‘মেয়েদের ফুটবলে দরকার স্পনসর ও সরকারের সহযোগিতা’

অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জয়ী বাংলাদেশমেয়েদের ফুটবলে আলোকিত বাংলাদেশ। গত মাসেই অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায় দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তিশালী দল হয়ে ওঠা বাংলাদেশের মহিলা ফুটবলের উত্থান, বেড়ে ওঠা ও সাফল্যের গল্পের শেষ পর্ব আজ-

ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর স্কুল ও কলেজ সবচেয়ে প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের দিয়েছে মেয়েদের ফুটবলে। মফিজ উদ্দিন, মফিজ স্যার হিসেবে পরিচিত এই কোচ তার স্কুলকে জিতিয়েছেন হ্যাটট্রিক শিরোপা। জাতীয় যুব মহিলা দলে এই অঞ্চল থেকে খেলছে ১১ খেলোয়াড় এবং তারা প্রত্যেকে গত চার বছরে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পাওয়া সাফল্যে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যাদের মধ্যে আছে গোলরক্ষক মাহমুদা আক্তার, ডিফেন্ডার শামসুন্নাহার ও মিডফিল্ডার সনজিদা আক্তার ও মারিয়া মান্ডা।

বয়সভিত্তিক দলগুলোতে নেতৃত্ব দেওয়া মারিয়া দিনকয়েক আগে সাফল্য পাওয়া অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে মাঝমাঠে বিশাল অবদান রেখেছে রাঙামাটির মনিকা চাকমার সঙ্গে।

‘বঙ্গমাতা স্কুল টুর্নামেন্ট শুরুর এক মাস আগে মফিজ স্যার দল গঠন করেন। তখনই আমরা প্রথমবার ফুটবল খেলি। আমরা প্রতিদিন অনুশীলন করতাম। শিরোপা জেতার পর আমাদের সবকিছু পাল্টে যায়। নিয়মিত খেলার মধ্যে থাকায় আমাদের কাজটা সহজ হয়ে গেছে।’- মঙ্গলবার ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেছে মারিয়া।

ধীরে ধীরে দেশের অন্যান্য অঞ্চল ময়মনসিংহের মহিলা ফুটবলের আধিপত্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ছোটন বলেছেন, ‘কলসিন্দুরের সঙ্গে অন্যান্য এলাকা থেকে আসা মেয়েরাও কম অবদান রাখেনি। টাঙ্গাইলের শ্রীমতি কৃষ্ণা রানী, কুষ্টিয়ার নীলা (নীলুফা ইয়াসমিন), রংপুরের ইশরাত জাহান মৌসুমী ও সিরাত জাহান স্বপ্না দারুণ খেলছে।’

ক্যাম্পে থাকা ৩৯ জন মেয়ের মধ্যে ময়মনসিংহের ১১, রংপুরের ৮, সাতক্ষীরার ৪, তিনজন করে ঠাকুরগাঁও, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া ও একজন করে রাজশাহী, সিলেট ও কক্সবাজারের।

সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ের সাঁওতাল মেয়েরা নজর কেড়েছে। গত বছরের অনূর্ধ্ব-১৪ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের রানার্স-আপ হওয়া ঠাকুরগাঁও দলের আট মেয়ে এসেছে সাঁওতাল পরিবার থেকে, যারা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিয়েছে তাদের মাঠের ফুটবলে।

দেশের মোট জনসংখ্যায় ২ শতাংশ হয়েও এই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে মহিলা ফুটবলে। কেন তাদের অবদানই বেশি, এই রহস্য উন্মোচন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন কণা, ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা বসবাস করে মাতৃপ্রধান পরিবারে, যে কারণে তারা বেড়ে ওঠে স্বাধীনভাবে। যাতে তাদের নিজেদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় এবং তার সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম ও ফিটনেস দেশের অন্য অঞ্চলের মেয়েদের থেকে তাদের আলাদা জায়গায় রাখে।’

যুব মহিলা ফুটবলে বাংলাদেশের সাফল্যের পেছনে ভৌগোলিক একটা বিষয়ও থাকতে পারে। ভারতের যুব মহিলা দল গত মাসে বাংলাদেশে এসেছিল অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে। তাদের প্রধান কোচ মায়মল রকি দীর্ঘদিন কাজ করছেন মেয়েদের ফুটবলের সঙ্গে। তিনিই জানিয়েছেন, মনিপুর ও ওড়িশার মেয়েরা সবসময় ফর্মে থাকে ও ভারতের মহিলা দলের নিয়ন্ত্রণও থাকে তাদের হাতেই। এই দুটি রাজ্য অবস্থিত ভারতের উত্তরাঞ্চলে এবং রাজ্য দুটির মাঝেই অবস্থান বাংলাদেশের। গত তিন বছরের সাফল্যময় ভ্রমণে বাংলাদেশের মেয়েরা হারিয়েছে তাদের পশ্চিমে থাকা এশিয়ার প্রায় সব দেশকে, যদিও হারাতে ব্যর্থ হয়েছে পূর্বে থাকা বেশিরভাগ দেশকে; যার মধ্যে রয়েছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, উত্তর কোরিয়া, চীন ও থাইল্যান্ড। পূর্বাঞ্চলের এই দেশগুলো রাজত্ব করছে এশিয়া ও মেয়েদের বিশ্ব ফুটবলে।

