ছাত্রদলে আসছে নতুন মোড়কে পুরনো নেতৃত্ব?

রাজিব আহসান, আকরামুল হাসান, মামুনুর রশীদ মামুন, আসাদুজ্জামান আসাদ, এজমল হোসেন পাইলট, আলমগীর হাসান সোহান, আবু আতিক আল হাসান, ইসহাক সরকার, বায়েজিদ আরেফীন ও আবুল হাসান।একবছর দুই মাস ২২ দিন পার হচ্ছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির বাড়তি মেয়াদ। নতুন কমিটির জন্য ইতোমধ্যে নীরব হাহাকার শুরু হয়েছে মাঠে। গোপনে চলছে গ্রুপিং-তৎপরতা। এসব তৎপরতার মধ্যে সংগঠনটির অভিভাবক বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ভাষ্য, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমান কমিটিকেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সামনে আনার পক্ষে দলীয় হাইকমান্ড। সোজা কথায়, নতুন মোড়কে পুরনো নেতৃত্ব। আর এই সম্ভাবনাকে সামনে রেখে ছাত্রদলের বর্তমান নেতারা আরও একবার কমিটিতে থাকতে ভেতরে-ভেতরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

যদিও ছাত্রদলের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেন, বিএনপির এমন একাধিক নেতা জানান, দু’টি কারণে ছাত্রদলের কমিটি নির্ধারিত মেয়াদ পার করে বাড়তি সময় পার করছে। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১৪ নভেম্বর কমিটি গঠিত হওয়ার পর ১৬ সালের ১৪ নভেম্বরে শেষ এই কমিটির মেয়াদ হয়েছে। এরপর গত বছর নতুন কমিটির দাবিতে ছাত্রদলের ভেতরেই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হয়েছে। এরপরও সংগঠনটির নতুন কমিটি গঠনের বিষয়ে কোনও আলো দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে ছাত্রদল ও বিএনপির একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ৯০-এর দশকে সরাসরি খালেদা জিয়ার তত্ত্বাবধানে ছিল ছাত্রদল। ওই সময় সংগঠনটির কমিটি হওয়া বা না হওয়ার বিষয়টি দেখভাল করতেন আমান উল্লাহ আমান।

২০০১ সালে সরকারে আসার পর এই কাজটিতে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন সাবেক বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালু। তার ভূমিকাতেই ছাত্রদলের রাজনীতিতে প্রয়াত নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টুর উত্থান ঘটে। পরে তারেক রহমান যুগ্ম মহাসচিব হলে সরাসরি তার তত্ত্বাবধানে চলে যায় ছাত্রদল।

বিএনপির দলীয় সূত্রগুলো বলছে, ছাত্রদলের কমিটি আদায়ে সব সময়ই বিএনপির কোনও না কোনও নেতাকে ভূমিকা রাখতে হয়েছে। বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে, কেউ আদায় না করলে সংগঠনটির কমিটি যথাসময়ে হয়ই না। বিএনপির আগের কমিটিতে শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ছাত্র-বিষয়ক সম্পাদক থাকায় বিষয়টি খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের সামনে তিনিই তুলে ধরতেন। যদিও বর্তমান ছাত্রদলের শীর্ষপর্যায়ের একাধিক নেতার ভাষ্য, কমিটি গঠনে মাধ্যম বন্ধ রাখাই ভালো। একসময় আমান উল্লাহ আমান এ কাজে সম্পৃক্ত থাকলেও শেষ কমিটিতে তাকে উপদেষ্টা করা হয়েছে। আর এ্যানি বিএনপির প্রচার সম্পাদক হওয়ায় ছাত্রদলের কমিটি আদায়ে এই মুহূর্তে কোনও কারিগর নেই।

