জামায়াতের বায়তুল মাল: শেষ পর্ব

যে কারণে ‘ফুলটাইমাররা’ বায়তুল মালের টাকার ওপর নির্ভরশীল

জামায়াতে ইসলামীজামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের সব ব্যয় দলীয় ফান্ড থেকে (বায়তুল মাল) জোগান দেওয়া হলেও গত কয়েক বছরে অর্থনৈতিকভাবে চাপ বেড়েছে দলটিতে। ‘পরিস্থিতির’ কারণে তৈরি এই চাপ সামলাতে ব্যয় হচ্ছে বায়তুল মালের অর্থ। দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বায়তুল মালের ওপর চাপ বৃদ্ধির মূল কারণ ‘ফুলটাইমার’রা। গত ১০ বছরে এই ফুলটাইমারদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে নানা কারণে।

জামায়াতের ঢাকা মহানগরের একাধিক দায়িত্বশীল নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের ফুলটাইমারদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও তাদের সম্মানী বাবদ ব্যয় বৃদ্ধির পেছনেও বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।

প্রথমত, জামায়াতের অনুজ সংগঠন ‘ছাত্র শিবির’রে পাঠ শেষ করে মূল সংগঠনে যুক্ত হয় বেশিরভাগ নেতাকর্মী। শিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, সেক্রেটারিসহ শীর্ষ নেতারা পরে জামায়াতের বিভিন্ন ইউনিট কমিটির দায়িত্ব পালন করেন। এক্ষেত্রে শিবিরের সভাপতি, সেক্রেটারি সাংগঠনিকভাবেই কোনও চাকরি করতে পারেন না। তাই ছাত্র জীবন শেষে তারা মূল সংগঠনেও এই সুবিধা (ফুলটাইমার হিসেবে সম্মানী) নিশ্চিত করতে চান। বর্তমানে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির বেশিরভাগ নেতা আগে ছাত্র শিবিরের দায়িত্বে ছিলেন বলেও জানা গেছে।  

এ প্রসঙ্গে ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শিবিরের সভাপতি ও সেক্রেটারি সংগঠন থেকে সম্মানী পান। তার সময়েও এই সিসটেম ছিল। তিনি বর্তমানে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব।

দ্বিতীয়ত, গত ১০ বছরে বিশেষ করে ২০১১ সাল থেকে আওয়ামী লীগ জামায়াতের ওপর চাপ বৃদ্ধি করায় মামলা-মোকাদ্দমা বেড়েছে। জেলে রয়েছেন অসংখ্য নেতাকর্মী। আইনি প্রক্রিয়া বা সামাজিক সবভাবেই তাদের পাশে থেকেছে জামায়াত। জেল থেকে বেরিয়ে সরাসরি দলে যুক্ত থাকার চেষ্টা করেছে অনেক নেতাকর্মী।

তৃতীয়ত, মামলার কারণে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরাও ফুলটাইমার হিসেবে দলে সক্রিয় থাকতে পছন্দ করেন। তাদের জন্য দলের বায়তুল মালের বরাদ্দ আছে।

চতুর্থত, গত ১০ বছরে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জামায়াতের অনেক নেতা। এদের সংখ্যা কেন্দ্রে যেমন আছে, তেমনি সারাদেশেও ছড়িয়ে আছে। প্রকাশ্যে স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা করতে সক্ষম না হওয়ায় ফুলটাইমার হিসেবে নাম লিখিয়েছেন অনেক নেতাকর্মী। তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে হয় বায়তুল মাল বিভাগকে।

পঞ্চমত, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে দণ্ডপ্রাপ্ত নেতাদের পরিবারের জন্য বরাদ্দ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলা লড়তে গিয়েও খরচ বাড়ে জামায়াতের। যদিও গত তিন বছরে এই খাত বাবদ খরচ কমেছে।

ষষ্ঠত, নির্যাতিত পরিবার-নেতাকর্মী ও দুর্বল জনশক্তির ওপর মৌসুমভিত্তিক ব্যয় আছে জামায়াতের। যার পুরোটাই বায়তুল মাল বহন করে। ঈদের সময় বিশেষ সাহায্য, এমনকি দুর্বল নেতাকর্মীদের সহযোগিতা করতে কোরবানি ঈদে এলাকাভিত্তিক পশু কোরবানিও দেওয়া হয় বায়তুল মালের টাকায়।

সপ্তম, আপ্যায়ন বাবদ একটি অংশ ব্যয় হয় সংশ্লিষ্ট বায়তুল মাল থেকে। বিশেষ করে প্রতিটি বৈঠকেই দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা ফলমূল ও  দামি খাবার খান। এই খাতে অর্থের একটি অংশ ব্যয় হয়। ঢাকা মহানগর জামায়াতের একাধিক কর্মী জানিয়েছেন, এমন কোনও বৈঠক নেই যেখানে খাবার সরবরাহ করা হয় না।

