‘জাতীয় দলে আবেগ নয়, চ্যালেঞ্জ নিয়েই খেলতে হয়’

সেই যে ২০১৫ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক নারী ফুটবলের শিরোপা দিয়ে শুরু। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে সব ট্রফি ছুঁয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সেরাদের তালিকায় এখন লাল-সবুজ দলের মেয়েরা। সাফে সিনিয়রদের পাশাপাশি বয়সভিত্তিক আসরগুলোর ট্রফিও নিজেদের ঝুলিতে এসেছে। সবশেষ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি জিতে নিজেদের আরও উঁচুতে নিয়ে গেছে মেয়েরা। নারী ফুটবল দলের এই অগ্রযাত্রার নেপথ্যে রয়েছেন কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। টাঙ্গাইলের এই সাবেক ফুটবলারের হাত ধরেই সব ট্রফি শোকেসে শোভা পাচ্ছে। সর্বশেষ সাফল্যের পর মুখোমুখি হয়েছেন বাংলা ট্রিবিউনের। সাফ জেতার আগে-পরের সব ঘটনা উঠে এসেছে তার কথায়।

অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশের ফুটবলে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মেয়েরা আসছেন। যারা ভালো করছেন টিকে যাচ্ছেন। তবে এর পেছনে কঠোর পরিশ্রম, শৃঙ্খলা কিংবা নিয়মিত অনুশীলনের পাশাপাশি আরও একটি বিষয়ও রয়েছে। তা হলো তাদের মাঝে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের বীজ বপন করে দেওয়া- ভালো করতে পারলে সুযোগ মিলবে এগিয়ে যাওয়ার।

সেজন্য প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা অবলম্বন করাকে মূল পাথেয় মনে করছেন কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন, ‘আজকের এই সাফল্যের অন্যতম কারণ হলো স্বচ্ছতা। খেলোয়াড়রা জানে এখানে টিকে থাকতে হলে নিজেকে নিংড়ে দিতে হবে। কঠোর অনুশীলনের সঙ্গে পারফরম্যান্সটাও ঠিকমতো দেখাতে হবে। উন্নতি করতে না পারলে কিছু করা সম্ভব নয়। যে ভালো করবে দলে থাকবে। তা না হলে টিকে থাকা যাবে না। কেননা, জাতীয় দলে আবেগ নয়, চ্যালেঞ্জ নিয়েই খেলতে হয়।’

ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ফুটবলে সাফল্য বেশি হলেও তাদের লিগ অতটা শক্তিশালী নয়। এছাড়া জাতীয় পর্যায়েও নিয়মিত খেলা হয় না। তবু স্বল্প পরিসরেও মেধাবী খেলোয়াড় উঠে আসছে। ফলে সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় বেছে নিতে সমস্যা হচ্ছে না বলে দাবি ছোটনের। যাদের বাছাই করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে ভালো করার তাগিদ তৈরিতেও ভূমিকা রাখা হচ্ছে। ছোটন বলছিলেন, ‘এখানে বাফুফে ভবনের অ্যাকাডেমিতে চ্যালেঞ্জের আবহ তৈরি করা হয়েছে- প্রতিদিন মানসিকভাবে উন্নতি করতে হবে, টিকে থাকতে হবে, সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সিনিয়র থেকে নতুন যারা সবার জন্যই একই বার্তা। তাতে মেয়েরা সেভাবেই বেড়ে উঠছে, ভালো করছে।’

এখানে আরেকটি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ, বাংলাদেশ শুধু সাফ অঞ্চলেই ভালো করছে। এশিয়ার অন্য পর্যায়ে ভালো করার সুযোগ মিলছে না। সেজন্য পরিকল্পনার প্রসার ঘটানোর দিকে দৃষ্টি দিতে চাইছেন ছোটন, ‘সাফের বাইরে গিয়ে সাফল্য পাওয়া কঠিন কিছু নয়, সম্ভব। আগে বলতো বয়সভিত্তিক আসরে সাফল্য আসছে, সিনিয়রে আসছে না। একই খেলোয়াড় বারবার খেলছে। অন্য খেলোয়াড় আসছে না। এখন তো অনূর্ধ্ব-১৪ থেকে শুরু করে সিনিয়র আসরেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। ভারত ও নেপালের মতো শক্তিশালী দলগুলোকে হারিয়েছি।’

তারপর বলেছেন, ‘এখন পরিকল্পনা বাড়াতে হবে। এখানে (বাফুফে ভবনে) ৭০ জনের বেশি মেয়েকে রেখে অনুশীলন সম্ভব নয়। যাদের সঙ্গে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি তাদের পর্যাপ্ত অ্যাকাডেমি আছে, আমাদের নেই। অ্যাকাডেমি আরও বাড়াতে হবে।’

বিশেষ করে তৃণমূল থেকে যারা উঠে আসছেন, তাদের পেছনে আলাদা করে যত্ন নিতে জোর দিচ্ছেন তিনি, ‘এখানে জাতীয় দলের বিভিন্ন স্তরে খেলোয়াড় আসছে তৃণমূল থেকে। এসে মানসিক ও কঠোর পরিশ্রম করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। ওখানেই যদি অ্যাকাডেমির মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে আসতে পারে তাহলে ভালো হয়। খেলার পাশাপাশি মানসিকভাবেও তৈরি হবে। তখন তাদের নিয়ে কাজ করতে সহজ হবে। না হলে খেলোয়াড়দের হঠাৎ করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এসে সবকিছু মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়। আর বাফুফে ভবনে ইচ্ছে করলেই তো অনেক খেলোয়াড় নিয়ে আবাসিক অনুশীলন সম্ভব নয়। জায়গা তো নেই।’

সাফ অঞ্চলে বয়সভিত্তিক ছাড়াও সিনিয়রদের মিলিয়ে নারী ফুটবলে মোট ৫টি ট্রফি জিতেছে বাংলাদেশ। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪-তেও দুটি ও জকি কাপ অনূর্ধ্ব-১৫-তে ট্রফি এসেছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য এই অঞ্চলে ট্রফি জেতা অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে। কোচ যদিও তা মানতে নারাজ। তার ভাষায়, ‘না, আমি তা মনে করি না। বিষয়টা সবসময় চ্যালেঞ্জের। সেটা মাথায় রেখেই আমরা খেলে থাকি। সামনের দিকে মেয়েদের লড়াকু মনোভাব বৃদ্ধি পেলে আরও ভালো কিছু হবে।’

কিছু দিন আগে জাতীয় দল থেকে দুজন খেলোয়াড় বাদ পড়েছেন- আনাই মোগিনী ও সাজেদা খাতুন। এ নিয়ে চারদিকে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। পারফরম্যান্স ঠিকমতো যাচাই না করেই তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। তবে কোচ বলছেন অন্য কথা। তার ব্যাখ্যা, ‘এখানে সবকিছু স্বচ্ছ। পারফরম্যান্স করতে পারবেন তো টিকে থাকবেন। না হলে পারবেন না।’

তারপরই উদাহরণ টেনে বললেন, ‘এই যে আইরিন খাতুন। সরাসরি নারী লিগ থেকে সাফ অনূর্ধ্ব-২০ পর্যায়ে খেলছে। আগে কখনও বয়সভিত্তিক দলে খেলেনি। ওকে আগে চিনতাম না। খেলা দেখেই দলে নেওয়া হয়েছে। যারা বাদ পড়েছে তাদের চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। আমি এখানে বসে থাকার কিছু দেখছি না। বাদ দিলেও নতুন পথ খুঁজে নিতে হবে। এখানে আবেগ দেখানোর কিছু নেই। যারা ভালো খেলছে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর যারা বাদ পড়েছে তাদের তো কোনও উন্নতি নেই। তহুরা, স্বপ্না, কৃষ্ণা, রিপারা তো ভালো করছে। এখন বলেন, কাদের দলে থাকা উচিত আর কাদের নয়।’