দ্বিতীয়ত, বিএনপির আন্দোলনের ভ্যানগার্ড ছাত্রদল। নির্বাচন সামনে রেখে বর্তমান নেতৃত্বকে বিএনপি ভাঙবে কিনা, এ নিয়ে আলোচনা আছে। একইসঙ্গে বর্তমান সভাপতি রাজিব আহসান চেয়ারপারসনের গুডবুকে আছেন বলে বিএনপির কোনও কোনও নেতার ধারণা, নতুন কমিটি হলেও রাজিব আহসান অপরিবর্তিত থাকছেন। বিশেষ করে নতুন বছরের ২ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সমাবেশে রাজিব আহসানের ভূমিকা বিএনপির মধ্যে আলোচনা তৈরি করেছে বলে দাবি করে সূত্রটি।

আবার একইসূত্রের দাবি, সেক্রেটারি আকরামুল হাসানের লিংক বেশি। এক্ষেত্রে উভয়কেই নতুন কমিটিতে দেখার সুযোগ রয়েছে।

বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র বলছে, খালেদা জিয়ার মামলা ও আগামী নির্বাচন—এ দু’টি বিষয়কে সামনে রেখে নতুন করে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া সহসা খুলছে না। যদিও ছাত্রদলের বর্তমান নেতৃত্ব এ বিষয়টি নিয়ে অন্ধকারে আছে। কমিটির সিনিয়র নেতারা এ নিয়ে স্পষ্ট হতে চাইছেন। কমিটি না হলেও বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন তারা।

ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আগামী মার্চেই ছাত্রলীগের সম্মেলন করার কথা বলেছেন। ছাত্রদলের একাধিক নেতা মনে করেন, এক্ষেত্রে ছাত্রদলকেও সম্মেলন না করে হলেও প্রয়োজনে চেয়ারপারসনের কার্যালয় থেকে কমিটি ঘোষণা করা উচিত।

ছাত্রদলের কমিটির বিষয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনও মন্তব্য নেই।’

যদিও বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির ভাষ্য, ‘আমাদের বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও ব্যস্ত। তার কোর্টে আসা-যাওয়াসহ সব কিছু মেনটেইন করতে হচ্ছে। এ কারণে একটু সময় লাগছে। যেকোনও সময় একটা সিদ্ধান্ত আসতে পারে।’

গত ২ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে খালেদা জিয়া সংগঠনটির নেতাকর্মীদের তিনটি বিষয়ে জোর দিতে বলেন। তিনি বলেন, ‘ছাত্রদলকে সুশৃঙ্খলভাবে চলতে হবে। ঐক্য, ঈমান ও শৃঙ্খলা—এই তিনটি জিনিস অত্যন্ত জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘ঈমানও ঠিক রাখতে হবে। শৃঙ্খলা ও ঐক্য ঠিক রাখতে হবে। তাহলে সবকিছু জয় করা সম্ভব হবে।’

খালেদা জিয়ার বক্তব্যটিকেও এ্যানি ছাত্রদলের নতুন কমিটির বিষয়ে ইঙ্গিত বলে ধারণা করছেন। ছাত্রদলের সাবেক এই সভাপতি বলেন, ‘ওইদিনের বক্তব্যে দলের চেয়ারপারসন নতুন কমিটির বিষয়ে  একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। সুতরাং আমরা ধরে নিতে পারি, শিগগিরই পার্টির নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্ত জানাবেন তিনি।’

ছাত্রদল সভাপতি রাজিব আহসানকে ফোনে না পাওয়া গেলেও কথা বলেছেন ভারপ্রাপ্ত  সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ। তিনি বলেন, ‘দলের চেয়ারপাসনের মামলা চলছে। ছাত্রদল এ বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। আমাদের কমিটির বিষয়ে তিনি কনসার্ন আছেন। আমাদের অভিভাবকই সিদ্ধান্ত দেবেন, কখন কমিটি হবে।’

ছাত্রদলের এক নম্বর সহ-সভাপতি এজমল হোসেন পাইলট বলেন, ‘কমিটি হওয়া তো জরুরি। মামলার গতি যেদিকে যাচ্ছে, সে পরিপ্রেক্ষিতে চেয়ারপারসন যখন প্রয়োজন মনে করবেন, তখনই কমিটি দেবেন।’

