অভিজ্ঞ হৃদয়ের মস্তিষ্কে সবসময় ‘মুশফিক’

তৌহিদ হৃদয়মাত্র সাত বছর বয়সে ক্রিকেটের প্রেমে পড়েছিলেন তৌহিদ হৃদয়। বাড়ির পাশের খোলা মাঠে সকাল-সন্ধ্যা ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকতেন । তবে ক্রিকেট তাকে ক্যারিয়ারের শুরুতেই একটি প্রতারণার অভিজ্ঞতা দিয়েছে।  সাত বছর আগে ঢাকায় এসে বনশ্রীতে একটি ‘ভুয়া’ ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হয়ে গচ্চা দিয়েছিলেন বেশ কিছু টাকা। রীতিমতো শোকার্ত হয়ে পড়েছিলেন হৃদয়।

শোক ভুলতে পেরেছেন মায়ের অনুপ্রেরণায় । ২০১৮ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ যুব বিশ্বকাপের পর আরেকটি বিশ্বকাপের মঞ্চে নামছেন । গত দুই বছরে বড়দের সঙ্গে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের পাশাপাশি প্রিমিয়ার লিগ ও বিপিএলেও খেলেছেন। এই অভিজ্ঞতা দক্ষিণ আফ্রিকায় কাজে লাগাতে উন্মুখ মিডল অর্ডারে যুবদলের এই ব্যাটিং স্তম্ভ।

বাংলাদেশ দলের উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিমের ভীষণই ভক্ত হৃদয় তার মতোই দায়িত্বশীল হতে চান। ব্যাটও করেন মুশফিকের মতো চার নম্বরে । টপ অর্ডারের ব্যর্থতায় মুশফিক যখন দলের হাল ধরেন, সেটি ভীষণ অনুপ্রাণিত করে হৃদয়কে। এখন দারুণ ছন্দে আছেন । সর্বশেষ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যুবসিরিজে টানা তিন সেঞ্চুরি করে গড়েছেন বিশ্বরেকর্ড! যুব ক্রিকেটে কুক, মার্করামসহ আরও আট ক্রিকেটারের আছে টানা দুই সেঞ্চুরি। কিন্তু কারোরই নেই টানা তিন সেঞ্চুরির রেকর্ড। নবম বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে ১ হাজার রান পূর্ণ করেছেন যুব ক্রিকেটে । দুর্দান্ত ফর্মে থাকা হৃদয়ের কাছে দলের প্রত্যাশা অনেক , হৃদয়ও প্রস্তুত দলের প্রত্যাশা পূরণে।

আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ১৫ যোদ্ধাকে নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে বাংলা ট্রিবিউনে। আজ থাকছে মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান তৌহিদ হৃদয়ের একান্ত সাক্ষাৎকার−

বাংলা ট্রিবিউন: ক্রিকেটে জড়িয়ে পড়া কীভাবে?

হৃদয়: ছোটবেলায় ক্রিকেটেই ডুবে থাকতাম। টিভিতে খেলা দেখালে কিছু না বুঝলেও তাকিয়ে থাকতাম। বাসার পাশেই ছিল মাঠ, সেখানে বড় ভাইরা খেলতো। ছোটবেলায় সারাদিন সেখানেই পড়ে থাকতাম। খেলার সুযোগ না পেলেও বল কুড়িয়ে এনে দিতাম, তাই মাঝে মাঝে ফিল্ডার হিসেবে খেলার সুযোগ পেতাম । তাতেই খুশি থাকতাম।

বাংলা ট্রিবিউন: ক্রিকেট শিখতে গিয়ে আপনার প্রতারিত হওয়ার গল্পটা যদি বলেন…

হৃদয়: ক্রিকেট খেলার জন্য একটা সময় আমি বগুড়ায় থাকতে চাইছিলাম না। মাথায় শুধু একটাই চিন্তা ছিল, আমাকে ক্রিকেটার হতেই হবে। ভালো কোনও ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করানোর জন্য জেদ ধরি। তখন আমি বেশ ছোট, চেষ্টা করেও বিকেএসপিতে ভর্তি হতে পারিনি। এরপর এলাকার এক ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় আসি। রামপুরার দক্ষিণ বনশ্রীর একটা একাডেমিতে ভর্তি হই। বাবাকে না জানিয়ে গ্রামের জমি বন্ধক রেখে মা টাকা দিয়েছিলেন।পরে দেখা যায় একাডেমিটা ভুয়া। টাকাটা মার যায়।  

বাংলা ট্রিবিউন: মায়ের জন্য  বড় উপহার নিয়ে আসবেন এবার?

হৃদয়: বাবা-মায়ের ঋণ তো কখনোই শোধ করা যাবে না। মা আবার আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসে। তবে খারাপ করি আর ভালো করি আমার মা খেলা নিয়ে কিছু বলে না। এই বিশ্বকাপ থেকে কী আনতে পারবো জানি না, কিন্তু মা যেহেতু আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন, তার জন্য হলেও আমি সাকিব ভাই, মাশরাফি ভাই, তামিম ভাইদের মতো ক্রিকেটার হ্ওয়ার অনুপ্রেরণা নিয়ে আসতে চাই ওখান থেকে। যদিও আমার মা-বাবা ক্রিকেট খেলাটা সেরকম বোঝেন না। আমাকে নিয়ে তাদের প্রত্যাশাটাও তেমন নয় ।

তৌহিদ হৃদয়বাংলা ট্রিবিউন: দারুণ ফর্মে আছেন, আপনার ব্যক্তিগত প্রস্তুতি কেমন?

