বিএনপিকে সংস্কারবিরোধী বলা পরিকল্পিত অপপ্রচার: মির্জা ফখরুল

‘বিএনপিকে সংস্কার বিরোধী’ বলে একটি মহল ‘অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

রবিবার (৬ জুলাই) সকালে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব এ মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, ‘‘মিডিয়ার কিছু অংশ ও কিছু ব্যক্তিত্ব— তারা বিএনপির সংস্কার সম্পর্কে বিভিন্ন রকম কথা বলছেন, যেগুলো সঠিক নয়। বিএনপির কমিটমেন্ট টু রিফর্মস—এটা কোয়েশন করার কোনও সুযোগ নেই্। বিএনপি হচ্ছে সেই দল, ২০১৬ সালে বেগম খালেদা জিয়া ‘ভিশন-২০৩০’ সংস্কারের কথা বলেছিলেন। তারপরে বিএনপি ’২২ সালে ২৭ দফা এবং অন্যান্য দলের সঙ্গে আলোচনা করে ’২৩ সালে ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি আমরা দিয়েছি। এটাতে আমরা আন্তরিক বলেই কিন্তু ৩১ দফা নিয়ে সারা দেশে অসংখ্য প্রোগ্রাম করেছি। জনগণের কাছে যাওয়া হয়েছে। সুধী সমাজ, সুশীল সমাজের কাছে যাওয়া হয়েছে, তাদেরকে বলা হয়েছে।”

‘‘আজকে একটা মহল, একটা চক্র অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিএনপিকে সংস্কারবিরোধী বলে প্রচার করবার একটা অপচেষ্টা চালাচ্ছে।”

১৫ বছর গণতন্ত্র ফেরানোর আন্দোলনে বিএনপির শক্ত অবস্থানের কথা তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘আমাদের কত কর্মসূচি, কত সমাবেশ, কত লাঠিপেটা আপনারা দেখেছেন, আপনারা কাভার করেছেন। এখন বিএনপিকে নিয়ে এই প্রশ্নটা কেন করে?  এটাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছাড়া আমি কী বলবো?”

‘‘একটা গোষ্ঠীর বিএনপিকে মেলাইন করা, তাকে ভুলভাবে চিত্রিত করার প্রচেষ্টা চালানো মাত্র। কোনও একজন ব্যক্তি বা কয়েকজন ব্যক্তি বা কয়েকটি গোষ্ঠী মিথ্যা প্রচারণা সমানে করে যাবে, আর সেটাতে তারা মনে করবেন, জনগণ খুব সাড়া দিচ্ছে। জনগণ সাড়া দিচ্ছে না। জনগণ বলতে গুটিকতক শহুরে লোক নয়, জনগণ বলতে সারা বাংলাদেশ।”

তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি প্রমাণ করেছে, এখানে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সংস্কার আমাদের দলের প্রতিষ্ঠা জিয়াউর রহমান করেছেন। বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সংগঠন করবার স্বাধীনতা, সংসদীয় গণতন্ত্র, এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নিয়ে তিন-তিনটা নির্বাচন, সব কিছুই বিএনপি। মুক্ত বাজার অর্থনীতি, অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতকে নিয়ে আসা এবং ইমার্জিং টাইগার এসব বিশেষণে ভূষিত হয়েছে। সবকিছুই সংস্কারের মাধ্যমে বিএনপি করেছে। এই যে ভিএটি(ভ্যাট) প্রথা, এটা নিয়ে কত কথা আমাদেরকে শুনতে হয়েছে, ওই সময়।”

‘‘এসব জিনিস ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে, বিএনপি সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া, তার সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করার চেষ্টা, এটাতে লাভ হবে না। কারণ, বাংলাদেশের মানুষ বিএনপিকে চিনে, বাংলাদেশের মানুষ বিএনপির সঙ্গে থেকেছে। যা কিছু ভালো অর্জন বিএনপি সেখানে থেকেছে এবং বিএনপি নেতৃত্ব দিয়েছে।”

যারা নির্বাচন বিলম্বিত চায়, তারা গণতন্ত্রের শক্তি নয়

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘নির্বাচনকে যারা বিলম্বিত করতে চায়, তারা নিশ্চয়ই গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি নয়, তারা নিশ্চয়ই জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পক্ষের শক্তি নয়।”

গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় সংস্কার কমিশনে সংস্কার নিয়ে বিএনপি কোন কোন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে, তার একটি পরিসংখ্যানও তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব।

