বাংলা ট্রিবিউন: কেমন আছেন, ক্রিকেট ছাড়া কেমন কাটছে?
অলক কাপালি: ভালো আছি, তবে ক্রিকেট ছাড়া ভালো থাকাটা কঠিন। ক্রিকেট ক্যারিয়ারে এমন অবসর কখনও কাটাইনি। এখন চেষ্টা করছি যতটুক নিরাপদে থাকা যায়। বাসায় আছি, ঘরে থেকে ফিটনেস নিয়ে কাজ করছি।
বাংলা ট্রিবিউন: পাকিস্তানের বিপক্ষে ২০০৩ সালে টেস্টে প্রথম হ্যাটট্রিক করেছিলেন লেগ স্পিন দিয়ে। অথচ বিসিবি এখন একজন লেগ স্পিনার খোঁজে হন্যে হয়ে, এসব দেখে আফসোস হয় না?
অলক: আফসোস হয় আবার হয়ও না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সুযোগ পাওয়ার পর আমার স্বপ্ন ছিল আমি অন্তত দশ বছর দেশকে সার্ভিস দেবো। হয়তো আমার পারফরম্যান্সে নির্বাচকেরা সন্তুষ্ট হতে পারেননি বলেই স্বপ্নটা শেষ হয়ে যায়। বাংলাদেশে একবার দল থেকে বাদ পড়লে পরে সুযোগ পাওয়া খুব কঠিন। কারণ এখন প্রতিযোগী অনেক। দলে হয়তো লেগ স্পিনার নেই, কিন্তু ভালো ব্যাটসম্যান আছে।
বাংলা ট্রিবিউন: মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসেবে আপনার খ্যাতি ছিল। আপনাকে আলোর কুপি বলা হতো। এখন যখন সৌম্য-লিটনদের ব্যাটিং দেখেন ভেতরে কি একটু নাড়া দেয় না আপনার?
অলক: খুব নাড়া দেয়। আমি খুব কষ্ট পেয়েছি ২০০৩-০৪ সালে। সুজন ভাই (খালেদ মাহমুদ সুজন) তখন অধিনায়ক। পাকিস্তানে আমি একটা ম্যাচ ইনজুরি নিয়ে খেলছিলাম। হাতের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। আমি কোচ ও টিম ম্যানেজমেন্টকে বললাম, আমি তো খেলতে পারবো না। কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে বলা হলো, না, তোমাকে খেলতে হবে,-স্লিপে দাঁড়াবা, থ্রোও করতে হবে না, বোলিংও করতে হবে না। কিন্তু ব্যাটিং লাগবে। যেহেতু কোচ ও অধিনায়ক সাপোর্ট দিচ্ছেন, আমি রাজি হয়ে গেলাম। এটা তো একটি উদহারণ, দলের প্রয়োজন যখন, যেভাবে ছিল আমি সেটা পূরণ করার চেষ্টা করেছি। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করায় ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে আমি ৩০ জনের দলে জায়গা পাই। কিন্তু গুরুত্বহীন ছিলাম। তখন থেকেই ভীষণ আপসেট হয়ে গিয়েছিলাম। আমি সব সময়ই টিমের স্বার্থেই যা করার করেছি। কিন্তু আমাকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হলো। নিজের জন্য খেললে হয়তো এখনও টিকে থাকতে পারতাম। কিন্তু সবসময়ই গুরুত্ব দিতাম দলের চাওয়াকে। ওদের খেলা দেখলে খারাপ লাগে, ভাবি আমি তো এমনই খেলতাম।
অলক: মনে আছে। আমাকে অধিনায়ক বললেন, ওকে রেকর্ড গড়তে দেওয়া যাবে না। গিবস তখন ৯৭ রানে, আর তিন রান করতে পারলেই ওয়ানডেতে টানা চার সেঞ্চুরি করার রেকর্ড গড়তো (২০১৫ বিশ্বকাপে সাঙ্গাকারা ৪ সেঞ্চুরি করে রেকর্ড করেছেন)। আমার হাতে বোলিং দিয়ে অধিনায়ক আমাকে বলেছিল, তুই ওয়াইড দিবি। শুরুতে না করলেও যেহেতু আমি জুনিয়র আমাকে করতেই হতো। ওই ওয়াইডের পর দক্ষিণ আফ্রিকার সবাই তো আমার ওপর অনেক ক্ষ্যাপা। মিডিয়ায় অনেক লেখালেখি হলো আমার ছবি দিয়ে। পরে আমার খুব খারাপ লেগেছে, কাজটা আমরা মোটেও ঠিক করিনি। আমি তখন জুনিয়র ছিলাম, অধিনায়ক যেটা বলেছে সেটাই করতে হয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউন: ২০০৮ সালে করাচিতে ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন আপনি এশিয়া কাপে। এই মূহুর্তটার কথা মনে পড়লে কেমন লাগে?
