উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে ইসির নিবন্ধন নেওয়ার সময় নারী নেতৃত্ব ৩৩ শতাংশ করার বাইরেও অন্য শর্তগুলোর মধ্যে ছিল বার্ষিক অডিট রিপোর্ট ইসিতে জমা দেওয়া, ছাত্র-শ্রমিক বা পেশাজীবী সংগঠনকে দলের সহযোগী সংগঠনের মর্যাদা না দেওয়া ইত্যাদি। এসব শর্তের মধ্যে অন্যগুলো পূরণ হলেও নারী নেতৃত্ব বাড়ানো ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে দলগুলো।
পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিশ্রুতি দেওয়ার সময় বড় দলগুলোয় গড়ে ১০ শতাংশের মতো নারী নেতৃত্ব ছিল। ফলে ১২ বছরে আরও ২৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এর মধ্যে ১০ বছর ৮ মাস পার হলেও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই কোনও দলেরই। গত ১০ বছরে দলগুলো নিজ-নিজ কেন্দ্রীয় কমিটিতে ১০ শতাংশও নারী নেতৃত্ব বাড়াতে সক্ষম হয়নি। তৃণমূলে এই হার আরও কম। ২০০৮ সালে দলগুলোর নারী নেতৃত্বের অবস্থান ও গত ১১ বছরের বৃদ্ধি মিলিয়ে ২০ শতাংশের কম। ফলে, বাকি সময়ের মধ্যে দলগুলোকে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়াতে হবে।
ইসির নিবন্ধন পাওয়ার সময় বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে নারী নেতৃত্ব ছিল প্রায় ১১ শতাংশ। এরপর ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই সম্মেলনের মাধ্যমে যে কমিটি হয়, তাতে সভাপতি শেখ হাসিনাসহ ৭৩ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ১২ জন নারী স্থান পান। কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে এর হার দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৪৪ শতাংশে। এরপর ২০১২ সালের সম্মেলন শেষে এই সংখ্যা একজন কমে শতাংশ হারে দাঁড়ায় ১৫-তে (১১ জন)। এরমধ্যে পরে জোহরা তাজউদ্দীন মারা যান এবং ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার পর দল থেকে পদত্যাগ করেন।
সবশেষে, ২০১৬ সালের সম্মেলনের পর গঠিত কমিটিতে ১৫ জন নারী কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। অবশ্যই, ওই সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটির কলেবর বাড়িয়ে ৭৩ থেকে ৮১ করা হয়েছে। এ হিসাবে নারী নেতৃত্বের হার দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৫২ শতাংশ। তবে, ৮১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির ৪টি পদ এখনও শূন্য রয়েছে। বিষয়টি হিসাবে ধরলে নারী নেতৃত্বের হার দাঁড়ায় ১৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
এদিকে, সরাসরি ও সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত এমপি মিলিয়ে আওয়ামী লীগের মোট সংসদ সদস্যদের মধ্যে ২১ শতাংশ নারী রয়েছেন। বিএনপি ২০১৭ সালে ইসিতে চিঠি দিয়ে দলের নারী নেতৃত্বের অবস্থান তুলে ধরে ২০২০ সালের মধ্যে সংগঠনের সব স্তরে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়।
২০০৮ সালে নিবন্ধন পাওয়ার সময় বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে ১০ শতাংশেরও কম নারী নেতৃত্ব ছিল। দলটি ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে পঞ্চম কাউন্সিলের পর যে কমিটি ঘোষণা করে, তাতে ৩৮৬ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে নারী ছিলেন ৪৬ জন। শতাংশ হারে হয়েছিল ১১ দশমিক ৯১। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত দলের ষষ্ঠ কাউন্সিলের পর যে কমিটি ঘোষণা করে, তাতে ৫২১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে নারী রয়েছেন ৬৮ জন (১৩%)। অবশ্য আরপিওর শর্তপূরণ বিষয়ে ২০১৭ সালে নির্বাচন কমিশনে যে চিঠি দিয়েছিল, তাতে জানিয়েছে দলের সব পর্যায়ের কমিটিতে ১৫ ভাগ মহিলা সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে বর্তমানে নারী নেতৃত্বের হার প্রায় ১০ শতাংশ। অবশ্যই, দলটি ইসির চিঠির জবাবে জানিয়েছিল তাদের দলের নারী নেতৃত্ব ২০ শতাংশ। এছাড়া, অন্যান্য দলের মধ্যে সিপিবিতে ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ ও জাসদে ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ নারী নেতৃত্ব রয়েছে।
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল গণফ্রন্ট জানিয়েছে, তাদের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। ইসিতে দেওয়া তথ্যের আলোকে এনপিপির ২০ শতাংশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ৬, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) ১২, গণতন্ত্রী পার্টিতে ১৫ শতাংশ ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টে ১ নারী নেতৃত্ব রয়েছে।
এছাড়া, জাতীয় পার্টি (জেপি), এলডিপি, জাকের পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপসহ অন্য দলগুলো ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ প্রতিশ্রুতি পূরণে প্রচেষ্টা চালানোর কথা বললেও দলের বর্তমান অবস্থান জানা যায়নি।
বিষয়টি নিয়ে জানতে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘বাংলাদেশের যে কোনও রাজনৈতিক দলের তুলনায় আওয়ামী লীগের নারী নেতৃত্ব বেশি। ইসির শর্ত পূরণে দলে নারী নেতৃত্ব বাড়াতে আওয়ামী লীগ কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের এ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’
নারী নেতৃত্ব নিয়ে ইসির শর্ত পূরণের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘ইসির শর্ত পূরণে দলে নারী নেতৃত্ব বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এখনও আমাদের হাতে সময় আছে। দেখা যাক, কতদূর এগুতে পারি। নিশ্চয় শর্ত পূরণ করা সম্ভব হবে।’
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘১১ বছরে যদি ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে, তাহলে সেটাকে প্রত্যাশিত বলা যাবে না। এই দীর্ঘ সময়ে যদি এই বৃদ্ধির হার এই হয়, তাহলে সামনের এক থেকে দেড় বছর সময়ে বাকি ১০ শতাংশ পূরণ সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।’
অবশ্যই ধীর গতিতে হলেও নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণকে ইতিবাচক আখ্যায়িত করে ব্রিগেডিয়ার (অব.) ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমাদের দেশে এখনও ওই ধরনের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। তারপরও যে অগ্রগতি হয়েছে সেটাকে কম বলা যাবে না। আমি নারী নেতৃত্ব বৃদ্ধির এই ধারায় আশাহত নই। আস্তে আস্তে এই হার আরও বাড়বে বলে মনে করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে সময়ে আছে, তার মধ্যে যদি ৩৩ শতাংশ না করা যায়, তাহলে নির্বাচন কমিশন নিশ্চয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্ত দেবে। হয়তো আরও কিছু সময় তাদের দেওয়া হবে।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম-সচিব ফরহাদ আহম্মেদ খান বলেন, ‘আমরা ২০১৭ সালে দলগুলোর থেকে তথ্য নিয়েছিলাম। তাগাদা দিয়েছি। আমরা দেখেছি, কয়েকটি দলে নারী নেতৃত্বের হার বেড়েছে। ২০২০ সাল তো শেষ সময়। তার আগে আমরা কোনও দলকে কিছু বলতে পারি না।’ তবে, বিষয়টি প্রতিপালনের জন্য নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভিন্ন সময়ে চিঠি দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি অগ্রগতির খবর নেওয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান।