আগেই নেতৃত্ব নির্বাচন, নেই প্রচারণাও

বিএনপির কাউন্সিল নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম

বিএনপির পতাকাবারোদিন আগে দলের চেয়ারপারসন হিসেবে খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ৬ষ্ঠ কাউন্সিলের প্রধান আকর্ষণ হারিয়েছে বিএনপি। পাশাপাশি রাজধানীতে প্রচারণা অনেক কম হওয়ায় কাউন্সিলের বিষয়টি দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যেও তেমন সাড়া ফেলেনি। এ কারণে শনিবার সকাল ১০টায় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিতব্য কাউন্সিলের প্রতি নাগরিকদের মনোযোগ নেই বললেই চলে। শুক্রবার দিনের বিভিন্ন সময় রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় চায়ের স্টলে,শিক্ষার্থী আড্ডায় বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে এই আগ্রহহীনতার বিষয়টি উঠে আসে। এদিকে বিএনপির কাউন্সিল নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কোনও সাড়াশব্দ নেই। বিএনপির দলীয়, সমর্থিত কিছু পেজের বাইরে কাউন্সিল নিয়ে তেমন কোনও আলোচনা দেখা যায়নি। ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারাও কাউন্সিলকে তামাশা বলে মন্তব্য করেছেন।
লেখক স্বকৃত নোমান বলেন,বিএনপির রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থায় ভাটা পড়ে গেছে। কারণ, বিগত দিনগুলোতে দলটি রাজনীতিতে একের পর এক ভুলই করে গেছে শুধু।রাজনীতির জন্য যে বিচক্ষণতার প্রয়োজন, তা দেখাতে পারেনি দলটি। ফলে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী দলটিকে আর গোণার মধ্যে রাখছে না। আর জাতীয় কাউন্সিলে কী হবে, তা আগে থেকেই দেশের মানুষ জানে। মুখে যতই গণতন্ত্রের কথা বলা হোক না কেন,দলটির অভ্যন্তরেই তো গণতন্ত্র নেই।
তিনি আরও বলেন,খালেদা জিয়া তো আর চেয়ারপারসনের পদ ছাড়বেন না, এটা সবার জানা। তিনি ও তার পুত্র তারেক জিয়ার কথামতোই সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হবে,এটাও জানা কথা।বাকি পদগুলোও ঠিক একইভাবেই হবে।এ কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে কাউন্সিল নিয়ে তেমন কোনো উচ্ছ্বাস নেই।
শুক্রবার বিকালে হাতিরঝিলের মধুবাগ বিজ্রে কথা হয় ঢাকা কলেজের চার শিক্ষার্থীর সঙ্গে। ইংরেজি বিভাগের মাহফুজুর রহমান,পরিসংখ্যান বিভাগের আনিসুর রহমান বাবু, ব্যবস্থাপনা বিভাগের রেজাউল কবির খান ও দর্শনের রুবেল মোড়লের সঙ্গে।তাদের প্রত্যেকেরই মত, শনিবার বিএনপির কাউন্সিল নিয়ে তাদের আকর্ষণ নেই। দেশের একটি বড় দল হিসেবে বিএনপির কাউন্সিল নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহের জায়গাটিও নষ্ট হয়ে গেছে। যোগ করেন মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, বিএনপি তো মুখে মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে। কিন্তু তারা তাদের শীর্ষ দু‘টি পদে কোনও নির্বাচন করেনি।
প্রসঙ্গত, গত ৬ মার্চ বিনা-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন,তারেক রহমান সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।নির্বাচন প্রক্রিয়ার সমন্বয় ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ওই সময় জানিয়েছিলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় খালেদা-তারেক নির্বাচিত হয়েছেন।

 