জুলাই ঘোষণা: বিএনপির মতামত বহু আগে দেওয়া হয়েছে

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘জুলাই ঘোষণাপত্রের ব্যাপারে আমরা অনেক আগে প্রথম যে প্রস্তাব ছিল— আমরা আমাদের মতামত দিয়ে দিয়েছি। এটা বহু আগে দিয়েছি। তারপর তো সরকার বলেছে— তারা দায়িত্ব নিয়েছে তারা করবে। এখনও পর্যন্ত তারা কিছু আনেনি।”

‘‘আমরা যেকোনও সময়ে যেকোনও ব্যাপারে আলোচনায় সব সময় ছিলাম, এখনও আছি। এ ব্যাপারে আমাদের কোনও সমস্যা নেই।”

স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘‘জুলাই সনদের মতামত আমরা বহু আগে দিয়ে দিয়েছি। যারা করছে না, এটা তো আমাদের দায়িত্ব না। যাদের দায়িত্ব তারা যদি কোনও কারণে বিলম্ব করে, তার দায় বিএনপি নেবে না। এ দায় বিএনপির না।”

বিএনপির প্রত্যাশা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন

সংস্কার ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে নির্বাচন হতে পারে না, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে যে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে  মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘আমরা পরিষ্কার করে বলেছি, আমরা মনে করি, জনগণ নির্বাচন চায়, যেটা আলোচনা হয়েছে— আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেব এবং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের। আমরা আশা করি, সেই লক্ষ্যেই দেশ এগিয়ে যাবে।”

জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) প্রসঙ্গে

স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘আমরা পরিষ্কারভাবে বলেছি, দেশে যাতে পুনর্বার কোনও স্বৈরাচারের উৎপত্তি না হয, উৎপাদন না হয়, ফ্যাসিজমের কোনও উৎপাদনের ব্যবস্থা না থাকে সেজন্য। পৃথিবীর কোনও দেশে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারিত থাকার কোনও নজির নেই। এ সত্ত্বেও আমরা বলেছি, বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের কমিটি, স্ট্যাডিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনও ব্যক্তি ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রীর আসনে বহাল থাকবে না।”

‘‘এটার সঙ্গে আমরা বলেছি, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নির্বাহী বিভাগকে কার্যকরভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে তার কোনও পরিধির মধ্যে অন্য কোনও অর্গান এবং অন্য কোনও বডি সৃষ্টি করে, যাতে তার (প্রধানমন্ত্রীর) কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত না করে, সেজন্য আমরা এনসিসি জাতীয় কোনও ধারণার সঙ্গে একমত হইনি। এটাই ছিল আমাদের শর্ত।”

তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে থাকা সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘‘আশা করি, আমরা একটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবো। আলাপ-আলোচনা হচ্ছে তবে দীর্ঘ আলোচনা কাম্য নয়।”

‘‘এ বিষয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে খুব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো, সাংবিধানিক বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে আসা যাবে। আমরা আশাবাদী।”

সংখ্যানুপাতিক ভোট (পিআর) প্রসঙ্গে

স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘‘যারা এ ব্যবস্থা চাচ্ছে আপনারা কি তাদের কাছে শুনেছেন, তারা কেমন পিআর পদ্ধতি চায়? গণতন্ত্র যেমন একটা কনসেপ্ট। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র বিভিন্নখভাবে অনুশীলন হয়। আমেরিকায় যেভাবে হয় ইংল্যান্ডে সেভাবে হয় না, ফ্রান্সে যেভাবে হয়, ভারতে তো সেভাবে হয় না, শ্রীলঙ্কায় যেভাবে হয় বাংলাদেশে তো সেভাবে হয় না। একেক দেশে একেক রকম পদ্ধতি আছে গণতন্ত্র কার্য্কর করার।”

‘‘তেমনি পিআর হলো একটা কনসেপ্ট একটা ধারণা। এটা বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে কার্যকর হয়। এখন যারা পিআরের কথা বলছেন, তারা কীভাবে পিআর বাস্তবায়ন হবে— এ ব্যাপারে কোনও কথা বলছেন না। তাহলে এই সম্পর্কে একটা অসস্পষ্ট ধারণাই থেকে যাচ্ছে। এটা আলোচনার জন্য আলোচনা হচ্ছে। আমরা মনে করি, এই রাষ্ট্রে জনগণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক জনগণ।”

ইভিএম পদ্ধতির কথা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘আমরা শুধু কীভাবে ভোটটা দেবো, এজন্য একটা ইভিএম পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল, সবার মনে আছে। কত বছর হলো? এই ইভিএম পদ্ধতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য অনেক প্রচার-প্রচারণা হয়েছে, যারা এ পদ্ধতি কার্য্কর করবে, তাদের প্রশিক্ষণ হয়েছে। সেই প্রশিক্ষণে যারা গেছেন তারা যে ভাতা নিয়েছেন, আপনারা দেখেছেন— এই নিয়ে দুর্নীতির অভিয়োগও হয়েছে। আবার তাদের মাধ্যমে সারা দেশে জনগণকেও প্রশিক্ষিত করার চেষ্টা হয়েছে। তারপরও আজ পর্যন্ত ইভিএম পদ্ধতি কার্য্কর হয়নি।’’

