নিজের জমি নেই শাহাদাত আলীর। পরের জায়গায় থাকেন, পরের জমিতে কাজ করেন স্ত্রী সাথিনা ও সন্তান শাহীন আলমের মুখে দুই বেলা দুমুঠো ভাত তুলে দিতে। অভাব-অনটন তার সংসারের নিত্যসঙ্গী। এরকম জীর্ণ জীবনে কষ্ট বহুগুণ বেড়ে যায় শীতের দিনে। যখন বছরের অন্য সময়ের মতো কাজ থাকে না। বাধ্য হয়ে শাহাদাতকে কাজ করতে হয় বাড়ি থেকে চার কিলোমিটার দূরের ইটভাটায়।
কিন্তু ভাগ্যের খেলায় সেই দুঃসহ শীতের অতীত পেরিয়ে এখন ক্রিকেটে উষ্ণতার আবেশ পেয়েছেন শাহাদাতের সন্তান শাহীন আলম। বাংলাদেশ জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দলে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে শাহীন এখন দক্ষিণ আফ্রিকায়। দলের সাফল্য-ব্যর্থতার অনেকখানিই এখন নির্ভর করবে এই পেসারের ওপর।
অথচ তার জীবনটাই ঘোর অনিশ্চয়তায় মোড়া। প্রান্তিক কৃষক পরিবারের সন্তান হয়ে ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন দেখাও ছিলো তার জন্য ‘পাপ’। শাহীন তবুও স্বপ্ন দেখার সাহস পেয়ে যান একদিন, যেদিন এলাকার এক ভাইয়ের সঙ্গে সাইকেলে চড়ে কুড়িগ্রাম স্টেডিয়াম পার হওয়ার সময় অনেক লোকের ভিড় দেখে এগিয়ে যান । দেখেন বিকেএসপির ভর্তির জন্য চলছে ট্রায়াল। টিকিট কিনে ট্রায়ালে নেমে যান শাহীন। এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ ছিল না তার জন্য।
আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ১৫ যোদ্ধাকে নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে বাংলা ট্রিবিউনে। আজ থাকছে পেসার শাহীন আলমের একান্ত সাক্ষাৎকার−
বাংলা ট্রিবিউন: হুট করে ক্রিকেটার হয়ে গেলেন, গল্পটা শুনতে চাই।
শাহীন: আমি কখনোই ভাবিনি, ক্রিকেটার হবো। তবে গ্রামে টুকটাক যখন টেপ টেনিস বলে খেলতাম, ভালো বোলিং করতাম। সবাই বলতো আমার বোলিংটা নাকি ভালো। যে ছেলেকে ছোট থেকেই সংগ্রাম করতে হয়েছে, সে কী করে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখে! হুট করেই ২০১৬ সালে কুড়িগ্রামের জেলা স্টেডিয়ামে ট্রায়াল দিই। কিছুদিন ক্যাম্প করার পর ২০১৭ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হয়ে যাই।
বাংলা ট্রিবিউন: শুনেছি, ট্রায়ালে খালি পায়ে বল করেই নাকি কোচের নজরে পড়েছিলেন?
শাহীন: আমি গ্রাম থেকে এক বড় ভাইয়ের সাইকেলে করে কুড়িগ্রামের জেলা শহরে এসেছিলাম। ট্রায়াল দেবো এই উদ্দেশ্যে নয়, এমনিতেই ঘোরার জন্যই আসা। স্টেডিয়ামের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম প্রচুর ভিড়। আমি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কী হচ্ছে? ভাইয়া বললেন, এখানে বিকেএসপির ট্রায়াল হচ্ছে। ভাইয়া আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। পায়ে কোনও জুতা ছিলো না। আমার গায়ে টি-শার্ট আর পরনে ছিল জিন্স প্যান্ট। দেখলাম সবাই ওখানে ২০ টাকা দিয়ে ফর্ম কিনছে। আমিও নিলাম। কিন্তু আমার কাছে পাসপোর্ট সাইজের কোনও ছবি ছিলো না। ছবি ছাড়াই ফর্ম জমা দিলাম। ওখানে বিকেএসপির কোচ রুশো স্যার ছিলেন। আমাকে যখন ডাকলেন, আমি খালি পায়ে তিনটি বল করলাম। আমাকে স্যারের পছন্দ হয়। আমাকে ডেকে বললন, ভালো করে অনুশীলন করো। তোমার বোলিং ভালো। কিছুদিন পর বিকেএসপিতে আমি এক মাসের ক্যাম্পে ডাক পেলাম। ওখানে ভালো করে চার মাসের ক্যাম্পে সুযোগ পেলাম। ওটার পর বিকেএসপিতে ভর্তির জন্য এক সপ্তাহের আরেকটি ক্যাম্প হয়। ওই ক্যাম্প করে অবশেষে বিকেএসপিতে ভর্তি হই।