হৃদয়: ব্যাটসম্যান হিসেবে ফর্মে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীলঙ্কা সিরিজে রান পাওয়ায় ভালো লাগছে। কিন্তু ওটা তো অতীত। দক্ষিণ আফ্রিকায় আগের পারফরম্যান্স আত্মবিশ্বাস ছাড়া অন্য কোনও কাজে লাগবে না। সবকিছু  নতুন করেই শুরু করতে হবে। 

বাংলা ট্রিবিউন: এই দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার,  এই অভিজ্ঞতা কতখানি কাজে লাগাতে পারবেন বলে আশা করছেন?

হৃদয়: কঠিন প্রশ্ন । অভিজ্ঞ হিসেবে আমার ওপর অনেক প্রত্যাশা থাকবে। তবে আমি প্রত্যাশার চাপ নিতে চাই না। আমি জানি আমার দায়িত্ব কী, আমি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে চাই। মিডল অর্ডারে খেলাটা তৈরি করে দিতে হয়। আমার কাজটা সেটাই হবে। যদি সেটা পারি চেষ্টা করবো খেলা শেষ করে মাঠ ছাড়তে। আমার প্রথম লক্ষ্য  ওখানের উইকেটে থিতু হওয়া। আমি বড় ভাইদের থেকে শুনেছি, ওখানে থিতু হতে পারলে ভালো খেলা যায়। 

বাংলা ট্রিবিউন: দক্ষিণ আফ্রিকায় একটু আগে-ভাগেই গেলেন, প্রস্তুতি কেমন?

হৃদয়: দুইদিন অনুশীলন করলাম। এখানে চারটি অনুশীলন ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবো। সবমিলিয়ে কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি বিশ্বকাপ শুরুর আগে দলের সবাই পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যাবে। আমার যেহেতু নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডে সফর করেছি, ওই অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লাগবে।

বাংলা ট্রিবিউন: ২০১৬ সালে খুব কাছে গিয়েও শিরোপা জেতা হয়নি। এবারের দলটি অনেক ভারসাম্যপূর্ণ। এবার কি শিরোপা-খরা কাটানো সম্ভব?

হৃদয়: ক্রিকেটে তো আগে থেকে কিছু বলা যায় না। তবে আমরা দল হিসেবে গত কিছুদিন ধরে যে পারফরম্যান্সটা করে আসছি, সেটাই আমাদের আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে। এই মুহূর্তে আমরা ভালো অবস্থায় আছি। দলের প্রত্যেকেই প্রত্যেকের দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত। আশা তো আছেই।

বাংলা ট্রিবিউন: এই বিশ্বকাপ দিয়েই আপনার বয়সভিত্তিক ক্রিকেট শেষ হচ্ছে? ব্যক্তিগতভাবে নিশ্চয়েই চাইবেন বিশ্বকাপটা রাঙাতে?

হৃদয়: এভাবে আমি চিন্তা করতে চাই না। লক্ষ্য স্থির করে কিছু করতে গেলে উল্টো খারাপ হয় আমার । একটা একটা করে ম্যাচ নিয়ে ভাবলে আমার পক্ষে ভালো করা সম্ভব। যদি ভালো করি তাহলে তো, যেকোনও জায়গা থেকেই আমার সুযোগ আসবে।

বাংলা ট্রিবিউন: গত কিছুদিন ধরে বোলিংটা ভালো হচ্ছে, বোলিং নিয়ে কী ভাবনা?

হৃদয়: বোলিংটা দলের প্রয়োজনে করছি। আমার সবসময় লক্ষ্য থাকে রান চেক দিয়ে বোলিং করা । বাড়তি হিসেবে উইকেট পেলে ভালো লাগে। বিশ্বকাপেও একই দায়িত্ব পালন করতে চাই।

বাংলা ট্রিবিউন: মুশফিককে অনুসরণ করেন ঠিক কী কারনে?

হৃদয়: মুশফিক ভাইকে ভালো লাগে। ওনার ব্যক্তিত্ব, পড়াশোনা,  কঠোর পরিশ্রমের কারণে। তার মতো পরিশ্রমী ক্রিকেটার হতে চাই। তার মতো দায়িত্ব নিয়ে ব্যাটিং করতে চাই। তার মতো সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করতে চাই।

প্রোফাইল

নাম: তৌহিদ হৃদয়

ডাক নাম: হৃদয়

বাবা: এনামুল হক

মা: তাহমিনা আক্তার

জন্ম: ৪ ডিসেম্বর ২০০০

জন্মস্থান: বগুড়া

উচ্চতা: ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি

প্রথম ক্লাব: শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাব

বর্তমান ক্লাব: শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাব

ব্যাটিং স্টাইল: ডানহাতি

প্রিয় শট: কাভার ড্রাইভ

প্রিয় মানুষ: মা

প্রিয় ক্রিকেটার : মুশফিকুর রহিম

ক্যারিয়ারে স্মরণীয়: শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টানা তিন সেঞ্চুরি