করোনার অনিশ্চয়তাকে বাজেটে আমলেই নেওয়া হয়নি: মির্জা ফখরুল

প্রস্তাবিত বাজেটে করোনাভাইরাসের প্রকোপের অনিশ্চয়তাকে আমলে নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। দলটি মনে করে, কোভিডের মহাসংকট থেকে রক্ষার দিকনির্দেশনা এবং করোনার টিকার সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ বাজেটে অনুপস্থিত। শুক্রবার (৪ জুন) গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বাজেট-পরবর্তী দলীয় আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। লিখিত বক্তব্যে তিনি ৩৪টি পয়েন্টে বাজেট প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন।

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী দুই হাত ভরে দিয়েছেন ব্যবসায়ীদের। বাজেটে হতাশ মধ্যবিত্তরা, খুশি ব্যবসায়ী মহল। করপোরেট কর হার কমানো হয়েছে। ব্যবসায়িক টার্নওভার কর হার কমেছে। বাজেটে নানাভাবে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হয়েছেন। কিন্তু বাজেটে সাধারণ মানুষের জন্য তেমন কোনও ছাড় দেওয়া হয়নি।’

‘বিদ্যমান কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে অর্থনীতিতে আরও বেশি সংকোচন ঘটতে পারে’ উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সীমাবদ্ধতা মোকাবিলায় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কর্মসূচি নেওয়া হলে করোনার দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউয়ের তীব্রতা থেকে রেহাই পাওয়া যেত। বিশ্ব যখন সম্প্রসারণশীল নীতির দিকে ঝুঁকছে, বাংলাদেশে তখন রাজস্ব ব্যয় আরও সংকুচিত হয়েছে।’ এ সময় তিনি অভিযোগ করেন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতির কারণে ঘোষিত ঋণভিত্তিক প্রণোদনা ক্ষতিগ্রস্ত কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পৌঁছাতে পারেনি।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘করোনার টিকা প্রদানের জন্য কোনও সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। সরকার ২৫ লাখ মানুষকে মাসে টিকা দেওয়ার কথা বলেছে। সেটা কবে থেকে কার্যকর হবে, কীভাবে হবে, সে সম্পর্কে কিছু নিশ্চিত বলা হয়নি।’

প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘দুর্নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষার বাজেট’ উল্লেখ করে ফখরুল বলেন, ‘বিদেশি ঋণ জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে পরিশোধ করা হবে। সার্বিকভাবে বাজেট বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ নিশ্চিতে সুনির্দিষ্ট পথরেখা নেই।’

তিনি বলেন, ‘বাজেটে দিন আনে দিন খায় এমন গোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা রক্ষায় নগদ অর্থ (ক্যাশ ট্রান্সফার)-এর কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নেই। এ খাতে পুরাতন ত্রুটিপূর্ণ ব্যাংকনির্ভর ঋণের কথাই বলা হয়েছে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, বাজেটে প্রণোদনার বরাদ্দ ৫ থেকে ৭ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছিল বিএনপি। অনেক দেশে বাজেটে প্রণোদনার বরাদ্দ ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু সরকারের বরাদ্দ ২ শতাংশের নিচে। ফখরুলের মন্তব্য, ‘এটা লোক দেখানোর প্রণোদনা। এটা সচ্ছলতা এবং ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে না।’

মধ্যবিত্ত হতাশ
মধ্যবিত্তকে বাজেট হতাশ করেছে বলে মনে করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সম্প্রসারণের নামে যে সামান্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তা নিতান্তই অপ্রতুল। মধ্যবিত্তদের সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অন্তর্ভুক্ত করার কোনও ঘোষণা দেওয়া হয়নি, যা মধ্যবিত্তকে হতাশ করেছে।’

সরকারের ঘোষিত ‘প্রণোদনা বিতরণ চিত্র তথৈবচ’ বলে সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘সরকারি ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে কেবল অর্থ মন্ত্রণালয়ের রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বরাদ্দ ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিলের পুরোটাই বাস্তবায়িত হয়েছে। অন্য খাতে ঘোষিত প্রণোদনা বিতরণ চিত্র তথৈবচ। অগ্রগতি মাত্র ৬০ শতাংশ।’