দলীয় সূত্রে জানা যায়,শীর্ষ দু’টি পদের বাইরে মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রায় নির্ধারিত থাকায় এ পদ নিয়েও আলোচনা নেই। এড়া অতিরিক্ত মহাসচিব, দুই মহাসচিবসহ বিভিন্ন পদ নিয়ে আলোচনা থাকলেও বৃহস্পতিবার স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব বিষয় আলোচনাতেই ছিল না। এর বাইরে স্থায়ী কমিটির বৃদ্ধি না হয়ে শূন্যস্থান পূরণ করার কারণেও খুব একটা আগ্রহ বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে নেই। তবে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, বিএনপি একটি বড় দল। কাউন্সিল হচ্ছে,এটি বড় আগ্রহের বিষয়।
তবে অন্তত দেখানোর জন্য হলেও এই দু’টি পদে নির্বাচনের প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন লেখক সাইমুম সাদী। তিনি বলেন,বিএনপি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছাড়া হবে না,এমন সত্য থাকলেও যেহেতু গণতান্ত্রিক পরিবেশের কথা বলে,গণতন্ত্র দাবি করে,সে কারণে শীর্ষ দুই পদে নির্বাচন হলে মানুষের আগ্রহ থাকত।
খিলগাঁও রেলস্টেশনের পাশের চায়ে স্টলে বসে গল্প করছিলেন বিক্রেতা আবদুল আলিম,রিক্সা ড্রাইভার সিদ্দিক আহমদ,গ্যারেজ নিরাপত্তারক্ষী আবু সুফিয়ান।বিএনপির কাউন্সিল নিয়ে জানতে চাইলে,তাদের বক্তব্যে অনেকটাই গাছাড়াভাব লক্ষ্যকরা যায়। অনেকটা রাজনীতি নিয়েই উদাসীনতা তাদের। তাদের কথা প্রায় এমন ছিল,‘ভাই,পেটের রাজনীতিই তো শেষ হয় না। বিএনপির কি খবর নিমু।’
জবির আরেক শিক্ষার্থী গোলাম রব্বানী বলেন, বিএনপির কাউন্সিলে সৎ ও যোগ্য নেতারা নেতৃত্ব পাবে সে আশা করছি। তা হলে দলটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। অন্যথায় আরও পিছিয়ে যাবে।
তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ বলেন, গণমাধ্যমের খবর পড়ে জেনেছি দলের নেতৃত্ব ইতোমধ্যে ঠিক হয়ে গেছে। তাহলে লোক দেখানো কাউন্সিল করে কি লাভ? কাউন্সিলরদের মতামত অনুযায়ীই নেতৃত্ব ঠিক করা উচিত।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী বাবুল আফ্রাদ বলেন, গত ২৭ বছরে বিএনপির মাত্র ৬ষ্ঠ কাউন্সিল হচ্ছে। এটি গণতান্ত্রিক চর্চা না। একটি বড় রাজনৈতিক দলের কাউন্সিল নিয়মিত হবে, এটিই প্রত্যাশিত।





এদিকে ৬ষ্ঠ কাউন্সিলের প্রচারণা নিয়েও রয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীদের নানা খেদ। রাজধানীতে কাউন্সিল নিয়ে যুৎসই কোনও প্রচারণা হয়নি। ছয় লাখ পোস্টার প্রকাশের কথা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় জানালেও আদতে কাউন্সিল এলাকার আশেপাশেই পোস্টার চোখে পড়েনি।এ বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন,খুব দ্রুততার সঙ্গে সব আয়োজন করতে হয়েছে।এ কারণে সামান্য কিছু বিষয়ে ল্যাকিংস থাকেই। তবে পোস্টার লাগানোতে পুলিশের বাধা ছিল।এরই মধ্যে কয়েকজন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন নেতা বলেন,প্রচারণা তো ছিল না।কাউন্সিল কেন্দ্র করে শুধু লবিংটাই বেশি ছিল। গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন,এটি নিয়মরক্ষার কাউন্সিল। মানুষের আগ্রহ থাকার কোনও কারণ নেই।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রবিবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক বর্ধিত সভায় বলেন,বিএনপির কাউন্সিলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে। এই দুই পদে অন্য কাউকে মনোনয়নপত্র জমা না দিতে গোপনে বলা হয়েছে।কাজেই বিএনপি কাউন্সিল নিয়ে রঙ-তামাশা করছে।




