‘ইনজুরি নিয়ে কখনোই ভাবি না’

Mash 1শুধু ক্রিকেট নয়, খেলাধুলার ইতিহাসেই এক বিস্ময়ের নাম মাশরাফি বিন মুর্তজা। দুই হাঁটুতে সাত-সাতটি অস্ত্রোপচারের ধকল সামলে তিনি বোলিং করছেন নিয়মিত, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলকে। দুবাই/আবুধাবির তীব্র গরমে আর সবার মতো তারও সমস্যা হচ্ছে, পানিশূন্যতায় ভুগছেন। তবু দেশের টানে নিজেকে উজাড় করে দিতে কার্পণ্য নেই। আফগানিস্তানের বিপক্ষে মোস্তাফিজুর রহমানকে বিশ্রাম দিতে একটানা বোলিং করেছেন মাশরাফি। মঙ্গলবার টিম হোটেলে বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের ক্রিকেটের দিনবদলের নায়ক জানালেন, প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে লড়াই করতে কতটা কষ্ট হচ্ছে তার।

বাংলা ট্রিবিউন: প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ওয়ানডেতে ২৫০ উইকেট হলো আপনার। এই অর্জনকে কীভাবে দেখছেন?

মাশরাফি: (হাসি) যতদিন ধরে ক্রিকেট খেলছি, প্রতিটা ম্যাচ সমান গুরুত্ব দিয়েই খেলছি। ফিফটি পার্সেন্ট ফিটনেস নিয়েও শতভাগ দিতে চেষ্টা করেছি। কখনও ইনজুরি নিয়ে ভাবিনি। আফগানিস্তান ম্যাচেও ইনজুরিতে পড়ার আশঙ্কা ছিল আমার। একটা সময় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম খারাপ কিছু হতে পারে। মাঝে ড্রিংকসের সময় দুই ওভার করে বাইরে গিয়ে এনার্জি ড্রিংকস খেয়েছি। কিন্তু কাজ হচ্ছিল না। আসলে শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া ঘাম রিকভার হচ্ছিল না। সেই ম্যাচে আম্পায়াররা অন্তত  ৩০ বার আমাকে সাবধান করে বলেছেন, ‘ভেরি ক্লোজ টু নো বল!’ তারা আমাকে সাবধান করার পর মাথায় শুধু ‘নো বল’ ‘নো বল’ ঘুরেছে। বোলিংয়ের সময় ভাবতে হয়েছে যেন ‘নো বল’ না হয়। এভাবে বোলিং করা খুব কঠিন।

বাংলা ট্রিবিউন: তবু এই অর্জনের আনন্দ কতটা? 

মাশরাফি: এসব ছোট-খাট জিনিস সামলেই এ পর্যন্ত আসতে হয়েছে। এই টুর্নামেন্টে আমি দুইটা নো বল করেছি। আপনি কবে দেখছেন আমাকে নো বল করতে? আসলে ২৫০ উইকেট আমার কাছে ম্যাটার করে না। আমার কাছে সবচেয়ে বড় হলো, আমি সব কিছুর ভেতর দিয়ে চলতে পারছি, যে কোনোভাবে সব কিছু ম্যানেজ করতে পারছি। এটা আমার জন্য সবচেয়ে বড় স্বস্তির। অবশ্যই এটা অনেক বড় অর্জন। ক্যারিয়ারের শুরুতে অনেক স্বপ্ন ছিল আমার। সেগুলোর সব হয়তো পূরণ হয়নি। কিন্তু সব মিলিয়ে আমার মনে শান্তি আছে। আমি কখনও হাল ছাড়িনি, অনেক কঠিন সময় পার করেছি। তাই এমন একটা অর্জনে অবশ্যই আনন্দিত।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার ১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে এটাই কি সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং টুর্নামেন্ট?

মাশরাফি: অবশ্যই, এত গরমে এক পর্যায়ে শরীর চলে না। ৪৩ ডিগ্রি তাপমাত্রায় চার দিনে তিনটা ম্যাচ খেলা খুবই কঠিন। যে পরিমাণ ঘাম শরীর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে অল্প সময়ে সেটা রিকভার হচ্ছে না। এ ধরনের টুর্নামেন্টে দুই ম্যাচের মাঝে অন্তত একদিনের বিরতি থাকা উচিত।

বাংলা ট্রিবিউন: এমন কন্ডিশনে বোলিং করা কতটা কঠিন?