‘স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির সেই ১ শতাংশের মধ্যেই আছে’ জানিয়ে ফখরুল বলেন, ‘এই বরাদ্দ দিয়ে স্বাস্থ্য খাতের চাহিদা মিটবে না। অন্যদিকে বরাদ্দ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও স্বাস্থ্য খাত পিছিয়ে আছে।’

সংস্কারের পরিকল্পনা নেই
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটটি দেশের ৫০তম বাজেট। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তোরণের সময় এটা। কিন্তু বাজেটে সে লক্ষ্যে বড় কোন সংস্কার পরিকল্পনার উল্লেখ নেই। আয় ও ব্যয়ের সামর্থ্য বৃদ্ধি, বিশেষ করে গুণগত মান বজায় রেখে ব্যয় করার অক্ষমতা নিরসনে কোনও সংস্কারমূলক কার্যক্রমের পরিকল্পনা নেই বাজেটে।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রণোদনা তহবিল দেওয়া হচ্ছে আগের মতো ব্যাংকের মাধ্যমে। অথচ ব্যাংক সেক্টর সংস্কারের কোনও কথাই বলা হলো না। কর ব্যবস্থা সংস্কারেরও বড় কোনও সংস্কার প্রস্তাবও নেই। মানুষের হাতে টাকা না থাকলে চাহিদা বাড়বে না। চাহিদার অভাবে আরও শ্লথ হয়ে পড়বে অর্থনীতি। হতদরিদ্র মানুষের জীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠবে।’

বাজেটে মৎস্য চাষের ওপর নতুন করে করারোপ বাতিলের দাবি জানান মির্জা ফখরুল। আর মাইক্রোবাস ও হাইব্রিড গাড়ি আমদানিতে শুল্কহার কমানোর সরকারি সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন তিনি। তার মতে, এমনিতেই ট্রাফিক জ্যাম, তার ওপর আরও কম দামে গাড়ি আমদানি উৎসাহ করা হলো।

ফখরুল যোগ করেন, ‘যে প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতি বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাদের জন্য বাজেটে কোনও পদক্ষেপ নেই।’

প্রস্তাবিত বাজেটের প্রতিক্রিয়া জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

কেমন বাজেট চায় বিএনপি
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এবারের বাজেট কেবল বার্ষিক হিসাব-কিতাবের বাজেট হওয়ার কথা নয়। বাজেট হওয়া উচিত ছিল ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতিমালার পথনির্দেশনা এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বাজেট। ভবিষ্যতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের মডেল কী হতে পারে, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বাজেটের ফোকাস কী হবে, তার পথনির্দেশনার বাজেট। কিন্তু সরকার সেদিকে যায়নি।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সংকোচন রোধ ও পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠনের কর্মসূচি জরুরি। এ কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে হবে দুটো ইউনিট- খানা বা গৃহস্থালি এবং কারবার বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। অভিঘাত মোকাবিলার জন্য প্রতিটি খানায় সরাসরি নগদ অর্থ পৌঁছাতে হবে।’

তিনি যোগ করেন, ‘দ্বিতীয়ত, নীতি-কৌশল ও বরাদ্দের সবচেয়ে বেশি মানুষ নিয়োজিত খাতগুলোতে অধিক প্রাধান্য দিতে হবে। কুটির, ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে সহায়তা বাড়াতে হবে। রফতানিমুখী শিল্পের উৎপাদনে ও বাণিজ্যে বৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান ধরে রাখতে হবে।’

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোহাম্মদ শামছুল আলম, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, বন ও পরিবেশ সম্পাদক মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, বিএনপির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক জেড খান রিয়াজউদ্দীন নসু, চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার, সহ-বন ও পরিবেশ সম্পাদক কাজী রওনাকুল ইসলাম টিপু, চেয়ারপারসনের প্রেস উইং সদস্য শামসুদ্দিন দিদার।