কলকাতার সাংবাদিককে তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার দেওয়ার নেপথ্যে

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তথা দেশে আইনের চোখে একজন ‘পলাতক’ ও দণ্ডিত আসামি তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে স্বেচ্ছা নির্বাসনে রয়েছেন ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো তিনি কোনও সংবাদমাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, আর সেটি দিয়েছেন একজন ভারতীয় সাংবাদিককে।  

আমেরিকাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘দ্য ডিপ্লোম্যাটে’ তারেক রহমানের ওই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে গত ১৮ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার)। আর সাক্ষাৎকারটি যিনি নিয়েছেন, কলকাতার সেই বাঙালি সাংবাদিকের নাম স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য।

স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য ভারতের দ্য ওয়ার, স্ক্রোল, ফার্স্টপোস্ট-সহ বিভিন্ন পোর্টালে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও গবেষণাধর্মী লেখালেখি করেন। ‘মিশন বেঙ্গল: আ স্যাফরন এক্সপেরিমেন্ট’ (পশ্চিমবঙ্গ দখলে বিজেপির অভিযান নিয়ে) এবং ‘লালগড় অ্যান্ড দ্য লেজেন্ড অব কিষানজি’ (মাওবাদী আন্দোলন নিয়ে) নামে দুটি গ্রন্থেরও লেখক তিনি।  

তবে, সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশে একাধিক মামলায় আদালতে সাজাপ্রাপ্ত ও ‘পলাতক’ তারেক রহমানের বক্তব্য মিডিয়াতে প্রকাশের ক্ষেত্রে দেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ঠিক এ জন্যই পশ্চিমা একটি সাময়িকীতে প্রথমবারের মতো তারেকের সাক্ষাৎকার প্রকাশের পরও সেটির বিষয়বস্তু বাংলাদেশের কোনও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি।

কিন্তু মুচলেকা দিয়ে লন্ডনে যাওয়ার এত বছর বাদে এবং দেশে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের ঠিক আগে তারেক রহমান কেন হঠাৎ সাক্ষাৎকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, তাও আবার কলকাতার একজন সাংবাদিককে, এ নিয়ে বিএনপির বিভিন্ন স্তরে নেতাকর্মীদের মধ্যেও তীব্র কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে।

স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য

এতদিন ধরে তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে আয়োজিত বিভিন্ন সভা-সমাবেশ বা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা ভিডিও’র মাধ্যমেই তার যাবতীয় রাজনৈতিক বার্তা দিয়ে এসেছেন। কিন্তু এভাবে সাক্ষাৎকারের আশ্রয় নেওয়াটা এই প্রথম। সে জন্যই প্রশ্ন উঠেছে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তারেক আসলে ঠিক কোনও লক্ষ্য হাসিল করতে চেয়েছেন?

এ ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে যা জানা যাচ্ছে, তা বেশ চমকপ্রদ। মূলত যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বকে বিএনপির নির্বাচন বয়কটের যৌক্তিকতা বোঝানোর জন্যই যে তারেক রহমান এই সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

আর স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যকে এই সাক্ষাৎকারটি পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা ছিল দুজন বিএনপি নেতার— ঢাকায় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও বিএনপির যুক্তরাজ্য শাখার শীর্ষ নেতা এম এ মালেকের। 

রুহুল কবির রিজভী ও এম এ মালেক

ঢাকা ও লন্ডনে বিএনপি নেতৃত্বের বিভিন্ন পর্যায়ে কথাবার্তা বলেই এই সাক্ষাৎকারের ঘটনাক্রম সম্পর্কে বাংলা ট্রিবিউন জানতে পেরেছে। 

আসলে এর আগে গত মাসের শেষ দিকে আল জাজিরার জন্য স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভীর একটি সাক্ষাৎকার নেন। ২৯ নভেম্বর ডেটলাইনে প্রকাশিত ওই সাক্ষাৎকারে রুহুল কবির রিজভী জানিয়েছিলেন—কেন তারা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে ‘প্রহসন’ বলে মনে করছেন এবং কেন বিএনপি সেই ‘প্রহসনের নির্বাচনে’ অংশ নেবে না।

ওই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হওয়ার পরই সাংবাদিক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য রুহুল কবির রিজভীকে অনুরোধ জানান, তাদের শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের একটি পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার নেওয়ার ব্যবস্থা করিয়ে দিতে।

জামায়াতের সঙ্গে তারেকের সম্পর্ক এখনও অটুট

সাংবাদিক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য রিজভীকে আরও জানান, তারেক রহমান এই প্রস্তাবে রাজি হলে ওই সাক্ষাৎকারটি ‘দ্য ডিপ্লোম্যাটে’ প্রকাশিত হবে। ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ হলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত একটি সাময়িকী, যেটি মূলত এশিয়া-প্যাসিফিকের (এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল) ভূ-রাজনীতি ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো কভার করে থাকে। এর একটি অনলাইন সংস্করণও আছে।

এই প্রস্তাবে তারেক রহমান প্রথমে কিছুটা দ্বিধান্বিত থাকলেও পরে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তার বার্তা সরাসরি পৌঁছে দেওয়া যাবে—এটা ভেবে দিনকয়েকের মধ্যে রাজি হয়ে যান। বাংলাদেশে এবারের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে ‘অতি-সক্রিয়তা’ দেখাচ্ছে এবং পৃথক ভিসানীতি পর্যন্ত ঘোষণা করেছে এ কথা সবার জানা। সেই পটভূমিতেই তিনি ওয়াশিংটনের কাছে বিএনপির বক্তব্য সরাসরি পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন মনে করেছিলেন।

ডিপ্লোমেট

তারেক রহমানকে ওই সাক্ষাৎকার দিতে রাজি করানোর ক্ষেত্রে লন্ডনে তার অত্যন্ত আস্থাভাজন নেতা ও বিশ্বস্ত সঙ্গী এম এ মালেকেরও একটা বড় ভূমিকা ছিল বলে জানা গেছে।   

এরপর সাংবাদিক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যকে তারেকের জন্য ই-মেইলে একটি ‘কোয়েশ্চেনিয়ার’ বা প্রশ্নমালা আগাম পাঠাতে বলা হয়। কয়েকটি প্রশ্নের সরাসরি উত্তর এড়িয়ে গিয়ে তারেক রহমানের পক্ষ থেকে তার উত্তরও পাঠানো হয়। কয়েকটি উত্তর নিয়ে আরও প্রশ্ন থাকায় সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক তারেক রহমানের সঙ্গে সরাসরি ফোনে কথা বলারও অনুরোধ জানান, বিএনপি নেতা তাতেও সম্মতি দেন। 

ফলে বলা যেতে পারে, কলকাতা আর লন্ডনের মধ্যে ইমেইল আর টেলিফোন আলাপের ভিত্তিতেই শেষ পর্যন্ত এই সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বয়ানটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।

কিন্তু এত বছরের মধ্যে তার প্রথম সাক্ষাৎকারটি তারেক রহমান একজন ভারতীয় সাংবাদিককেই কেন দিলেন? 

এর জবাবে বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বিএনপির একজন নেতা জানাচ্ছেন, ‘আসলে ভারতীয় বলে বিষয় নয়। পশ্চিমা বিশ্বের কাছে আমাদের বার্তাটা সরাসরি পৌঁছে দিতেই তারেক রহমান ওনার প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন। দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশের জন্য পোল্যান্ড বা পেনসিলভানিয়া থেকে কোনও সাংবাদিক এই অনুরোধ করলে তাকেও নিশ্চয় উনি প্রত্যাখ্যান করতেন না!’