দলের সাধারণ সদস্য হিসেবে খেলেছেন ২০০৩ ও ২০০৭ বিশ্বকাপ। ইনজুরির কারণে ঘরের মাঠে ২০১১ বিশ্বকাপ খেলা হয়নি। তবে পরের দুটি বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আরও একটি ওয়ানডে বিশ্বকাপ শুরু হলো। কিন্তু কোনও চাপ নেই মাশরাফি বিন মুর্তজার! তিনি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। তারপরও প্রিয় ক্রিকেটকে ভুলে থাকার সুযোগ কোথায়! দেশের ক্রিকেট তো বটেই, বিশ্ব ক্রিকেটের খোঁজ-খবরও তার জানা। মাশরাফি মনে করেন, এবারই বিশ্বকাপ জেতার সেরা সুযোগ বাংলাদেশের। বিশ্বকাপ উপলক্ষে বাংলা ট্রিবিউনকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি।
আপনার হাত ধরেই ওয়ানডে ফরম্যাটে দিনবদলের শুরু। সেই পথ ধরে সমর্থকরা এখন বিশ্বকাপ ট্রফি ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এবারের বিশ্বকাপকে ঘিরে আপনার প্রত্যাশা কী?
মাশরাফি বিন মুর্তজা: ২০১৪ সালে ওয়ানডে দলের অবস্থা খুব ভালো ছিল না। ২০১৫ বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে দলের সবাই ভালো খেলেছিল, ফলও আমাদের পক্ষে এসেছিল। ওই সময় তরুণ খেলোয়াড় যারা এসেছে, তারা পারফরম্যান্স করেছে। ফলে দল হিসেবে বাংলাদেশ সফলতা পেয়েছে। তবে এবারের বিশ্বকাপ ঘিরে প্রত্যাশা অনেক বেশি। এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে আশা করছি, বাংলাদেশ কমপক্ষে সেমিফাইনাল খেলবে। এখন অনফিল্ডে ভালো খেলতে পারলেই হয়। বিশ্বকাপের সবচেয়ে অভিজ্ঞ দল হিসেবে আমি এবং আমরা সবাই বাংলাদেশের কাছ থেকে ভালো ফল আশা করছি।
সত্যিই কি বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিততে পারে?
মাশরাফি: আমি পুরোপুরি আশাবাদী। কিন্তু বিশ্বকাপ জিততে গেলে কেবল ভালো খেললেই হয় না। জটিল ও কঠিন মুহূর্তগুলোতে ভাগ্যের সহায়তারও প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ সেমিফাইনাল না খেললে হতাশ হবো। কারণ, বাংলাদেশের মতো এবারের আসরে আর কোনও অভিজ্ঞ দল নেই। আমাদের এখন বিশ্বকাপ জেতার সময় এসেছে। দলের জুনিয়র যারা আছে, লিটন-তাসকিন-মিরাজ-শান্তরাও পাঁচ-সাত বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে ফেলেছে। এত অভিজ্ঞ খেলোয়াড় থাকার পর এমন স্বপ্ন দেখা অমূলক নয়। তারপর যেটা বললাম– নির্দিষ্ট দিনে ও নির্দিষ্ট কিছু মুহূর্তে ভালো খেলা, কঠিন মুহূর্তে ভালো ক্যাচ নেওয়া; এসব খুব জরুরি।
তবু ক্রিকেটীয় দক্ষতার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জেতার সামর্থ্য রাখে?
মাশরাফি: স্কিলের দিক থেকে যথেষ্ট ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। তবে মানসিক ব্যাপারটাতে আমরা কতখানি মানিয়ে নিতে পারবো সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় বাংলাদেশ দল চাপে ভেঙে পড়ে, কিন্তু বড় ম্যাচে চাপকে জয় করা বেশি জরুরি। আশা করি বাংলাদেশ সেই অবস্থানে আছে।
সর্বশেষ বিশ্বকাপে আপনার নেতৃত্বে খেলেছিল দল। গত চার বছরে কোথায় পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন?