মাশরাফি: গরমের কারণে পেশিতে টান পড়ছে, আর তাই স্বাভাবিকভাবে খেলা যাচ্ছে না। শেষ ম্যাচে আমার কোমরে ব্যথা আর মোস্তাফিজের কাফ মাসলে  টান লেগেছিল। এসব জায়গায় ক্র্যাম্প হলে স্বাভাবিক গতিতে দৌড়ে বোলিং করা খুব কঠিন।  নির্দিষ্ট যে বলটা প্রয়োজন সেটা করা যায় না। উল্টো বাজে বল হয়ে যায়। ক্র্যাম্পের কারণে বোলারদের মানসিক অস্থিরতাও বেড়ে যায়। ক্রিকেট তো পুরোই সাইকোলজিক্যাল গেম। 

Mash 2বাংলা ট্রিবিউন: আফগানিস্তানের বিপক্ষে শেষ বলের জয়ে নিশ্চয়ই দলের আত্মবিশ্বাস ফিরেছে।

মাশরাফি: আফগানিস্তান শুধু বোলিং দিয়েই বিশ্বের অন্যতম সেরা দল হয়ে উঠেছে।  ওদের তিনজন বিশ্বমানের স্পিনার আছে । আফগানিস্তানের সঙ্গে সহজেই জিতবো, এমন কোনও ভাবনা ছিল না আমাদের। আমরা জানতাম, শতভাগ দিয়েই জিততে হবে। তবে আমরা শতভাগ দিয়ে খেলতে পারিনি। দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটসম্যান রান আউট হয়েছে, লিটন সেট হয়ে আউট হয়ে গেছে। ইমরুল পরিকল্পনা শতভাগ বাস্তবায়ন করতে পেরেছে বলেই আমরা ম্যাচটা জিতেছি। এমন জয় কখনো কখনো বড় বড় জয়ের চেয়েও দলকে উজ্জীবিত করে। খুব স্বাভাবিকভাবেই দলের মধ্যে কিছুটা হলেও আত্মবিশ্বাস ফিরেছে।

বাংলা ট্রিবিউন: শেষ ম্যাচে সমস্যা নিয়েও আপনি বোলিং করেছেন। আপনার চোটপ্রবণতার কথা সবারই জানা। ঠিক কী ভেবে বোলিংয়ে আসা?

মাশরাফি: ৩৩ ওভারের সময় মোস্তাফিজকে পাঁচ ওভার করানোর পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু মোস্তাফিজ দুই ওভার বল করেই আমাকে জানাল, সে আর পারবে না। এটা বলার পর তো আমি তাকে ইনজুরিতে ফেলে দিতে পারি না!  ওর তখন ব্যথা লাগছিল। অধিনায়ক হিসেবে কষ্ট করে হলেও বোলিং করতে হয়েছে আমাকে। আমার কাছে নিজের ইনজুরি ম্যাটার করে না। আমি এটা নিয়ে ভাবিও না।

বাংলা ট্রিবিউন: শেষ ওভারে আফগানিস্তানের দরকার ছিল ৮ রান। সেই সময় মোস্তাফিজের হাতে বল দেওয়ার পর আপনার কী মনে হচ্ছিল?

মাশরাফি: ওর ওপর আমার শতভাগ আত্মবিশ্বাস ছিল। কারণ ওকে মারতে গেলে আউট হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা। আমি শুধু ওকে বলেছি, তুই কাটারটা যেন ঠিক জায়গায় মারিস। আর কিছু ভাবার দরকার নাই।

বাংলা ট্রিবিউন: ইমরুলকে ছয় নম্বরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?

মাশরাফি: যেহেতু রশিদকে নেটে খেলার অভিজ্ঞতা ইমরুলের আছে, তাই আমরা একটা নিরাপদ পজিশন খুঁজছিলাম। ইমরুলকে হয়তো তিন নম্বরে খেলানো যেত।  কিন্তু ওকে তিনে না খেলিয়ে মুজিবকে সামলানোর জন্য মিঠুনকে ওখানে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে তো ফাজলামি করা যায় না। প্রতিটা সিদ্ধান্তের পেছনেই একটা যুক্তি থাকে। মুজিবকে ঠেকানোর জন্য মিঠুন আর মুশফিক এবং রশিদকে ঠেকানোর জন্য সাকিব আর ইমরুলকে সেট করেছিলাম। স্লগ ওভারে ফিনিশ করার জন্য রিয়াদকে রেখেছিলাম। হয়তো টপ অর্ডার ক্লিক করেনি, কিন্তু শেষে তো ক্লিক করেছে। সাকিব-মুশফিক রান আউট না হলে আমাদের স্কোরটা আরও বড় হতো। ইমরুলকে ছয় নম্বরে নামানো হুট করে নেওয়া কোনও সিদ্ধান্ত না। অনেক ভেবে-চিন্তেই আমরা সিদ্ধান্তটা নিয়েছি।