ছাত্রদলে নতুন নেতৃত্বের জন্য যারা আলোচনায়

বিএনপির সূত্রগুলোর ভাষ্য মানলে, কমিটি দ্রুত দিলে রাজিব আহসানকে আবারও দায়িত্বে রাখতে পারেন খালেদা জিয়া। এক্ষেত্রে আকরামুল হাসান বাদ পড়তে পারেন। তবে সম্পর্ক রক্ষার দিক থেকে ক্ষেত্রবিশেষে আকরামের থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়নি সূত্রটি।

তবে বিএনপির গঠনতন্ত্র ও ঐতিহ্য পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, রাজিব আহসান বা আকরামুল হাসানের কোনও সম্ভাবনাই নেই। তারা দু’জন ও সিনিয়র সহ-সভাপতি মামুনুর রশীদ মামুন—এই তিন জনই বিএনপির নতুন নির্বাহী কমিটির সদস্য। আবার ঐতিহ্য হিসেবে দেখলেও তাদের কারও নতুন কমিটিতে ঠাঁই পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। রাজিব বা আকরাম কমিটিতে স্থান পেলে তা বিরল ইতিহাস হিসেবেই পরিগণিত হবে সংগঠনে।

ছাত্রদলের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে তাদের ইচ্ছার বিষয়ে জানা গেছে। প্রত্যেকেই নিজের প্রকাশে অনীহা জানালেও সভাপতি বা সেক্রেটারি ক্যান্ডিডেট হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন।

বর্তমান সভাপতি, সেক্রেটারি ও সিনিয়র সহ-সভাপতির বাইরে যাদের নাম ইতোমধ্যে ছাত্রদলে আলোচনায় এসেছে, তারা হলেন, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ, সহ-সভাপতি এজমল হোসেন পাইলট, নাজমুল হাসান, আলমগীর হাসান সোহান, আবু আতিক আল হাসান, সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার, যুগ্ম সম্পাদক বায়েজিদ আরেফীন ও আবুল হাসান। এই নামের তালিকার সঙ্গে সংগঠনের প্রায় শীর্ষপর্যায়ের ছয়জন নেতার সম্মতি রয়েছে।

আবার মহানগরের একনেতার দাবি, এই তালিকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি রফিকুল ইসলাম রফিকও আছেন।

ছাত্রদলের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে জানায়, সহ-সভাপতি থেকে ছাত্রদলের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়নি। এদিক থেকে বিবেচনা করলে সভাপতি ও  সহ-সভাপতিদের সুযোগ নেই।
ছাত্রদলের শীর্ষ একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রথা বা ঐতিহ্যরক্ষা করা হলে আগের কমিটির যুগ্ম  বা সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা নেতারাই এগিয়ে থাকেন। এ তালিকায় যাদের নাম আছে, তারা হলেন সহ-সভাপতি মামুন বিল্লাহ, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ, যুগ্ম সম্পাদক মিয়া রাসেল, কাজী মুকতার হোসেন ও নুরুল হুদা বাবু।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রদল নেতার ভাষ্য, পদপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ফাইট হয় বিশেষ করে যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যেই।

বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা মনে করেন, অপেক্ষাকৃত তরুণদের কমিটি দেওয়ার পক্ষে থাকলেও আসন্ন কমিটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন না খালেদা জিয়া বা তারেক রহমান। বিগত দিনে যারা রাজপথে ছিলেন এবং যাদের ওপর কেন্দ্রীয় নেতাদের আস্থা বেশি, তাদেরই কমিটিতে সামনে আনা হবে।

এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার চেয়ে ছাত্রদলের সভাপতি বেশি বলতে পারবেন। সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করলে ভালো বলতে পারবেন, কেন কমিটি হচ্ছে না বা কবে নতুন কমিটি হবে।’

রুহুল কবির রিজভীর পরামর্শ শুনে আবারও শনিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে ফোন করা হলেও রাজিব আহসান কোনও রেসপন্স করেননি।