মাশরাফি: সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আমাদের বোলিং আক্রমণ। দারুণ একটি বোলিং অ্যাটাক এখন হয়েছে আমাদের। তাসকিন, মোস্তাফিজ, এবাদত, শরিফুল, হাসানসহ সবাই ভালো করছে। সাইফউদ্দিনের ইনজুরি না হলে আরও খুশি হতাম। ব্যাটিংয়ে সবাই ভালো করছে। নির্দিষ্ট দিনে ২-১ জন ভালো করছে। বড় রান করার জন্য হয়তো বা মিডল অর্ডার, টপ অর্ডার, লেট মিডল অর্ডারে ১-২ জনকে বড় রান করতে হবে। এভাবে সবার একত্রিত পারফরম্যান্স খুব প্রয়োজন হবে বিশ্বকাপে। স্পিন বিভাগে সাকিব আছে, মিরাজ আছে। মিরাজের পারফরম্যান্স তো অসাধারণ। সব কিছু মিলিয়ে দলে একটা ভালো পরিবর্তন এসেছে। দেশের বাইরেও আমরা নিয়মিত ম্যাচ জিতেছি। খুব ভালো একটি দল হয়ে উঠেছি আমরা।
আপনি অধিনায়কত্ব ছাড়ার পর সেখান থেকে দলটিকে টেনে নিয়ে গেছেন তামিম ইকবাল। কিন্তু তামিম শেষ পর্যন্ত নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। গত সাড়ে তিন বছর দলকে আগলে রেখে বিশ্বকাপের মঞ্চে এভাবে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়া কতটা হতবাকের?
মাশরাফি: অধিনায়ক হিসেবে তামিম দারুণ করেছে। দলকে খুব ভালো অবস্থানে নিয়ে গেছে। এবার বিশ্বকাপে দেখেন কোয়ালিফায়ার তো খেলাই লাগেনি, উল্টো ওপরের সারির দল হিসেবেই আমরা বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছি। তামিমের জন্য অবশ্যই দুর্ভাগ্য, ইনজুরির ওপর তো কারও হাত নেই। তামিমকে বিশ্বকাপে আমাদের খুব প্রয়োজন ছিল। আর সাকিব, সে তো পরীক্ষিত। আগেও অধিনায়কত্ব করেছে। বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে সাকিব ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প বিসিবির হাতে ছিল না। আমি মনে করি সাকিব নিজের সেরা সময়ে আছে। সে জানে তার কাজটা কী, দলের চাওয়া কী। আশা করি সাকিবের নেতৃত্বে এই বিশ্বকাপে আলো ছড়াবে বাংলাদেশ।
তারপরও তামিম ইস্যুতে নানা আলোচনা হয়েছে। এসব ঘটনার প্রভাব কি দলে পড়তে পারে?
মাশরাফি: না। আমার কাছে এগুলো মনে হয় না। কথা হয়, হতেই থাকবে। ভবিষ্যতেও নানাভাবে হবে। এটা সব দলেই হয়। মাঠে গিয়ে কি মানুষ এসব মনে করে ক্রিকেট খেলে? গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ কেমন করছে, প্রথম ম্যাচই আসলে পুরো টুর্নামেন্টের অনেক কিছু সেট করে দেয়! এমন না যে, প্রথম ম্যাচ না জিতলে ক্ষতি হয়ে যাবে। তবে প্রথম ম্যাচে জিততে পারলে মানসিক দিক থেকে অনেক এগিয়ে থাকা যায়। আমাদের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি প্রযোজ্য।
গত বিশ্বকাপেও গ্রুপ পর্ব ছিল না। বাংলাদেশও শেষ পর্যন্ত পারেনি। এবারও সব দলের বিপক্ষেই খেলতে হবে। এটা কি বাংলাদেশের জন্য ভালো হলো, নাকি আরও কঠিন?