অনেকে আশাবাদীও

বিএনপির কাউন্সিলের দাওয়াত পাননি মহাজোট শরিক বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব এম এ আউয়াল এমপি। তিনি বলেন, দাওয়াত না পেলেও শুভ কামনা আছে। আমি মনে করি, বিএনপির কাউন্সিলকে সামনে রেখে বিগত দিনের নাশকতামূলক রাজনীতি পরিহার করে স্বচ্ছধারার রাজনীতিতে ফিরে আসবে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, আদর্শের পক্ষে আসবে। জামায়াতকে ত্যাগ করবে। আমি মনে করি, তাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। কাউন্সিলের মাধ্যমে এই পরিবর্তন সাধিত হোক।
কবি ও আইটি স্পেশালিস্ট হাসানুর জামান।তিনি বলেন,নিরপেক্ষ মন নিয়ে যদি ভাবে কিংবা ভাবতে চায় তাহলে সবাই চাইবে একটি শক্তিশালী বিরোধীদল, যে দল সরকারের ভুল সিদ্ধান্তগুলোকে খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করবে এবং সঠিক পরামর্শ বা জনসমর্থন নিয়ে ফলপ্রসু আন্দোলনের সূচনা করবে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা খাদহীন, আনুপাতিকভাবে সঠিক সরকার যেমন পাইনি,তেমনি পাইনি সঠিক কিংবা সরকার (সরকার মানে কোন রাজনৈতিক দল নয়) সহায়ক বিরোধীদল। সন্ত্রাসবিরোধী শ্লোগান এতদিনে বললে কি আর করা। তবুও যদি নিজেদের ঘোষণাপত্র নিজেরাই মেনে চলেন, তবেই দেশের গতি।একপক্ষীয় সরকার যেমন চাই না,তেমনি মুণ্ডুবিহীন বিরোধীদলও অপ্রত্যাশিত। ১৭ হোক আর ৩৫ হোক কাজের ফলাফলই প্রধান।
কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আকবর বলেন, আশা করছি কাউন্সিলের মাধমে বিএনপি আবার রাজনীতির মাঠে ফিরে আসবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলন অব্যাহত রাখতে ভাল নেতৃত্ব বের করবে।



সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আলোচনা নেই

বিএনপির কাউন্সিল নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সাধারণ্যে আলোচনা নেই। তবে বিএনপির সমর্থিত, দলীয় কিছু পেজগুলোয় আলোচনা দেখা গেছে। রাত বারোটার দিকে দেখা গেছে কাউন্সিল উপলক্ষ্যে তৈরি বিএনপির ফেসবুক পেজে লাইক মাত্র তিন হাজার সাতশ ৪৯।
ফেসবুকে কবি নকুল দেব লিখেছেন,বিএন‌পির কাউ‌ন্সিল নিয়ে আমার নিজের কোন আগ্রহ নেই।এই কাউ‌ন্সিল হবে নামে মাত্র,‌বিএন‌পি হয়তো ভাবছে দলের গঠনতন্ত্রের ব্যাপক প‌রিবর্তন এনে বিএন‌পিকে নতুনভাবে পুনরুজ্জ‌ীবিত করবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে ব‌ালি।তারা নিজেরা যেমন এই নিয়মতন্ত্র মেনে চলবে না,তেমনই জনগণও এই নিয়মতন্ত্রের ওপর আস্থা রাখবে না। তা ছাড়া সরকারও বিএন‌পিকে নানাভাবে কোণঠাসা করে রাখবে। আমি মনে ক‌রি এই কাউ‌ন্সিল হবে কেবল সংবাদের খোরাক।
এ বিষয়ে ছাত্রদল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সম্পাদক মশিউর রহমান সোহান বলেন, বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। সারা দেশের মানুষ চায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কাছে দলের নেতৃত্ব থাকবে। এটি গণমানুষের চাহিদা।
 

এসটিএস/এমএসএম