বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যখন নেতা, তখন আমি মাঠের রাজনৈতিক কর্মী। তার সঙ্গে রাজনীতি করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার ক্লাসমেট ও বন্ধু ছিল। একসঙ্গে ছাত্রলীগ করার কারণে তার আমন্ত্রণে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে গেলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সালাম ও কুশলবিনিময় হতো।’
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম কীভাবে দেখা হয়েছিল জানতে চাইলে হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘৬০ থেকে ৭০ দশক পর্যন্ত আমি রাজনৈতিক মাঠের কর্মী। বঙ্গবন্ধু তখন যে মাপের নেতা ছিলেন তার সঙ্গে এক টেবিলে বসে রাজনীতি করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে তাকে প্রথম দেখেছিলাম আগরতলা মামলা থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসার পরে প্রকাশ্য সমাবেশে (দিনক্ষণ মনে নেই)। তার সঙ্গে সালামবিনিময় হতো ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে। শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে প্রায়ই আমি ৩২ নম্বরের বাড়িতে যেতাম। শেখ হাসিনা ও আমি একসঙ্গে ছাত্রলীগ করতাম। সেই কাজের সূত্র ধরে মাঝে-মধ্যে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে যেতাম, চা-নাশতা খেতাম। তখন বঙ্গবন্ধু সামনে পড়ে গেলে সালাম দিতাম।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালির পাঁচ হাজার বছরের একজন বিরল ব্যক্তিত্ব হিসেবে অভিহিত করে হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘কয়েক হাজার বছরের বাঙালির সভ্যতার ইতিহাসে তিনি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। কয়েক হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাসের অনেক রাজা, রাজনীতিক এসেছেন। কিন্তু বহু কারণে বঙ্গবন্ধু তাদের থেকে আলাদা।’
হাসানুল হক ইনুর মতে, বঙ্গবন্ধুর পাঁচটি বিশেষত্ব ছিল। তার ভাষায়, ‘প্রথমটি সবাই বলে, আমি বলবো—বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের বাঁকে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দরজাটা খুলে দেন। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন।
‘দ্বিতীয়, আজ আমরা যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চর্চা করছি, এটা হচ্ছে আধুনিক জাতীয়তাবাদের চর্চা। এই আধুনিক জাতীয়তাবাদের জনকও বঙ্গবন্ধু।
‘তৃতীয়, বাঙালি জাতি বিভিন্ন সময় লড়াই-সংগ্রাম ও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার প্রেরণা ও উৎসাহ দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতিকে বীরের জাতিতে রূপান্তরিত করেছেন। তিনি নিরস্ত্র বাঙালিকে জাতিগতভাবে সশস্ত্র যুদ্ধে উজ্জীবিত করতে সক্ষম হন। সমগ্র জাতিকে বীর জাতিতে রূপান্তরিত করেন।
‘চতুর্থ, বাংলাদেশের জনগণ মাঝে-মাঝে বিভ্রান্ত হয়েছে। কখনও তারা ধর্মকে সামনে এনে বাঙালি পরিচয়টাকে পেছনে ঠেলে দিয়েছে। সেই হিন্দু, মুসলাম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানকে বাঙালিত্বের পরিচয়ে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। সাম্প্রদায়িকতার আলখাল্লাটা ঠেলে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাঙালি সম্প্রদায়কে উজ্জীবিত করে বাঙালিয়ানার চর্চায় শামিল করে দেন তিনি। এটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ রাজনৈতিক অর্জন।
‘আর পঞ্চম, পৃথিবীর রাজনৈতিক রাষ্ট্রনায়কদের ইতিহাসে জর্জ ওয়াশিংটন থেকে ফিদেল কাস্ত্রো পর্যন্ত অনেকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, দেশকে স্বাধীন করার জন্য ও বিপ্লবের জন্য অনেক রকম কৌশল গ্রহণ করেছেন। কেউ হয়তো যুদ্ধ করেছেন, কেউ গণঅভ্যুত্থান করেছেন, আবার কেউ কেবল নির্বাচনি পথ অনুসরণ করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিরল রাজনৈতিক প্রতিভার অধিকারী; সূক্ষ্ম রাজনৈতিক কৌশলবিদ ছিলেন তিনি। তিনি শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন, গণআন্দোলন, নির্বাচন ও সশস্ত্র সংগ্রাম—সবগুলোর একটা অপূর্ব সমন্বয় সাধন করেন, যা পৃথিবীর অন্য রাষ্ট্রনায়কেরা এতগুলো কৌশলের সমন্বয় সাধন করতে পারেননি। এজন্য আমি বঙ্গবন্ধুকে বলি, অপূর্ব সূক্ষ্ম রাজনৈতিক কৌশলবিদ।’
১৯৭১ সালের ৮ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু স্বশাসিত বাংলাদেশকে শাসন ও পরিচালনা করেছেন মন্তব্য করে হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘তার ৭ মার্চের ভাষণ একটা ঐতিহাসিক ভাষণ। বড় কথা হচ্ছে, তিনি কৌশলের অবলম্বন করে ৮ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত নিরস্ত্রভাবে বাংলাদেশের কৃতিত্ব নিজের হাতে নিয়ে স্বশাসিত বাংলাদেশের যাত্রা শুরু করে দেন। আমি মনে করি, স্বশাসিত বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ থেকে। বঙ্গবন্ধু তার রাষ্ট্রীয় ঘোষণার মধ্যে দিয়ে স্বশাসিত বাংলাদেশকে শাসন ও পরিচালনা করেছেন। ২৬ মার্চ স্বশাসিত বাংলাদেশকে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তর করেন। সেই জন্য পাকিস্তানের ভেতরে কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বা যুদ্ধ আমরা করিনি। ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানি রাষ্ট্রের যুদ্ধ হয়েছে, যাতে আমরা পাকিস্তানকে পরাজিত করেছি ১৬ ডিসেম্বর।’
’৭২ সালে আওয়ামী লীগের কোনও কৃষক সংগঠন ছিল না জানিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাসদের সভাপতি বলেন, ‘তখন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষক লীগ নামে একটি সংগঠন করেন। ’৭২ সালের মে মাসের ২৯ তারিখে কৃষক লীগের ৮১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠন হয়। আমাকে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক করেন তিনি। খন্দকার আব্দুল মালেক শহীদুল্লাকে সভাপতি করা হয়েছিল। সদস্যদের মধ্যে অনেকে গণপরিষদের সদস্য ও নামকরা আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। কিন্তু তিনি কেন আমাকে এত বড় একটা দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সেটা এখনও আমি জানি না। ’৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাসদ করার আগ পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি।’
কেন বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে জাসদ করেছিলেন জানতে চাইলে হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘এখন এই বিষয় নিয়ে কোনও আলোচনা করতে চাই না। কারণ, আপনি বঙ্গবন্ধুকে যে কারণে স্মরণ করে এই সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, এতে তার শাসনকালের সমালোচনা না করাই ভালো। এই বিষয়ে কথা বললে অনেক কিছু আসবে। ফলে কথা না বলাই ভালো। আজ বরং তার ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে কথা বলি।’