মাশরাফি: এ ফরম্যাট সহায়ক, আবার কঠিনও। সব দলের সঙ্গে এখন খেলতে হবে। সুযোগ কিংবা অসুবিধা আমাদের থাকলে অন্য দলের বেলাতেও সেটি থাকছে। নিয়মটা সবার জন্য একই। ভারত ঘরের মাঠে খেলছে, তারা হয়তো কিছুটা হোম অ্যাডভান্টেজ পাবে। এছাড়া সব দলের জন্যই সমান। তবে এই ফরম্যাটে সুবিধা হলো, একটা খারাপ ম্যাচ গেলেও ফিরে আসার সুযোগ থাকবে। রানরেটের ব্যাপারও আছে।
ভারতে ভালো করতে হলে কোথায় বাংলাদেশকে আরও উন্নতি করতে হবে?
মাশরাফি: সাধারণত আইসিসির ইভেন্টে উইকেটগুলো ভালো হয়। সুতরাং বোলিং বিভাগ ভালো রাখতে হবে। আর যেহেতু ভালো উইকেট থাকে, ব্যাটিংটাও ক্যালকুলেটিভ করতে হবে। দুই দিকেই খেয়াল রাখতে হবে। ব্যাপারটা এমন না যে, আপনি কেবল ভালো ব্যাটিং কিংবা ভালো বোলিং করেই জিততে পারবেন। আর ফিল্ডিং ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় অংশ। এখানে শর্টকাট কোনও পথ নাই। আমাদের সব বিভাগেই ভালো করে ম্যাচ জিততে হবে।
স্ট্রাইক রেট নিয়ে অনেক আলোচনা আছে, এ ব্যাপারে আপনার মতামত?
মাশরাফি: সবসময় স্ট্রাইক রোটেটই হলো ব্যাটারশিপ। এখন স্ট্রাইক রেট নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে; কারণ আমরা চার মারতে পারি, কিন্তু স্ট্রাইক রোটেট কম করি। ছয় বল খেলে একটা ছয় মারি, বাকি পাঁচটি ডট খেলছি। স্ট্রাইক রোটেটে আমাদের বিশেষজ্ঞ মুশফিক ও সাকিব। ওরা যখন একসঙ্গে ব্যাটিংয়ে থাকে তখন একজন আরেকজনকে সহায়তা করে। সাকিবের বিষয়টি প্রকৃতি-প্রদত্ত। হয়তো সাহসটা বেশি। এই জায়গায় অন্যদেরও উন্নতি করতে হবে।
বাংলাদেশ এখন ওয়ানডেতে সব দলকে হারানোর সামর্থ্য রাখে। আপনার মতে কোন দলকে টার্গেট বানানো উচিত?
মাশরাফি: এভাবে বলা এবং চিন্তা করা কঠিন। আমাদের প্রথম ম্যাচ আফগানিস্তানের বিপক্ষে। অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে– আমরা যেন ওদের বিপক্ষে জিততে পারি। তবে যদি টার্গেট করে যাই যে, ‘একে-ওকে হারাবো’ তাহলে সেসব ম্যাচে বেশি মনোযোগ থাকবে আর অন্যগুলোতে কোনও সুযোগই থাকবে না। ফলে নির্দিষ্ট কোনও দলকে টার্গেট করা ঠিক হবে না। নয়টা ম্যাচ নিয়েই আমাদের আলাদা পরিকল্পনা থাকতে হবে। প্রতিটি দলের শক্তি ও দুর্বলতার জায়গা ভিন্ন, সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে। সেভাবেই টিম তৈরি করতে হবে, পরিকল্পনা সাজাতে হবে। এমন না যে, আপনি নির্দিষ্ট পাঁচটি ম্যাচ টার্গেট করে গিয়ে সব জিতে যাবেন। আপনাকে অবশ্যই সব ম্যাচ নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে।
ক্রিকেট দলগত খেলা, তারপরও কোন ক্রিকেটারদের কাছ থেকে ভালো পারফরম্যান্স প্রত্যাশা করছেন?
