সোমবার সকালে ক্লাব প্রাঙ্গনে তাকে শেষবারের মতো দেখতে ভিড় জমিয়েছিলেন তার একসময়ের সহকর্মীরা। শুধু কি ক্লাব প্রাঙ্গন, সেখান থেকে তার প্রিয় মাঠ যেখানে খেলে খ্যাতি-যশ পেয়েছেন সেই বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন ক্রীড়াব্যক্তিত্ব-রাজনীতিবিদসহ অনেকেই। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষে বাহাউদ্দিন নাসিম ও অসীম কুমার উকিলসহ অন্যরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। রবিবার সন্ধায় জীবনদীপ নিভে যায় একসময়ের মাঠ কাঁপানো ফুটবলার বাদল রায়ের। ৬০ বছর বয়সে যকৃত ক্যানসারের কাছে হার মানতে বাধ্য হন।
তাকে শেষ দেখাটা দেখার জন্য তাই সতীর্থ ও সহকর্মীদের উপস্থিতি ছিল দেখার মতো। একসময় অশ্রুসজল হয়ে পড়েন অনেকেই। প্রায় সবাই পুরনো স্মৃতি মনে করে ফিরে যান আগের দিনগুলোতে। এই যেমন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এসে ফুল দিয়ে সাবেক তাকে স্মরণ করলেন। বিদায় বেলায় তিনি বলেছেন,‘ ফুটবলের অহংকার ছিলেন তিনি। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিকে হারালাম আমরা। সেই সময়ে ফুটবলের যে ঐতিহ্য ছিল সেই ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক ছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল ফুটবল ও ক্রীড়াঙ্গন পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরে যাবে। আমাদের সবার উচিত হবে যে তার স্বপ্নকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সম্মিলিতভাবে কাজ করা। তাহলে ফুটবল আবার ঐতিহ্যের জায়গায় ফিরে আসবে। বাদল রায়ের আত্মা শান্তি পাবে।’
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ও আবাহনী লিমিটেডের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছেন কাজী নাবিল আহমেদ। বাফুফের সহ-সভাপতি ও আবাহনীর ভারপ্রাপ্ত ডিরেক্টর ইনচার্জ কাজী নাবিলের ১২ বছরের সহকর্মী (ফেডারেশনে) ছিলেন বাদল রায়। তার কাজেরই প্রশংসা ঝরেছে কাজী নাবিলের কন্ঠ থেকে, ‘ভালো সংগঠক ছিলেন। চমৎকার মানুষ। বাংলাদেশের ফুটবলের অতীতের অংশ ছিলেন। সবসময় ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতেন। স্টাইলিশ ও অনন্য এক খেলোয়াড় ছিলেন। সংগঠক হিসেবে অনেক ভালো ভূমিকা রেখেছেন। ফুটবলের প্রতি তার অবদান বলে বোঝানো যাবে না।’
বাদল রায় সম্পর্কে কাজী নাবিল আরও বলেন,‘ ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম ও ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম করে করে নতুন খেলোয়াড় খুঁজে বের করতেন তিনি। তার সারাদিন মানসিক ও শারীরিক জগত ছিল ফুটবলকে ঘিরে। দিনরাত চিন্তা করতেন। তাকে হারিয়ে অপূরণীয় ক্ষতি হলো যা আমাদের জন্য দুঃখের। ফেডারেশন, জেলা কিংবা জেলার ক্লাবগুলোর উচিত হবে তার স্বপ্নগুলো এগিয়ে নেওয়া।’
মোহামেডান ক্লাবে ১৯৭৭ সাল থেকে শুরু। এরপর এক যুগের বেশি সময় কেটেছে সেখানে। বাংলাদেশের কোনও ফুটবলারের একটি ক্লাবে ক্যারিয়ার শুরু ও শেষ হওয়াটা বিরল দৃষ্টান্ত। আর এই বিরল উদাহরণ গড়েছিলেন বাদল রায়। তার সাবেক সতীর্থ সৈয়দ রুম্মন বিন ওয়ালি সাব্বির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানালেন, ‘ফুটবলের প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসা ছিল। একসঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। ভালো মানুষ ছিলেন। ফুটবল অন্তঃপ্রাণ ছিলেন। মোহামেডান ক্লাবকে অনেক জয় এনে দিয়েছেন। এখন ফুটবলকে এগিয়ে নিতে হলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই চেষ্টা করতে হবে।’
অসুস্থ অবস্থায় বাদল রায়ের পাশে ছিলেন আরেক সাবেক সতীর্থ ফুটবলার আব্দুল গাফফার। কথা বলতে গিয়ে অনেকটা বাকরুদ্ধ তিনি, ‘শুধু খেলোয়াড় না, বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠকও বাদল। তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। অনেক কষ্ট পেয়েছি, তার এভাবে চলে যাওয়ার জন্য। মানতে কষ্ট হচ্ছে।’
হাসানুজ্জামান বাবলু কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন, ‘এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে বাদল রায়কে মানুষ ভালোবাসতো না। গত ২০ বছর ধরে ফুটবল উন্নয়নে কাজ করে গেছে। ও শুধু মোহামেডানেরই জার্সি গায়ে চড়িয়েছে। অন্য ক্লাবে খেলেনি। তার ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা অপরিসীম।’
জাতীয় দলের সাবেক তারকা ডিফেন্ডার কায়সার হামিদের দৃষ্টিতে বাদল রায় আসাধারণ এক মানুষ, ‘আমি শোকাহত। তার স্মৃতি ভুলবার মতো নয় । তিনি ফুটবলকে ভালোবাসতেন। ফুটবল নিয়েই সারাক্ষণ চিন্তা করতেন। আমার দেখা অন্যতম সেরা খেলোয়াড় তিনি। তার খেলা এখনও চোখে ভাসে।’
জসিমউদ্দিন জোসি বিষন্ন মনে বললেন, ‘ বাদল দা সবাইকে নিয়ে চলার চিন্তা করতেন। তাকে অভিভাবক হিসেবে পেয়েছি। তাদের ভালোবাসা পেয়েছি। যা ভোলার নয়। সেই সময় ১৯৮৫ সালে প্রীতি ম্যাচ আয়োজন করেছিলেন আমার চিকিৎসার জন্য। তার মধ্যে সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল খেলোয়াড়ি জীবন থেকে।’ ইমতিয়াজ সুলতান জনির কন্ঠে আক্ষেপ, ‘সবসময় বলতেন মোহামেডান ক্লাবকে দেখিস। উনি অসুস্থ হওয়ার পরও ফুটবল নিয়ে চিন্তা করতেন। শেষ পর্যন্ত কিন্তু বাফুফেতে নির্বাচন করেছেন। তাও ফুটবলের জন্য। সব জায়গায় ফুটবলের জন্য লড়াই করেছেন। ফুটবল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কথাটা কখনও চিন্তাও করেননি। ফুটবলই ছিল তার বেঁচে থাকার অক্সিজেন।’
হিমশীতল অ্যাম্বুলেন্সে করে বেলা পৌনে একটার দিকে সবাইকে চিরবিদায় জানিয়ে শহীদ মিনার হয়ে বাদল রায়ের শেষকৃত্য হয়েছে সবুজবাগের রাজারবাগ মন্দিরে। সেখানে চন্দন কাঠের স্পর্শে চিরপ্রয়াণে বাদল রায়। যিনি ছিলেন একাধারে ফুটবল যোদ্ধা, সংগঠক ও রাজনীতিবিদ। এই কিংবদন্তির প্রয়াণে পুরো ক্রীড়াঙ্গন এখন বিষন্ন।