অষ্টম, নামে-বেনামে কার্যালয় ব্যবহারের পেছনেও অর্থ খরচ হয়। বর্তমানে মগবাজারের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও ঢাকা মহানগরের কার্যালয় বন্ধ থাকায় নামে-বেনামে কার্যালয় ভাড়া করে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে জামায়াত। এই ভাড়া বাবদ কেন্দ্রীয় বায়তুল মালের একটি অংশ ব্যয় করা হয়।  

জামায়াতে ইসলামীএছাড়াও জামায়াতে ইসলামীর কার্যবিবরণী অনুযায়ী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দলের কর্মসূচিরই একটা অংশ। ১৯৪১-১৯৪৪ সাল পর্যন্ত প্রথম সম্মেলনের বক্তব্য এই কার্যবিবরণীতে যুক্ত হয়েছে। দলের অর্থনৈতিক সক্ষমতা নিয়ে বরাবরই বাড়তি মনোযোগ ছিল জামায়াতের। তবে এই সরকারের নানা চাপে জামায়াত সমর্থিত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে জামায়াতের নেতাকর্মীরা।

বায়তুল মাল থেকে ফুলটাইমারদের সার্ভিস দেওয়ার বিষয় নিয়ে দলে এখনও কোনও প্রকাশ্য সমালোচনা নেই। তবে নেতাকর্মীদের অনেকে বলছেন, বায়তুল মাল ব্যবহার আরও পরিচ্ছন্ন ও সুনির্দিষ্ট না হলে আগামী দিনে প্রকাশ্যে প্রশ্ন উঠবে।

ছাত্র শিবিরের একটি সূত্র জানায়, ২০১০ সালে ছাত্র শিবিরে বায়তুল মাল সম্পর্কিত জটিলতা তৈরি হয়েছিল। ওই সময় সংগঠনের সভাপতি ছিলেন রেজাউল করিম। তখন তিনি পিএইচডি’র জন্য ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন থেকে পাওয়া প্রায় দুই লাখ টাকা পড়ালেখার জন্য ব্যয় না করে ওই টাকা দিয়ে একটি কোচিং-এর শেয়ার কিনেছিলেন। পরে এ বিষয়ে সংগঠনের মধ্যে প্রতিবাদ ও বিরোধীতাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে শিশির মুহাম্মদ মনির আর সভাপতি হতে পারেনি। কোচিং সেন্টারের শেয়ার কেনা ছাড়াও বায়তুল মাল থেকে নেওয়া লক্ষাধিক টাকা খরচ করে বিয়ে করার অভিযোগ উঠেছিল রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে।

ছাত্র শিবিরের একজন সাবেক কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক জানান, ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটিতে থেকে বিয়ে করার আলাদা মাহাত্ম আছে। এক্ষেত্রে সংসারের জিনিসপত্র সংগৃহীত হয় দ্রুত। ঢাকা মহানগর উত্তর যদি আলমারি দেয়, তাহলে অন্য শাখা দেবে ফ্রিজ। এছাড়া বিভিন্ন শাখা থেকে আসবে টেলিভিশন, খাট, সোফা, শাড়ি, সেলফ, টেবিল, স্বর্ণালংকার, ড্রেসিং টেবিল, কম্পিউটার ইত্যাদি।

বায়তুল মাল থেকে সুবিধা গ্রহণকারী এক নেতার ব্যাপারে জানা যায়, জামায়াতের ঢাকা মহানগরের একজন শীর্ষ নেতার পল্টনের ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া প্রায় ৪৪ হাজার টাকা। তার স্ত্রী চিকিৎসক হলেও তিনি সংগঠন থেকে ব্যয়ভার গ্রহণ করেন। ওই নেতার ঘনিষ্ঠ আরেকজন নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

জামায়াতের মজলিসে শুরার প্রভাবশালী একজন সদস্য বলেন, ‘আল্লাহর নবী রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে ততক্ষণ পর্যন্ত কিছু গ্রহণ করেননি, যতক্ষণ তিনি রাষ্ট্র গঠন করেননি। ইসলামী আন্দোলনে নেতাকে সম্মানী দিয়ে কাজ করানোর কোনও মাহাত্ম আছে কিনা, জানা নেই। তবে দলীয়ভাবে প্রশ্ন করার সুযোগ কম। সময় হয়তো সব ঠিক করবে।’  

এ বিষয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কতটুকু দেওয়া হয়, তা আমরা সাংগঠনিকভাবে নির্ধারণ করে থাকি। এটা কেন্দ্রীয় বা সংশ্লিষ্ট সংগঠন, একজন ফুলটাইমারের ভাতা কত হবে, সেটা ঠিক করেন। সংগঠন যদি মনে করে কাউকে সার্বক্ষণিক প্রয়োজন, তাহলে সংগঠন সিদ্ধান্ত নেয়।’

আরও পড়ুন:

বেশিরভাগই ব্যয় হয় ‘ফুলটাইমার’দের ভরণপোষণে