অলক: ভারতের বিপক্ষে কোনও বাংলাদেশির প্রথম সেঞ্চুরি এটি। আমার ক্যারিয়ারের বিশেষ অর্জন। আমার লক্ষ্য ছিল দলের রান তিনশোর কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া। দলগত লক্ষ্য ছিল জয়ের সুযোগ নেওয়া। মুশফিক ও রিয়াদের সঙ্গে দুটি পার্টনারশিপ হয়েছিল। আমি এখনও আমার সেই ইনিংসটি ইউটিউবে দেখি। খুব আপ্লুত হয়ে যাই।
বাংলা ট্রিবিউন: জুনে করাচিতে অমন একটি ইনিংস খেলার পর, সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া ভারতের বিদ্রোহী লিগ আইসিএলে যোগ দিলেন কেন? আইসিএলই কী আপনার ক্যারিয়ারটাকে লম্বা হতে দিলো না?
অলক: না, আমি এই সিদ্ধান্তের পেছনে ভুল খুঁজে পাই না। তখনকার প্রেক্ষাপটে এটা অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। ২০০৮ সালের আগস্টে অস্ট্রেলিয়া সিরিজেই আমার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ চলাকালে আমাকে বলা হয়েছিল পরবর্তী সিরিজগুলোতে আমাকে আর বিবেচনা করা হবে না। একটা সিরিজ চলাকালে কিভাবে একজন নির্বাচক এরকম বলেন?
বাংলা ট্রিবিউন: ঘটনাটা আসলে কী ঘটেছিল?
অলক: প্রধান নির্বাচক রফিকুল আলম আমাকে ম্যাচ চলাকালে ডেকে বললেন, শুনলাম তুমি নাকি আইসিএলে যাচ্ছো? আমি বললাম এ ব্যাপারে এখনও কনফার্ম কিছু হয়নি। তারপরও উনি আমাকে অনেক উল্টোপাল্টা কথা বলেন। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ শেষ দেশে ফিরে টিম ম্যানেজমেন্ট মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিলো আমাকে আর দলে নেওয়া হবে না। তখনকার টিম ম্যানেজার আমাকে ডেকে বলেন, তোমার যদি আইসিএলে অফার থাকে, চলে যাও। আমি পাল্টা প্রশ্ন করেছি, কেন যাবো? আমি তো দেশের হয়ে খেলতে চাই। তখন ম্যানেজার আমাকে স্পষ্ট বলেছেন, তুমি গেলে যাও, তোমার ইচ্ছে। কিন্তু তোমাকে পরবর্তী সিরিজ থেকে বিবেচনা করা হবে না। এরপরই আমি আইসিএলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। মাথায় ঢুকে যায়, আমাকে প্রমাণ করতে হবে। যারা আইসিএলে গিয়েছিল সবাই কিন্তু জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়ে গিয়েছিল। আমি অবসর নিইনি। আমি তখন সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলাম, আমি ফিরে এসে আবার জাতীয় দলে খেলবো। আইসিএলে বেশ ভালো খেলেছিলাম। সেঞ্চুরি করেছিলাম। পরে আইপিএলেও ডাক পাই। আইসিএলে যাওয়া নিয়ে আমার কোনও আক্ষেপ নেই।
অলক: মোটেও সত্য নয়। আইসিএল খেলে আইপিএলেও তো আমার সুযোগ হয়েছিল। এত লোভ থাকলে আমি সেখানেও যেতাম। কিন্তু যাইনি আইসিএলের দল ঢাকা ওয়ারিয়র্সের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিলাম বলে। আমি নির্বাচকদের অবমূল্যায়নের শিকার হয়েই আইসিএলে গিয়েছিলাম। ২০০৭ বিশ্বকাপের আগে ৫টি সেঞ্চুরি করেছিলাম। বিশ্বকাপের ৩০ জনের দলে থাকলেও আমাকে ব্যাটিংয়ের সুযোগ দেওয়া হতো না। নির্বাচকেরা বলেন আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। আমি নিজেকে প্রমাণ করতেই বিদেশি লিগে খেলতে গিয়েছিলাম। আমাদের দেশে সেঞ্চুরি করে লাভ নেই। এই চিন্তা করেই আসলে আইসিএলে যাওয়া। ওখানে গিয়ে যখন ভালো খেলেছি, বোর্ড থেকে আমার শাস্তি কমিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। পরে সুযাগ পেয়ে হয়তো কাজে লাগাতে পারিনি, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে তখন আইসিএলে খেলতে না গেলে আমার আর সুযোগ কিন্তু হতো না।