দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে ‘না’

বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ওপর ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টাদের ক্ষোভ!

৩ দিনব্যাপী বৈঠকের প্রথম দিনে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক দিকগুলো তুলে ধরে দলের শীর্ষ নেতাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্যরা। মঙ্গলবার (১৪ সেপ্টেম্বর) বিকাল চারটা থেকে শুরু হয়ে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বৈঠকে দলের প্রায় ৩০ জন নেতা বক্তব্য রাখেন। বৈঠকে অংশ নেওয়া অন্তত ১৫ জন ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয় উঠে আসে।

তারা জানান, অধিকাংশ নেতা কোনও অবস্থাতেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। দলের কৌশল নির্ধারণের আগে আগামী দিনে আন্দোলনের নেতৃত্ব গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। কার্যকর নেতৃত্ব গড়ে তুলতে প্রয়োজনে রাজপথে সক্রিয় নেতাদের সমন্বয়ে তালিকা করার পক্ষে মত দেন তারা।

উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আতাউর রহমান ঢালী বলেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আন্দোলন গড়ে তোলা, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার মত দিয়েছেন নেতারা। দলের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করেছেন সবাই।

রাত আটটার দিকে বৈঠক থেকে বিরতি নিয়ে বাইরে আসেন উপদেষ্টা কবি আবদুল হাই শিকদার। জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুব সিরিয়াস আলোচনা হয়েছে।

দলের একজন উপদেষ্টা বৈঠকের বিরতির সময় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক নানা ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে দলের জ্যেষ্ঠনেতাদের উদ্দেশ্য করে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। খালেদা জিয়ার মুক্তি নিশ্চিত না করা, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণসহ কয়েকটি ইস্যুতে বিএনপির কৌশল ভুল ছিলো, বলে জানান তারা। আর এই ভুলের পেছনে শীর্ষনেতাদের ভূমিকাই বড় কারণ বলে জানান তারা।’

দলের কয়েকজন উপদেষ্টা ও ভাইস চেয়ারম্যান জানান, আলোচনায় কয়েকটি বিষয় এসেছে। দলের কাউন্সিল প্রসঙ্গ, নেতৃত্ব নবায়ন, ছাত্ররাজনীতি, শ্রমিক রাজনীতিসহ সামগ্রিক রাজনৈতিক সচেতনতা নির্ভর নেতৃত্ব গঠন, অর্থনৈতিক সংকট, বিচার বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্য। এক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতির সামনে দলীয়ভাবে যে আহ্বান রাখা হবে, সেই বিষয়টিকে মূলকেন্দ্রে রেখেই শীর্ষনেতারা আলোচনা এগিয়ে নেন।

জানতে চাইলে উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার মঙ্গলবার রাতে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বৈঠকে সবাই একসুরে বলেছেন— নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাওয়ার কোনও সুযোগ নাই। এটাই মূল কথা। দলীয় সরকারের ২০১৮ সালের নির্বাচনে গিয়ে দেখেছে। সরকার কী ভূমিকা রাখে। নির্বাচন কমিশন কী ভূমিকা রাখে, তা তো দেখাই গেলো। দিনের নির্বাচন রাতে হয়ে যায়।

বৈঠকে দলের শীর্ষনেতাদের উদ্দেশ্য করে কয়েকজন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তৈমুর আলম বলেন, এটা তো দলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, এসব নিয়ে কথা না বলার জন্যই দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

মঞ্চে শীর্ষনেতারা

‘বুঝেশুনে ঐক্য করা আর ছাত্রদলে আন্দোলনমুখী নেতৃত্ব আনার মত’

একাধিক আলোচক জানান, নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন এবং দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে অধিকাংশ নেতা আন্দোলন জোরদার করার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদলকে আন্দোলনমুখী করতে নেতৃত্ব পরিবর্তনের মত দিয়েছেন। কোনও-কোনও সদস্য মত দিয়েছেন— নির্বাচনি ঐক্য করার আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বুঝে-শুনে ঐক্য করতে।

সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে বিরতি দেয়া হয় বৈঠকে। এই দুইঘন্টায় ২৮ জন ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা বক্তব্য দেন। রাত পৌনে আটটার দিকে দুজন উপদেষ্টা মিটিং থেকে বেরিয়ে চলে যান। তারা জানান, বাসায় কাজ থাকায় তারা চলে যাচ্ছেন।

স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য বৈঠকে আসেননি, কেন?

বৈঠকে স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান আসেননি। এ বিষয়ে মির্জা আব্বাসকে ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। রাতে জমির উদ্দিন সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি তো জানি না। মনে হয় পরের বার জানাবে।’

পরে রাতে বৈঠক শেষে বেরোনোর সময়  জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি এটা বলতে পারবো না, কিচ্ছু বলতে পারবো না।’

বৈঠকসূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির প্রত্যেক সদস্যেরই প্রতিটি বৈঠকে অংশ নেওয়ার কথা ছিল না। সুনির্দিষ্ট ভাবে আলাদা করে কয়েকজন সদস্যের থাকার কথা ছিল। আবার কোনও কোনও সদস্যকে সবগুলো বৈঠকেই উপস্থিত থাকার কথা জানানো হয়েছে।

 ‘মুখ খুলতে মানা’

মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটায় বৈঠক শেষ হওয়ার পর বেশ কয়েকজন সদস্য একে অপরের কাছে, বক্তব্য কেমন হয়েছে— প্রতিক্রিয়া জানতে চান। জবাবে কোনও নেতা বলেন, ‘ভালো বলেছেন, কড়া কথা বলেছেন।’   বরকত উল্লাহ বুলু বৈঠক থেকে বেরিয়ে স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের কাছে মন্তব্য করেন, ‘মহাসচিব আমার ওপর ক্ষেপলো ক্যান?’ অবশ্য এমন প্রশ্নে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সৌহার্দ্য দেখান।

এসময় প্রায় ডজনখানেক নেতার কাছে প্রশ্ন ছিল, বৈঠক কেমন হয়েছে? ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘মুখ খোলা যাবে না। কথা বলতে মানা।’ তার মতো প্রায় প্রত্যেকেই জানান, কথা না বলতে বলা হয়েছে। যা বলার মহাসচিব বলবেন।

পরে আটটা চল্লিশ মিনিটে মির্জা ফখরুল অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজকে আমাদের রুটিন সভা ছিল। বৈঠকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক আলোচনা হয়েছে। ধারাবাহিক এই বৈঠকের পর দলীয় অবস্থান তুলে ধরা হবে।’

স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আজকের বৈঠকে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। সিরিজ বৈঠকের অংশ হিসেবে প্রথম দিন গেলো। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সিদ্ধান্তমূলক কোনও বক্তব্য দেননি। তবে করোনার মধ্যে দলের নেতাদের সহযোগিতা নিয়ে কথা বলা হয়েছে।’

বৃহস্পতিবার বৈঠকের শেষ পর্ব অনুষ্ঠিত হবে বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সঙ্গে। এরপর শনিবার স্থায়ী কমিটির বৈঠকে পুরো বৈঠক নিয়ে পর্যালোচনা করা হবে। দলের পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে বিএনপি, এমন কথা জানিয়েছেন স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য।