শাহীন: বিকেএসপিত ভর্তি হওয়ার আগে এক মাসের ক্যাম্প চলার সময় আমি রংপুর থেকে অনূর্ধ্ব-১৬ জেলা দলে খেলি। ওখান থেকে ২০১৭ সালে অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় দলে সুযোগ পাই। কিন্তু চোটে আমি ভারত সফরে যেতে পারিনি, তারপরও ভেঙে পড়িনি। অনূর্ধ্ব-১৯ দলে জায়গা করে নেওয়ার চেষ্টা ছিল। ওই বছরই অনূর্ধ্ব-১৯ দলের চ্যালেঞ্জ সিরিজে সুযোগ পাই। ওখানে ভালো করার পর আমি ক্যাম্পে সুযোগ পাই। ওখানে দুটি ম্যচের তিন ইনিংসে খেলে ৮ উইকেট নিয়েছিলাম। এরপর পারফরম্যান্স কিছুটা খারাপ হওয়ায় পরের বছরের এশিয়া কাপ থেকে বাদ পড়ি। অবশ্য পরের শ্রীলঙ্কা সিরিজেই সুযোগ হয় এবং ওই সফরে প্রথমবার আমি ৫ উইকেট পাই। সব মিলিয়ে আমি ১৮ উইকেট পেয়েছিলাম। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কিছুদিন আগে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমি এক ইনিংসে সাত উইকেট পেয়েছিলাম।
বাংলা ট্রিবিউন: শৈশবে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে, ওই সময়ের কথা মনে পড়লে কেমন লাগে?
শাহীন: আমার বাবা-মা কখনোই ভাবতে পারেননি আমি ক্রিকেট খেলবো। আমার বাবা সাধারণ কৃষক। দুই বছর আগেও শীতকাল মানেই আমার জন্য ভয়ঙ্কর কিছু সময়। এই সময়ে আমার বাবা ইট ভাটায় কাজ করতো। আমিও বাবাকে সাহায্য করতাম। শীতের সকালে পরার মতো জামা কাপড় ছিল না আমাদের, পোশাক ছাড়াই বাবা কাজে যেতেন। আমারও বাড়তি কোনও পোশাক ছিলো না। সকালে উঠে প্রতিদিন চার কিলোমিটার হেঁটে বাবার জন্য খাবার নিয়ে যেতাম। আবারও বাড়ি ফিরতাম হেঁটে। দেখা গেছে সপ্তাহে ৪-৫ দিন স্কুলে যেতে পারতাম না। অবশ্য স্কুলের স্যার-ম্যাডামরা আমাকে কিছু বলতেন না। প্রতিবছর শীত এলে ওই সময়টার কথা খুব মনে পড়ে। দুই বছর আগে কোথায় ছিলাম, আর এখন কোথায় আছি।
বাংলা ট্রিবিউন: আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না, শুরুর দিকে কীভাবে চলতো আপনার?
শাহীন: আমি যখন ক্রিকেট শুরু করি, একদিন বাবাকে বললাম আমার এক জোড়া জুতা কিনতেই দশ হাজার টাকা লাগে। তখন আমার বাবা বললো, আমি মাসে দশ হাজার টাকা রোজগার করতে পারি না, তোকে জুতা কিভাবে কিনে দেবো? তবে গ্রামের কয়েকজন ভাইকে বলার পর, তারা আমাকে সাহায্য করেছেন। শ্রীলঙ্কা সিরিজে যাওয়ার আগে মোহাম্মদ মিঠুন ভাই আমাকে এক জোড়া জুতা উপহার দেন।
বাংলা ট্রিবিউন: বাবা-মা কিংবা এলকার মানুষের ঋণ শোধের একটা তাড়না তো আছে আপনার , নাকি?
শাহীন: বাবার সঙ্গে আমিও কষ্ট করেছি। আমি জানি কতটা সংগ্রাম করে এখানে এসেছি। নিজে বুঝতে পেরেছি। বাবা যখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে ইট ভাটায় কাজ করতেন। রাত তিনটায় উঠে কাজে বের হয়ে ফিরতেন বিকালে। বাবা-মা কষ্ট করেছেন, তাদের ঋণ তো আর শোধ করা যায় না। এলাকার মানুষের সহযোগিতার ঋণ টাকা দিয়ে শোধ হবে না। তবুও চেষ্টা থাকবে দেশের হয়ে ভালো খেলে তাদের আনন্দ দেওয়ার।
বাংলা ট্রিবিউন: বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন, মা-বাবার অনুভূতি কেমন?
