মেসিরা মানলেন, বার্সায় ফাটল আরও বড়

লুইস সুয়ারেজ ও লিওনেল মেসি৩০ মার্চ, সোমবার সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৭ লাখ ২০ হাজারে পৌঁছেছে। মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজারে, আর এই মৃত্যুর মিছিলে স্পেনেরই যাত্রী ৬ হাজার ৮০০। লিওনেল মেসির বিবৃতিটা এলো এরই মধ্যে। বার্সেলোনা ফুটবল দলের আর্জেন্টাইন অধিনায়ক জানিয়ে দিলেন তারা, মানে প্রথম দলের খেলোয়াড়েরা, যতদিন না করোনা-সংকট কাটছে ততদিন পর্যন্ত তাদের বেতনের ৭০% ছাড় দিচ্ছেন।

ক্লাবের আর্থিক সংকট সামাল দিতে মেসিরা শুধু যে নিজেদের বেতনের মাত্র ৩০ ভাগ নেবেন তা-ই নয়, ক্লাবের অন্য কর্মীদের কর্তিত বেতনও তারা দেবেন।  পৃথিবীর অদ্ভুত এক অসুখের সময় মেসিদের এ এক মহানুভবতা।

এই মহানুভবতার মধ্যে একটা চালও আছে। ক্লাব সভাপতি জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউয়ের নেতৃত্বাধীন বার্সেলোনার নির্বাহী বোর্ডকে ‘ডজ’ দিয়ে এগিয়ে যেতে তারা দেননি। মেসি বেশ বড়সড় একটা বিবৃতিই পাঠিয়েছেন ইনস্টগ্রামে, একই বিবৃতি লুইস সুয়ারেজও ভাগাভাগি করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এটির শুরুতেই বার্সেলোনা বোর্ডের প্রতি অসন্তোষের সুর, শেষে অবশ্যই সমালোচনা, ‘এই সংকটের সময় বার্সেলোনার প্রথম দলের খেলোয়াড়দের বেতন নিয়ে অনেক কিছু লেখা হচ্ছে বা বলা হচ্ছে। প্রথমেই আমরা পরিষ্কার করে দিতে চাই যে সবসময়ই আমরা বেতন কাটার পক্ষে ছিলাম। কারণ ব্যতিক্রমী সময়টাকে আমরা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। আমরাই প্রথম যারা ক্লাব কিছু বলতেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে, যখন কোনও বিষয়কে  জরুরি মনে হয়েছে এমন সময়ে অতীতে আমরা নিজেদের উদ্যোগে অনেক কিছু করেছি।’ মেসিদের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘এজন্যই আমরা অবাক হয়েছি যখন দেখলাম ক্লাবেরই কিছু লোক আমাদের আতস কাচের নিচে ফেলে আমাদের চাপ দিয়ে কিছু করাতে চাইছেন যা নিজেদের কাছে পরিষ্কার থেকে সবসময়ই আমরা করতে চেয়েছি।’ বেতন কম নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে কেন দেরি হলো সেই ব্যাখ্যাও আছে বিবৃতিতে, ‘সমঝোতায় পৌঁছাতে যদি দিনকয়েক দেরি হয়েই থাকে সেটির সরল কারণ এটা যে আমরা এই দুঃসময়ে কীভাবে ক্লাব ও ক্লাবের কর্মীদের সাহায্য করতে পারি সেই সমাধানসূত্র খুঁজে পেতে চেয়েছি। জনসমক্ষে আমরা আগে কিছু বলিনি, কারণ প্রকৃত সমাধানটাই আমাদের অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল যাতে আমরা ক্লাব ও যারা সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়তে চলেছে তাদের সত্যি সত্যিই সাহায্য করতে পারি।’

ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর মধ্যে বার্সেলোনার ব্যয় সবচেয়ে বেশি। এই ক্লাবে প্রথম দলের ফুটবলারদের বার্ষিক বেতন ৩৯ কোটি ১০ লাখ ইউরো। তাই করোনা ভাইরাসের প্রকোপে ১৪ মার্চ লিগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে বার্সেলোনাই প্রথম সম্ভাব্য আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে খেলোয়াড়দের বেতন কমানোর প্রস্তাব দেয়। মেসিরা প্রথমে তাতে সায়ও দেন। সব ক্লাবই আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে বুঝতে পেরে উয়েফা-ফিফাও উদ্বেগ প্রকাশ করে। ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো এই সংকটকালে খেলোয়াড়দের বেতন ৫০% কমানোর প্রস্তাব করেন।  এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার বার্সেলোনার নির্বাহী বোর্ড একেবারেই আলাদাভাবে বৈঠক করে খেলোয়াড়দের ওপর ‘ইআরটিএ’ প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন। স্পেনের শ্রম আইন অনুযায়ী ইআরটিএ হলো অস্থায়ী শ্রমশক্তি সমন্বয় পরিকল্পনা। এই আইন অনুযায়ী আর্থিক মন্দার সময়ে যেকোনও কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান ৬ মাসের জন্য কর্মীদের চাকরিচ্যুত করতে পারে অথবা তাদের বেতনের শতকরা ৭০ ভাগ কেটে রাখতে পারে।

স্পেনের সংবাদমাধ্যম যেমনটি বলেছে, আসলে রিয়াল মাদ্রিদ কী সিদ্ধান্ত নেয় সেটি দেখার অপেক্ষায় ছিলেন বার্সেলোনার ফুটবলাররা। তারওপর বার্তেমেউয়ের নেতৃত্বে বার্সেলোনা বোর্ড ইআরটিএ প্রয়োগের হুমকি দেওয়াতেই মেসিরা বেঁকে বসেন, বেতন কমানোর ব্যাপারে আর কোনও কথাই তারা বলতে চাননি।

এমনিতেই  অতীতের অনেকগুলো ঘটনায় বার্তোমেউ এবং তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন পরিচালকের ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ খেলোয়াড়েরা। খেলোয়াড়দের সঙ্গে বিশাল একটা দুরত্ব তৈরি হয়েছে বোর্ডের। বিশ্লেষকেরা মনে করেন বার্সেলোনার মাঠের খেলায় এই দ্বন্দ্বেরই ছাপ পড়েছে প্রবলভাবে।

চলতি ২০১৯ মৌসুমে দ্বন্দ্বটা প্রথম প্রকাশ পায় প্রাক-মৌসুম প্রস্তুতি নিয়ে। তারপর কার্লেস অ্যালেনিয়ার ২১ নম্বার জার্সিটা যখন তাকে না বলে দিয়ে দেওয়া ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ংকে, সেটিও একটা অসন্তোষ তৈরি করে। প্রাপ্য বোনাস পাননি বলে বোর্ডের বিরুদ্ধে কথা বলেন আর্তুরো ভিদাল। কিছু কিছু খেলোয়াড় পরিশ্রম করে খেলতে চান না বলেই বিদায় নিতে হলো আর্নেস্তো ভালভার্দেকে- এ কথা বলে মেসিকে খেপিয়ে তোলেন ক্রীড়া পরিচালক এরিক আবিদাল। ইভান রাকিতিচের চুক্তি নবায়নে বিলম্ব করে খেপিয়ে তোলা হয় তাকেও। বেশ কিছু খেলোয়াড়কে ধারে পাঠিয়ে স্কোয়াডটাকে ছোট করে ফেলায় প্রকাশ্যেই সমালোচনা করেন রাকিতিচ ও সের্হিয়ো বুসকেটস। তারপর বেরিয়ে পড়ে সেই কেলেঙ্কারি, মেসি-পিকেদের সুনামে কালি লেপতে বার্তোমেউ ভাড়া করেছিলেন এক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি! আর সব শেষে করোনা-সঙ্কটে বেতন কর্তন নিয়ে এই দ্বন্দ্ব।

বার্তোমেউয়ের ‘রাজত্বকালে’র শেষ দুটি বছর থেকেই বার্সেলোনায় খেলোয়াড় ও বোর্ডের মধ্যে সম্পর্কের গাঁথুনিতে একটু একটু করে চিড় ধরছিল। এখন সেটি বড় এক ফাটল!

করোনাভাইরাসের কালো ছায়া পৃথিবী থেকে কবে সরবে কেউ জানে না। আজ হোক, কাল হোক, একসময় সরবেই। তবে পৃথিবীটা আর আগের মতো থাকবে না। বার্সেলোনা নামের মোহনীয় ফুটবল ক্লাবটিও বদলে যাবে। এই করোনাকালেই সেই ইঙ্গিত কি আপনি পেয়ে যাননি?