২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা: নেপথ্য শক্তির বিচার চায় আইভি পরিবার

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার নেপথ্যের শক্তিকে সামনে নিয়ে আসার দাবি জানিয়েছেন এই হামলায় নিহত আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদক আইভি রহমানের বড় মেয়ে তানিয়া রহমান। তিনি বলেন, ‘হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের বিচার হয়েছে, এ হামলার পেছনে যারা ছিল, যাদের স্বার্থ ছিল ২১ আগস্ট ঘটনার পেছনে, তাদের শাস্তি দেখতে চাই। আমাদের পরিবারের ভীষণ চাওয়া এটা।’

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন আইভি রহমান। পরে ২৪ আগস্ট সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি  জিল্লুর রহমান ও তার স্ত্রী আইভি রহমানের পরিবারে এক ছেলে নাজমুল হাসান পাপন, দুই মেয়ে তানিয়া রহমান ও তনিমা রহমান। মায়ের মৃত্যুতে নিজেদের পরিবারের চাওয়া ও কষ্টের কথা বাংলা ট্রিবিউনের এ প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরেন বড় মেয়ে তানিয়া রহমান। 

তানিয়া রহমান বলেন, ‘মূলত এ ঘটনায় যারা লাভবান হয়েছে, আমরা জানি তারা কারা? তাদের শাস্তিটা দেখতে চাই। আমরা চাই, আসল  বেনিফিশিয়ারি যারা, তারা সামনে আসুক। সরকার তাদের খুঁজে বের করুক। তিনি বলেন, ‘বিচার যা-ই হয়েছে, এই সরকার না থাকলে সেটুকুও হতো না।’

মায়ের অনুপস্থিতিতে পরিবারের সুখ-দুঃখের বিষয়ে তানিয়া বলেন, ‘নতুন করে কী আর বলবো। আসলে কেমন লাগে বলা কঠিন। একই রকম লাগে। সবসময়ই নতুন লাগে মনে হয়, যেন ২১ আগস্ট আজকের ঘটনা। ১৭ বছর পার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের ভাই-বোন সবার কাছে মনে হয়, এই তো সেদিনের ঘটনা।’

তিনি বলেন, ‘দিন যত যাচ্ছে কষ্টের ধরন পাল্টাছে। সে রকমভাবে হয়তো কান্নাকাটি করা করি না। কিন্তু কষ্টটা ঠিকই বাড়ছে। কেন জানি না, এবার আমাদের তিন ভাই-বোনের ভীষণ খারাপ লাগছে। এটা হয়তো থাকবে আজীবনই। কারণ, মায়ের এই মৃত্যু অস্বাভাবিক মৃত্যু। এই মৃত্যুর উত্তর আমরা আজও  পাই না কেন? ভীষণ অতৃপ্তির জায়গা হলো— এই কেনোর উত্তরটা পাই না বলেই আমাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়।’

তানিয়া বলেন, ‘কেন হলো এমন ঘটনা? সাধারণ একটা মিটিংয়ে গিয়ে কেন হলো এমন ঘটনা, আমাদের মা সারা জীবন রাজনীতি করেছেন। কত মিছিল-মিটিং করেছেন, টিয়ার গ্যাস-লাঠিচার্জ সবই তো খেয়েছেন। এই কেনোটার উত্তরও পাই না। আরেকটা কেনোর উত্তরও পাই না যে, তখন যারা সরকারে ছিল, বিএনপির সরকার তখন যে আচরণ করেছে, সেটাই-বা কেন করেছে? মাকে একটু দেখতে দিলো না। কাছে যেতে দিলো না। ভেন্টিলেটর খুলে ফেললো আমাদের না জিজ্ঞেস করে। এখন এসব প্রশ্নের উত্তর অনেক বেশি মনে হয়।’

তানিয়ার বড় ভাই আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নাজমুল হাসান পাপন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ভাইয়া ভীষণ রকম মা-ভক্ত। আমার মাও পাপন ভাইকে বেশি পছন্দ করতেন। আমরা তিন ভাইবোনের মধ্যে মায়ের ভীষণ ভক্ত ছিল ভাইয়া (পাপন)। মায়ের পৃথিবীর পুরোটাই ছিল ভাইয়া। বাকিটা আমরা দুই বোন। মা পাগল ছিলেন ছেলের জন্য। ছেলেও  ভীষণ পাগল ছিল মায়ের জন্য, অন্যরকম।’

তানিয়া বলেন, ‘আম্মা কিন্তু বেশ শক্ত ছিলেন। আম্মার প্রকাশটা কম ছিল। ভাইয়ার প্রকাশটাও একটু কম। কিন্তু উনারা একজনকে আরেকজন বেশ বুঝতেন। ভাইয়া যে আম্মার সবকিছু এটা ভাইয়া জানতো। আবার আম্মা যে ভাইয়ার সবকিছু এটা আম্মাও জানতেন।’ তানিয়া বলেন, ‘আমার ছোট বোন তনিমা রহমান আম্মার নিচেই থাকতো। আম্মার মৃত্যুতে ভীষণ শক্ট আমার ছোট বোন। আমাদের কাছে এখনও বড় হয়নি তনিমা। আম্মা বুঝতেনই না ও বড় হয়েছে! আমরাও বুঝতাম না। রোজ সকালে আম্মা ওর কাছে বেড-টি নিয়ে যেতেন, ও ঘুমে থাকতো। আম্মা ওর পায়ের কাছে বসে বসে বেড-টি খেতেন। পরে ও ঘুম থেকে উঠতো।’

২১ আগস্টও ওর (তনিমা) সঙ্গে লাস্ট দুপুরে খেলেন। আব্বা-আম্মা আর ময়না (তনিমার ডাক নাম) তিন জন একসঙ্গে খেল। দুপুরে খেয়ে আব্বা-আম্মা  মিটিংয়ে গেলেন। মায়ের মৃত্যুতে ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে আমার ছোট বোনটা। একসঙ্গে থাকতো তো। আম্মার পুরো শখ্যটা ছিল তনিমার সঙ্গে। আম্মার মতোন তনিমাও খুব শৌখিন।’

আইভি রহমানের ছোট তনিমা বলেন, ‘আমার সঙ্গে আম্মার সম্পর্ক মা-মেয়ের মতো ছিল না। অনেকটা বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল। আমার ওপর ভীষণ ডিপেন্ড করতেন। পারিবারিক সকল ক্রাইসিস আমিই জানতাম আগে।’ পাপন সম্পর্কে তানিয়া বলেন, ‘ভাইয়া খুবই চাপা। কিন্তু খেয়াল করেছেন কিনা জানি না। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ মহিলা সমিতিতে আম্মার জন্য যে অনুষ্ঠান করলাম,  তখন ভাইয়াকে নিয়ে গিয়েছিলাম। আম্মার সম্পর্কে যেকোনও কিছু জানতে বা জানাতে ভাইয়া কিন্তু না কেঁদে কথা বলতে পারে না। হাউমাউ করে কাঁদে। বাচ্চাদের মতো।’

তিনি আরও বলেন, ‘এজন্য আম্মা সম্পর্কে পাপন ভাইয়া কোথাও কোনও স্মৃতিচারণ করতে চায় না, ভাইয়া তা পারে না। আমরা যেমন সাধারণভাবে কথা বলি ও তা পারে না। তাই আম্মা সম্পর্কে কারও সঙ্গে কথাও বলতে চায় না। অনেকেই ভাবে কেন বলে না। আসলে ভাইয়া পারে না। ভাইয়ার পক্ষে স্বাভাবিকভাবে কিছু বলা সম্ভব না।’

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার সম্পর্কে তানিয়া বলেন, ‘বিচার নিয়ে এখন কথা না বলি। বিচার হয়েছে ধরেন। যতটুকু  হয়েছে এই সরকার আছে বলেই হয়েছে। তা না-হলে এটুকুও হতো না।’