমবারের মতো ৭ জুলাই দেশব্যাপী আধাবেলা হরতাল পালন করে। এ ছাড়া, নিয়মিতভাবে রাজপথে সক্রিয় থাকে এ জোট।
বামমোর্চা ও গণতান্ত্রিক বাম জোটের অন্যতম নেতা, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘বামপন্থীদের নানা সমস্যার মধ্যেদিয়ে যেতে হয়। শাসকশ্রেণির বাধা, লুটপাটের রাজনীতি, স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাম আন্দোলন বিকাশের প্রধান বাধা। এরপরও জনগণের কাছে বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড়ানোর জন্য বামপন্থীরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে ধীরে ধীরে।’