‘‘আর পিআর পদ্ধতি হলো গোটা নির্বাচনি ব্যবস্থাকে বদলে দেওয়া। এ নিয়ে জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে আপনাদের কারও, এই সম্পর্কে জনগণকে কেউ অবহিত করেছে এবং এ নিয়ে আপনাদের সঙ্গে কিংবা সুশীল সমাজ বলেন, কিংবা প্রতিনিধিনিত্বশীল যেসব প্রতিষ্ঠান বলেন, এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের যেসব সংগঠন আছে, তাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা হয়নি। এটান (পিআর) অত্যন্ত একটা প্রাথমিক পর্যায় আছে। ফরমালি এ নিয়ে আলোচনা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে শুরুই হয়নি। অথচ এ নিয়ে আমাদের কিছু কিছু সহকর্মী বলছেন, এটা হতেই হবে, না করলে ইলেকশনই করা যাবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। এর মানেটা কী?”

নজরুল বলেন, ‘‘আমাদের মহাসচিব বলেছেন, আমরাই সংস্কার বেশি চাই। আমরাই বেশি সংস্কার করেছি। যুগান্তকারী যেসব সংস্কার বাংলাদেশে, এটা আমরা করেছি। ওনারা কেউ যখন সংস্কারের ‘স’ উচ্চারণ করেনি, তখন আমরা পূর্ণাঙ্গ সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি। সেই বিএনপিকে অভিযুক্ত করে, এটা খুবই অন্যায়।”

‘‘এটার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটা ভালো না। আমরা রাজনীতি করি, সমালোচনার মুখোমুখি হতে রাজি আছি। কিন্তু ‍রাষ্ট্র এবং এই যে লাখো শহীদ মুক্তিযুদ্ধে, হাজারো শহীদ বিভিন্ন আন্দোলনে বিশেষ করে চব্বিশের অভ্যুত্থানে, তাদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংহতিপূর্ণ হতে হবে রাজনৈতিক দলের কার্য্ক্রম। যেকোনও একটা সিস্টেম চালু করতে হলে জনগণের সম্মতি নিতে হবে। আমরা যেটা মনে করি, খুব চিন্তাভাবনা করে বড় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয়। এটা কোনও বিশেষ দলের সুবিধা হবে— এই রকম সিস্টেমে, সে কারণে করতে হবে, এটা হয় না। চেষ্টা করতে হবে যেটা জনগণের সুবিধা হবে সেটা।”

পিআর ভোট: তারা জানবে না তার প্রতিনিধি কে

নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘‘পিআর একটা সিম্পল কথা… যারা ভোট দেবে তারা কেউ জানতে পারবে না, তার প্রতিনিধি কে হবে? হয় এটা?”

‘‘কিন্তু তারপরও বিষয় যখন আসবে আমরা আলোচনা করবো। আমাদের আলোচনা করতে কোনও বাধা নেই। আমাদের প্রতিনিধিরা সারাদিন আলোচনা করছেন। অন্যান্য দলের প্রতিনিধিদের বক্তব্য তারা শুনছেনও।”

বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায়

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘কোনও উদ্দেশ্যে এটা করা হচ্ছে, এটা বুঝা দরকার। আমরা আগেই বলেছি, বিএনপি পরীক্ষিত রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক দল। আজকে আবার জোর  দিয়ে বলতে চাই, বিএনপি একটি উদারপন্থি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল।  এখানে কিন্তু আমাদের কোনও রাগ-ঠাগ নেই খুব সোজা কথা। আমরা নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যেতে চাই। আমরা কোনও বিপ্লবের মাধ্যমে বা অন্য কিছুর মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে চাই না।”

‘‘আমাদের উদ্দেশ্য নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ থাকার প্রশ্নই উঠতে পারে না। আমরা ১৫ বছর ধরে লড়াই করছি, সংগ্রাম করছি একটা মাত্র উদ্দেশ্যে— আমরা গণতন্ত্রের ফিরে যেতে চাই। গণতন্ত্র ধবংস করে দিয়েছে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার। আমরা গণতন্ত্র ফিরে যেতে চাই। তার প্রাথমিক কাজটা হচ্ছে আমরা আমাদের ভোটাধিকার ফিরে পেতে চাই, বাক স্বাধীনতা চাই, বিচারের অধিকার ন্যায় বিচার চাই।”