মাশরাফি: সবার কাছ থেকেই ভালো পারফরম্যান্স আশা করছি। আগেই বলে দিলাম ‘এ ভালো করবে’, ‘ও ভালো করবে’– এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। তবে অবশ্যই সিনিয়ররা লিড করবে, এটা খুব স্বাভাবিক চাওয়া। জুনিয়ররা ভালো করছে, তারাই মূলত দলের পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে এবং দেবে। কেউ একাই ম্যাচ জেতাতে পারে, সেটা ভিন্ন জিনিস। তবে একজন দর্শক হিসেবে চাইবো, ঘুরে-ফিরে সবাই পারফর্ম করে দলকে ভালো জায়গায় নিয়ে যাক।
ব্যাটিংয়ে লিটন-শান্ত এবং বোলিংয়ে তাসকিন-মোস্তাফিজের সেরা পারফরম্যান্স বাংলাদেশের জয়ের ক্ষেত্র তৈরি করতে নিশ্চয়ই ভূমিকা রাখবে?
মাশরাফি: আলাদাভাবে কোনও খেলোয়াড়ের কথা বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে বলবো না। এখানে অনেক চাপ থাকে। বহু ধরনের ঘটনা ঘটে। এগুলো আলাদা করে বলতে চাই না। এমন না যে, লিটন আর শান্ত সব ম্যাচ জিতিয়ে দেবে কিংবা তাসকিন-মোস্তাফিজরাই কেবল ভালো বোলিং করবে। আগেও বললাম– তারা টপ অর্ডারে আছে, তারা পারফর্ম করলে অনেক সুবিধা পাবে দল। কিন্তু সবাইকে মাথায় রাখতে হবে– সুযোগ যে যেখানে পাবে, তাদের দায়িত্বটা পালন করতে হবে। তাহলেই দল ভালো ফল পাবে।
ভারত-পাকিস্তানকে হারানো সম্ভব?
মাশরাফি: ভারত-পাকিস্তানকে না হারানোর কোনও কারণ দেখি না। অবশ্যই সম্ভব। বিশ্বকাপের মঞ্চে তো আমরা তাদের হারিয়েছি। সুতরাং বিশ্বকাপকে আলাদা করে মাথায় না রেখে খেলতে হবে।
মাশরাফি বিন মুর্তজার ভবিষ্যদ্বাণী
বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের চার দল
পূর্বাভাস দেওয়া খুব কঠিন। তবে চার দলের একটি বাংলাদেশ হবে, এটা বিশ্বাস করি। আমি চাইবো– বাংলাদেশ বিশ্বকাপে ভালো করুক, জিতুক। কিন্তু চ্যালেঞ্জ আছে অনেক। সেগুলো জিততে হবে।
বিশ্বকাপের সেরা ব্যাটার
ব্যাটারদের ক্ষেত্রে বিরাট কোহলি আছে, ওইদিকে জো রুট-স্টিভেন স্মিথ-কেন উইলিয়ামসন আছে। এছাড়া বাংলাদেশের লিটন দাস আছে। এমন প্রতিটি দেশেরই ২-১ জন করে সেরা ব্যাটার আছে। যারা ভালো করতে পারে। এমনও হতে পারে, তাদের বাইরে কেউ অসাধারণ খেলে সেরা হয়ে গেলো। যেমন গত বিশ্বকাপে সাকিবকে কেউ চিন্তাই করেনি। কিন্তু সাকিব ছিল সর্বোচ্চ (তৃতীয়) রান সংগ্রাহক।
বিশ্বকাপের সেরা বোলার
বোলারদের নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। সব দলেই সেরা বোলার আছে। পেসার আছে, স্পিনার আছে। এসব অনুমান করে বলা কঠিন। তবে তাসকিন ভালো করছে। আমি চাই, তাসকিন সেরা উইকেট শিকারির তালিকায় থাকুক।