সোমবার ‘হোম অব ক্রিকেটে’ খেলা দেখছেন, আর তাঁর দুচোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রু। এই কান্নার মধ্যে বেদনা আছে, সমানভাবে আছে আনন্দও।বেদনা এ কারণেই, জুয়েল আজ শুধু একটি স্মৃতিবদ্ধ নাম।আনন্দের কারণ, যেসব অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগে বাংলাদেশ নামের দেশটির জন্ম, তাঁদের একজন জুয়েল। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে চর্চার মাধ্যমে দেশের ক্রিকেট আজ কত ওপরে উঠে দাঁড়িয়েছে, এটি ভেবে আনন্দিত হন সুরাইয়া।তবে এই আনন্দের পাশে একটি আক্ষেপও আছে তাঁর, দুইপাশে দুই ক্রিকেট-শহীদের নামে দুটি স্ট্যান্ড করা হলেও তাঁদের কোনো ভা্স্কর্য নেই। তরুণ প্রজন্মকে এই বীরদের সম্পর্কে জানাতে ভাস্কর্য রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন শহীদ জুয়েলের বোন।
ঢাকার দুর্ধর্ষ ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন জুয়েল। অনেকগুলো সফল অপারেশনের পর রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে শহীদ হন তিনি। ২৫ মার্চ কালোরাতে অন্তঃপ্রাণ ক্রিকেট সংগঠক মোশতাক আহমেদকে হত্যা করা হয়। শহীদ জুয়েল দেখেছিলেন মুশতাক আহমেদের লাশ। এ শোকের শক্তি থেকে প্রেরণা নিয়ে যুদ্ধে যান জুয়েল। এক দিকে বন্ধু হারিয়ে শোকে বিহবল জুয়েল, অন্যদিকে দেশ ও মা। কি করবেন তিনি? শেষ পর্যন্ত মাতৃভূমির জন্যই অস্ত্র তুলে নেন শহীদ জুয়েল। ভারতে যাওয়ার আগে মায়ের হাতে তুলে দিয়ে যান একটি ছবি।
১৯৭১ সালে মায়ের হাতে যে ছবিটা তুলে দিয়েছিলেন জুয়েল, সেই ছবিটির বয়স এখন ৪৯ বছর। আজ বেঁচে থাকলে বয়স হতো প্রায় ৭০। রফিক-নাঈমুর-সুজন-আকরামদের মতো ওয়ানডে-টেস্ট খেলার সুযোগ পেতেন না, তবে তাঁদের মতো ক্রিকেট সংগঠক হতেই পারতেন।
প্রতিভাদীপ্ত ক্রিকেটার জুয়েল স্বাধীন দেশের মাটিতেই ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাই যুদ্ধে যেতে জীবনের মায়া করেননি। ভাইয়ের যুদ্ধে যাওয়ার স্মৃতি বলতে গিয়ে জুয়েলের বোন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বাংলা ট্রিবিউনকে বলে যান, ‘মায়ের বাধা না মেনেই চলে যায় জুয়েল। যাওয়ার আগে মাকে একটি ছবি বাধাই করে দিয়ে বলেছিল, আমি যখন থাকব না তখন তুমি এই ছবিটি দেখবে। হয়তো আমার ভাই বুঝতে পেরেছিল যে সে আর নাও ফিরতে পারে।’
মার্চে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মে মাসে ভারতের ত্রিপুরা পালিয়ে গিয়ে ট্রেনিং নেন শহীদ জুয়েল। ওখানেই গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গেরিলা বাহিনী ক্র্যাক প্লাটুন। সুরাইয়া যেন ফিরে গেলেন ১৯৭১ সালের সেই উত্তাল দিনে, ‘২৫শে মার্চ কালরাত্রিতে মুশতাককে যখন মেরে ফেলা হয়, তারপরই সে সিদ্ধান্ত নেয়, যুদ্ধে যাবে। কয়েকবার চেষ্টা করে মে মাসের শেষের দিকে ভারত যায় জুয়েল। ভারতে গেরিলা ট্রেনিং নেওয়ার পর ঢাকায় এসে বেশ কিছু অপারেশন চালিয়েছে। তবে ফার্মগেটে অপারেশনের দিন খুব ভয় পেয়েছিল। স্বাভাবিক হতে পারছিল না জুয়েল। আমাদের চার বোনকে জোর করে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। চিন্তা করছিল সে ধরা পড়লে বাড়িতে রেইড হতে পারে। এরপর আশুগঞ্জে পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দে্ওয়ার সময় তার হাতে একটা গ্রেনেড ফেটে যায়।’
মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েই রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন শহীদ জুয়েল। বলতে বলতে চোখ ভিজে যায় সুরাইয়া চৌধুরীর, ‘২৯ তারিখ রাতে মাকে দেখার জন্য বাসায় যাবে বলে সেখান থেকে বের হয়। পথে বড় মগবাজারে আজাদদের বাসায় যায়। খাওয়া-দাওয়া সেরে বাসায় যাবে, কিন্তু আজাদের মা বলেন, রাত হয়ে গেছে তুমি থেকে যাও। ওই রাতেই রাজাকাররা ঘেরাও করে জুয়েলদের ধরে নিয়ে যায়।’
নিজেকে সামলে নিয়ে জুয়েলের বোন বলতে থাকেন, ‘আমরা খবর পেলাম ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে নির্যাতন করেছে। সকালে নিয়ে যেত, রাতে রমনা থানায় এনে রাখত। আমার বাবা ভোরে গিয়ে দেখা করতেন। বাঙালি পুলিশ যারা ছিল তাঁরা দেখার সুযোগ করে দিতেন। বাঁচতে চেয়েছিল জুয়েল, কিন্তু চাইলে কী হবে, সেটা তো সম্ভব হয়নি। ১ অক্টোবর তাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেছে আর ফেরেনি। আমরা ধরে নিই ২ তারিখ তাকে মেরে ফেলে তারা। ভারত থেকে তার বন্ধুরা এলো, কিন্তু জুয়েল ফিরল না।’
এই বলে দীর্ঘনিশ্বাস পেলেন সুরাইয়া চৌধুরী । পাশে বসা ছোট বোন সালমা চৌধুরীর চোখও ছলছল করে উঠে। যদিও ওই সময়ে সালমার বয়স ছিল ২/৩ বছর। কোন কিছুই তাঁর মনে নেই।
শহীদ জুয়েল অসাধারণ ডানহাতি ব্যাটসম্যান ছিলেন। সোজা ব্যাটে খেলা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তিনি ছিলেন সেই সময়ের সবচেয়ে খ্যাতিমান । খেলতেন আজাদ বয়েজ ক্লাবে, খেলেছেন মোহামেডানেও।পূর্ব বাংলার প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে তিনি পাকিস্তানের টেস্ট দলে সুযোগও পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু যাননি যুদ্ধে যাবেন বলে। ১৯৬৯ সালে দেশজুড়ে যখন আয়ুববিরোধী তীব্র আন্দোলন চলছে, তখন পাকিস্তান দলের ওপেনিং ব্যাটসম্যানদের অত্যন্ত বাজে ফর্ম।বাধ্য হয়েই পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড প্রাথমিক দলে ডাকে জুয়েলকে। কিন্তু জুয়েল ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেন। কিছুক্ষণ দম নিয়ে হাসিমুখে সগর্বে জুয়েলের বোন ভাইয়ের ক্রিকেটের গল্প বলতে থাকেন, ‘ক্রিকেট নিয়ে ওর অনেক স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন ছিলো জাতীয় দলে খেলার। একদিন টেস্ট খেলবে, দেশের সেরা ক্রিকেটার হবে। করাচিতেও অনেক ভালো খেলেছে। সে সময় করাচির উর্দু পেপারগুলো আমাদের বাসায় ছিল, ওকে নিয়ে লেখা হয়েছিল। যখন ওর হাতে গ্রেনেড ফেটে যায় (আশুগঞ্জের পাওয়ার স্টেশনের অপারেশনে) তখন ও আলমদের বাসায় ছিল। ওর হাত যখন গ্রেনেড লেগে ধসে যায়, তখন ও বলত, আমি কি আর ক্রিকেট খেলতে পারব!’
সুরাইয়া চৌধুরী এই সময়ের ক্রিকেটারদের মাঝেই যেন তাঁর ভাইকে খুঁজে পান, ‘এখনকার ক্রিকেটারদের মতোই ক্রিকেটার হতে চেয়েছিল জুয়েল। বড় ক্রিকেটার বলতে যা বোঝায়। এখন বাংলাদেশ অনেক বড় পর্যায়ে গেছে। ওরা যখন খেলে মনে হয়, আমার ভাই-ই বোধহয় খেলছে। আমি সবার মাঝে আমার ভাইকেই খুঁজে পাই।’
‘শহীদ জুয়েল ও মুশতাকের ভাস্কর্য হোক-সুরাইয়া চৌধুরীর ছোট্ট দাবিটা শুনে বিসিবির পরিচালক আকরাম খান ও খালেদ মাহমুদ জানান, ‘যারা আমাদের বাংলাদেশ এনে দিয়েছেন, বাংলাদেশের পতাকা বহন করার সুযোগ করে দিয়েছেন তাঁদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য এতটুকু তো করাই যায়। এগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। হয়তো আগামী বছরই আমরা এমন কিছু দেখতে পারবো।’
এমনটা হলেই ভালো। তাহলে স্টেডিয়ামে ঢুকে দেশের নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে দেশের দুই ক্রিকেট-শহীদকে।এগিয়ে যেতে হলে যেকোনো সৃষ্টিরই উৎসমুখে ফিরে তাকাতে হয়।