থাইল্যান্ডের এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের আগে মেয়েরা গত বছর দুইবার জাপান সফর করেছিল। তারা ওসাকার সাকাই নামের ফুটবল একাডেমিতে কাটিয়েছিল দুই সপ্তাহের বেশি সময়। কোচ ও মেয়েরা এখনও আলোচনা করেন ওখানে পাওয়া একাডেমির সুযোগ-সুবিধা নিয়ে।

‘একাডেমির মধ্যে আছে ১৮টি খেলার মাঠ, যেগুলোর সবটাতে আধুনিক অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। এটার মতো জাপানের একারই মোট ৪৬টি ফুটবল একাডেমি আছে। অথচ আমাদের একটাও নেই।’- ফিফার নির্বাহী কমিটির সদস্য কিরণ বলেছেন কথাটা। সঙ্গে যোগ করেছেন, ‘বাফুফের একার পক্ষে এটা সম্ভব না। এর জন্য দরকার অনেক বড় স্পনসর ও সরকারের সহযোগিতা।’

বাফুফের সেক্রেটারি আবু নাঈম সোহাগ ঢাকা টিবিউনকে বলেছেন, তারা এই প্রতিভাবান ফুটবলারদের ভবিষ্যত নিয়ে গভীরভাবে ভাবছেন। ‘ওই দেশগুলোর মতো আর্থিক অবস্থা আমাদের অতটা ভালো না। এখন আমরা যেটা করতে পারি, সেটা হলো বিকেএসপিতে প্রাথমিক বন্দোবস্ত করতে পারি মেয়েদের।’- সোহাগ কথাটা শেষ করেই ঘোষণা দিয়েছেন, এই বছরই একটা জিমের ব্যবস্থা হয়ে যাবে মেয়েদের।

এশিয়ার শীর্ষ দেশগুলো থেকে বাংলাদেশের মেয়েরা পিছিয়ে আছে ফিটনেসে। কিরণ জানিয়েছেন, যদি জাতীয় দলের শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়, তবে তাদের প্রথম খেলোয়াড়দের শারীরিক শক্তি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বিশ্বাস করেন যে, মেয়েদের নিয়ে বাফুফের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা সিনিয়র পর্যায়েও আলো ছড়াতে পারবেন তারা।

ঘরোয়া মহিলা ফুটবল কাঠামো উন্নত করা ও নিয়মিতভাবে অনুসরণ করতে হবে। মহিলা ফুটবল লিগ হয়েছে মাত্র দুইবার- ২০১১ ও ২০১৩ সালে। এরপর আর কোনও প্রতিযোগিতা হয়নি। যদিও সোহাগ নিশ্চিত করেছেন, এই বছরই চালু হবে লিগ।

বেশিরভাগ মেয়েরা এসেছে অস্বচ্ছল পরিবার থেকে। সেই তারাই বেছে নিয়েছে মহিলা ফুটবলকে, যেখানে ভবিষ্যৎ কিংবা স্বচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার কোনও নিশ্চয়তা নেই। ৩৯ জন মেয়ের মধ্যে ২১ জন মাসে ১০,০০০ টাকা বেতন পায় বাফুফে থেকে, বাকিরা পায় ৩,০০০ টাকা।

ছোটনের সঙ্গে সহকারী কোচ মাহবুবুর রহমান লিটু মহিলা ফুটবলের সঙ্গে যোগ দেন ২০১০ সালে। যেখানে মাহমুদা আক্তার সহকারী কোচ হিসেবে কাজ শুরু করেন ২০১৫ সাল থেকে। সাবিনা জাতীয় কোচিং স্টাফে নাম লেখান গত বছর। ২০১৭ সালের শুরুর দিকে ইংলিশ কোচ জন উইটলি তিন মাস কাজ করেছিলেন স্ট্রেন্থ ও কন্ডিশনিং কোচ হিসেছে, নিউজিল্যান্ডের রায়ান স্যান্ডফোর্ড চার মাস কাজ করেছেন গোলরক্ষকের কোচের ভূমিকায়। বাফুফের টেকিনিক্যাল ও স্ট্রেন্থ পরিচালক হিসেবে ২০১৬ সালের মাঝামাঝিতে যোগ দেওয়ার পর ইংল্যান্ডের পল স্মললিও মহিলা দলের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন।

যদি দেশের মহিলা ফুটবলকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, তাহলে ২০০২ ও ২০০৯ সাল ছিল মেয়েদের ফুটবল চালুর প্রথম ধাপ; যখন মহিলা ক্রীড়া সংগঠক ও নারীবাদী কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন মৌলবাদীদের প্রতিরোধ ভাঙার পথে, যারা আটকাতে চেয়েছিল মেয়েদের ফুটবলকে। দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত পর্বটা শুরু স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে, যেখানে দূর হয়ে যায় মেয়েদের নিয়ে সব কুসংস্কার।

কোনও সন্দেহ নেই, জাতীয় যুব মহিলা দলের ধারাবাহিক সাফল্যের গল্প দেশের মেয়েদের অন্যান্য খেলায় অনুপ্রেরণা জোগাবে। সেটা শুধু ফুটবলে নয়, বরং অন্য খেলাতেও।

(ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত)