দুই যুক্তিতে নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ বলছে আ.লীগ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও মাঠের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভোট বর্জন করেছে। একই ধরনের চিত্র দেখা যাচ্ছে ছোট দলগুলোর ক্ষেত্রেও। তবে নিবন্ধিত প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দলের অংশগ্রহণ এবং বিপুল সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপির সঙ্গে ভোটে না আসা অধিকাংশ দলেরই নিবন্ধন নেই, তারা অংশ নিচ্ছে না বলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না— তা বলা যাবে না।

ক্ষমতাসীন দলের একাধিক সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছে, বিএনপি নির্বাচনে না আসায় ‘অংশগ্রহণমূলক’ ভোটের প্রশ্ন এড়াতে দুই কৌশলে এগুচ্ছে আওয়ামী লীগ। এর অংশ হিসেবে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। আর নিজ দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যককে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন ফরম দেওয়া এবং অনিবন্ধিত দলগুলোকেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে আনা। উভয় কৌশলই প্রতিকূল অবস্থায় নির্বাচনি আমেজ তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।

সূত্রমতে, ডাক-ঢোল পিটিয়ে চার দিন ধরে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি করে নির্বাচনি আমেজ তৈরি চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ। রিটানিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা না দিতে দলীয় প্রার্থীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর ফলে ৩০০ আসনে প্রায় ৪৪২ জন আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী; যা দলীয় প্রার্থীর (২৯৮ জন) প্রায় দেড়গুণ। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়াদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।

স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিষয়ে বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) এক ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘পরিণতি যখন আসবে, তখন বুঝতে পারবেন কৌশলটা। এর যথার্থতা তখন বোঝা যাবে। আমাদের কৌশল ভেবেই করেছি। তবে আমরা ঢালাওভাবে করবো না। সময়মতো জানবেন।’ 

শুক্রবার (১ ডিসেম্বর) এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, দুয়েকটা রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিলো কি নিলো না, তার চেয়ে জনগণের অংশগ্রহণটা কেমন, সেটা বেশি করে ভাবার বিষয়। ঢালাওভাবে সবাই স্বতন্ত্র নির্বাচন করবে বিষয়টা এমন নয়। ১৬ তারিখ পর্যন্ত দলীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে।

এ ব্যাপারে কথা হয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর দুই জন সদস্যের সঙ্গে। তারা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এবার আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনি কৌশল সাজিয়েছে। সেভাবেই দলীয় প্রার্থী দেওয়া, স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহিত করার কৌশল নেওয়া হয়েছে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগে এবার জোটের আসন বণ্টন না করা এবং অধিকাংশ নিবন্ধিত দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়টিও এই পরিকল্পনার অংশ।

গত ২৬ নভেম্বর (রবিবার) গণভবনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক করতে প্রতিটি আসনে দলীয় ‘ডামি প্রার্থী’ রাখার নির্দেশনা দেন তিনি। সেইসঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহিত করার পাশাপাশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের কোনও প্রার্থী নির্বাচিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও সতর্ক করেন দলটির প্রধান।

পরদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের পাশাপাশি দলের নেতাদেরই স্বতন্ত্র প্রার্থী (ডামি) হওয়ার অনুমতি দলের প্রয়োজনে ‘কৌশলগত সিদ্ধান্ত’। অথচ অতীতের নির্বাচনগুলোতে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলের কেউ যাতে স্বতন্ত্র প্রার্থী না হয়, সে জন্য রীতিমতো বারংবার সতর্ক করেছে আওয়ামী লীগ। এমনকি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় ‘বিদ্রোহী’ হিসেবে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে বহিষ্কারও করেছে আওয়ামী লীগ।

নির্বাচন কমিশনে (ইসি) দাখিল করা মনোনয়নপত্রের তথ্য বলছে, নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৯টি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে অধিকাংশ আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী ১৪ দলের শরিক দলগুলো ও মিত্র দল। এসব দলের মধ্যে নিজেদের মার্কার পরিবর্তে আওয়ামী লীগের প্রতীক ‘নৌকা’ নিয়ে নির্বাচন করছে অন্য আরও ৯টি রাজনৈতিক দল। আর বিএনপিসহ নিবন্ধিত ১৫টি দলসহ মোট ৩৯টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। এসব দল নির্বাচনের তফসিল বাতিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে।

আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করার দাবি জানিয়ে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। এ লক্ষ্যে সরকারের ওপর বিভিন্নভাবে চাপ অব্যাহত রেখেছে দেশগুলো। এমতাবস্থায় বিএনপি নির্বাচনে না আসায় ‘অংশগ্রহণমূলক’ হওয়ার প্রশ্ন এড়াতে ভিন্ন কৌশল নিয়ে এগুনোর কথা জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা। তাদের মতে, এর অংশ হিসেবে দলটির প্রায় সকল আসনে প্রার্থী দেওয়ার পাশাপাশি ডামি হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়াকে উৎসাহিত করেছে আওয়ামী লীগ। ফলে দলটির বিপুল সংখ্যক নেতা এবার মনোনয়নপত্রও জমা দিয়েছেন। জোটসঙ্গী এবং মিত্রদের মধ্যে এখনও আসন বণ্টন না করে আলাদা প্রার্থী দিয়ে ভোটের মাঠে রাখা হয়েছে, তাদের সিংহভাগই নৌকা প্রতীকে ভোট করছে। জাতীয় পার্টিসহ অন্য দলগুলোও সর্বোচ্চ সংখ্যক আসনে প্রার্থী দিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনের জন্য এত প্রার্থী হয়েছেন। প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচনে আমেজ তৈরি হওয়ায় জনগণের মধ্যেও ভোটের জোয়ার দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি কৌশলের কারণে পুরো দেশ এখন নির্বাচনমুখী হয়েছে। বিএনপির আন্দোলনের দিকে এখন আর কারও মনযোগ নেই।

ইসির ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) ছিল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। শুক্রবার (১ ডিসেম্বর) ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানিয়েছেন, ৩০০ আসনে ২ হাজার ৭১১টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। এরমধ্যে ২৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের পক্ষে ১ হাজার ৯৬৪টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ৭৪৭টি মনোনয়নপত্র দাখিল হয়েছে। আওয়ামী লীগ ২৯৮টি আসনে ৩০৩টি মোট মনোনয়নপত্র দাখিল করেছে। পাঁচটি আসনে তাদের দুজন করে প্রার্থী রয়েছে। আর সংসদের বর্তমান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ২৮৬টি আসনে ৩০৪টি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে, যার মধ্যে ১৮টি আসনে দুজন করে প্রার্থী রয়েছে।

আওয়ামী লীগের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘ঢালাওভাবে নয়, বরং কেস টু কেস বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়ে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। সময় হলে এ বিষয়ে পরিকল্পনা বা কৌশল ঠিক করা হবে। দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। তা নিয়ে আগাম বলার সময় হয়নি এখনও।’

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন উপকমিটি, জেলা, উপজেলা ও পৌর কমিটির অনেক নেতা এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগসহ বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারাও এই তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। সেইসঙ্গে অতীতে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত অনেকেও এই সুযোগে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।

বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের বদলে এবার নৌকার টিকিট পেয়েছেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ। আসনটি থেকে ২০২২ সালে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সব পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া পঙ্কজ দেবনাথ এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। বরিশাল-৫ আসনে নৌকার প্রার্থী করা হয়েছে বতর্মান সংসদ সদস্য কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামিমকে। এ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বরিশাল সিটির সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ।

এবার স্বতন্ত্র হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পঙ্কজ দেবনাথ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলাম। তবে দল থেকে মনোনয়ন না পাওয়ায় এবার নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু ডামি প্রার্থী না থাকায় দলের নেতাকর্মীদের অনুরোধে শেষ সময়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছি।

শুক্রবার (১ ডিসেম্বর) থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই চলবে। মনোনয়ন বাতিলের বিরুদ্ধে আপিল ও নিষ্পত্তি হবে ৬-১৫ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৭ ডিসেম্বর জানা যাবে এবার কতজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ হলে নির্বাচনী প্রচারণায় নামবেন প্রার্থীরা, যা অব্যাহত থাকবে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। সবশেষ আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।