শাহীন: আমার বাবা কখনোই ভাবেনি তার ছেলে ক্রিকেট খেলতে বিদেশ যাবে। তার ছেলেকে টিভিতে দেখাবে। আমার বাবা-মা এটা নিয়ে অনেক খুশি। আমার ক্যারিয়ার অনেক ছোট। তারপরও আমার বাবা-মা আমাকে নিয়ে গর্ব করেন। গ্রামবাসী সবাই আমার বাবা-মাকে শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে। তাদের মুখে সবসময় আমি হাসি দেখতে চাই।
বাংলা ট্রিবিউন: দলের ও নিজের ব্যক্তিগত প্রস্তুতি কেমন হয়েছে?
শাহীন: দলের প্রস্তুতি অনেক ভালো। ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে আমাদের চারটা ক্যাম্প ছিলো। ভালো প্রস্তুতির কারণে আমরা ওখানে ভালো ফল পেয়েছি। দক্ষিণ আফ্রিকাতে যাওয়ার আগেও আমাদের প্রস্তুতি অনেক ভালো হয়েছে। বিশেষ করে বগুড়াতে হওয়া ক্যাম্প ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে কিছু প্রস্তুতি ম্যাচ আমাদের সেরা প্রস্তুতি নিতে ভূমিকা রাখবে। যেহেতু আমরা ইংল্যান্ডে ভালো করেছি, আমাদের বিশ্বাস দক্ষিণ আফ্রিকাতে আমাদের ব্যাটসম্যান ও বোলারদের খুব একটা সমস্যা হবে না। আমার প্রস্তুতিও যথেষ্ট ভালো। আমি চেষ্টা করবো সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী হওয়ার।
বাংলা ট্রিবিউন: পেসার হিসেবে নিজের শক্তির জায়গা কোনটি?
শাহীন: মূলত বাউন্সার ও ইয়র্কার। এই দুটিতে আমি ব্যাটসম্যানদের পরাস্ত করি বেশি। যত বড় ব্যাটসম্যানই হোক না কেন আমি তাকে বাউন্সারে পরাস্ত করতে পারি।
বাংলা ট্রিবিউন: নিজের বোলিং নিয়ে সিনিয়র কারও পরামর্শ নিয়েছেন?
শাহীন: আমি যখন শ্রীলঙ্কা গিয়েছিলাম, তখন লাসিথ মালিঙ্গার সঙ্গে কথা হয়েছিলো। তিনি আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন পেস বোলারদের অপশন হলো তিনটি- সামনে বোলিং করলে বোল্ড, ক্যাচ ও এলবিডব্লিউ হওয়ার সুযোগ থাকবে। কিন্তু পেছনে বোলিং করলে কেবল ক্যাচ আউটের সুযোগ থাকবে।
বাংলা ট্রিবিউন: মাশরাফি মুর্তজা আপনার প্রিয় মানুষ কেন?
শাহীন: মাশরাফি ভাইয়ের মানসিকতা অসাধারণ। তাকে সবাই অনেক পছন্দ করে। আমিও চাই তার মতো ভালো মানুষ হতে, যেন আমাকেও সবাই পছন্দ করে।
বাংলা ট্রিবিউন: মুশফিকুর রহিম ও শোয়েব আখতার আপনার প্রিয় ক্রিকেটার, কারণ কী?
শাহীন: মুশফিক ভাই পরিশ্রমী ক্রিকেটার। তার কাছ থেকে প্রেরণা নেওয়ার অনেক কিছু আছে। আমিও তার মতো পরিশ্রমী হতে চাই। শোয়েব আখতার আমার আইডল। আমি আগে থেকেই জানতাম তিনি অনেক জোরে বোলিং করে। আমারও স্বপ্ন তার মতো জোরে বোলিং করার। আমি একবার গতি মেপেছিলাম, আমার সর্বোচ্চ গতি হয়েছিলো ১৩৮।
নাম: মোহাম্মদ শাহীন আলম
ডাকনাম: শাহীন
জন্ম: ১ আগস্ট ২০০১
জন্মস্থান: কুড়িগ্রাম
উচ্চতা: ৬ ফুট ১ ইঞ্চি
পড়াশোনা: এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষ
বোলিং স্টাইল: ডানহাতি
প্রিয় ডেলিভারি: বাউন্সার ও ইয়র্কার
প্রিয় মানুষ: মাশরাফি
প্রিয় ক্রিকেটার: মুশফিক ও শোয়েব আখতার
প্রিয় বন্ধু: বাবা
ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত: অনূর্ধ্ব-১৭ দলে থাকতে ২০১৬ সালের বিপিএলে ডেভিড মালানকে নেটে বোলিং করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তিনি আমার বোলিংয়ের প্রশংসা করেছিলেন।
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন।