বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল সেই সময়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ১৬টি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেছে। ১৬টি ম্যাচের মধ্যে জিতেছিল ১২টিতে। তিনটিতে হার ও একটিতে ড্র হয়েছিল। সেই ম্যাচগুলো থেকে অর্জিত অর্থ তুলে দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে। চিরস্মরণীয় দলটির অধিনায়ক ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। স্বাধীন বাংলা দল ও নিজের ক্যারিয়ারসহ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে।
(আজ মৃত্যুবরণ করছেন জাকারিয়া পিন্টু। তার নেওয়া সবশেষ সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছিল ২০২২ সালের মার্চে বিশেষ প্রকাশনা ‘জয় বাংলা’ গ্রন্থে)
সেই সাক্ষাৎকারটি আরেকবার ফিরে দেখা যাক-
বাংলা ট্রিবিউন: স্বাধীন বাংলা দলের অনেক গল্প আছে। এই দলটির সঙ্গে আপনি সম্পৃক্ত হলেন কীভাবে?
জাকারিয়া পিন্টু: এটা অনেক বড় বিষয়। এর পেছনে ইতিহাস আছে। স্বাধীন বাংলা দল গঠনের সময় দিনাজপুরের বাঙালপুরে আমি ট্রেনিং নিচ্ছিলাম। সম্মুখ যুদ্ধে যাবো। তখন কমান্ডার ছিল আমার বন্ধু আব্দুল জলিল, যিনি পরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। এরই মধ্যে চিঠি এলো জলিলের কাছে। অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব পাঠিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, 'আমাদের ফুটবল দল হচ্ছে। তুমি পিন্টুকে তোমার কাছে রাইখো না। পাঠিয়ে দাও। বড় দল হচ্ছে। সেই দলে অধিনায়ক থাকবে ও।' আসলে সেভাবেই শুরু।
এরপর কী হলো?
পিন্টু: তখন আমার স্ত্রীকে বিষয়টি খুলে বললাম। স্ত্রীও অনুমতি দিলো যাওয়ার জন্য। জলিলও তখন অনুমতি দিতে সময় নেয়নি। চিঠি পেয়ে কলকাতায় গেলাম। ওখানে গিয়ে অনেককে পেলাম। নেপথ্যে থাকা স্বপ্নদ্রষ্টা আলী ইমামও ছিলেন। প্রতাপ, আশরাফসহ অনেকেই আমাকে দেখে খুশি- 'জাকারিয়া পিন্টু এসেছে আমাদের মাঝে। আমাদের দল ভালো হবে।' ওখানে সিদ্ধান্ত হলো- স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠন হবে। ট্রায়াল হলো। ৩০ জন টিকলো। অধিনায়ক হলাম আমি, সহ-সভাপতি প্রতাপ শঙ্কর হাজরা।
স্বাধীন বাংলা দলের অধিনায়ক হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখবেন, এমনটি আগে চিন্তার মধ্যে ছিল?
পিন্টু: আমি তো সম্মুখ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। দেশের জন্য লড়াই করবো। তখন তো স্বাধীন বাংলা দল হয়নি। তাই চিন্তার মধ্যে ছিল না। তবে স্বপ্ন দেখছিলাম দেশ একদিন স্বাধীন হবে। আর আমাকে স্বাধীন বাংলা দলের অধিনায়ক করা হয়েছে, যা বিরল ঘটনা বলবো। পৃথিবীতে যা কেউ আর হতে পারবে না। যদি আবারও স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য দল গঠন না হয়!
আপনারা ভারতে তো খেলার মাঝে মাঝে বাংলাদেশের পতাকাও উড়িয়েছিলেন?
পিন্টু: স্বাধীনতার আগে ভারতের পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশেরটাও ওড়ানোর পরিকল্পনা করেছিলাম আগেই। তখন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ায় প্রীতি ম্যাচ ছিল। তখনকার জেলা প্রশাসককে চিঠি লিখলাম। তিনি কোনও উত্তর দিলেন না। খেলা ছিল ২৫ জুলাই। ২৪ তারিখ সেখানে যখন আমরা গেলাম, তখন তাকে জিজ্ঞাস করলাম, আমরা তো চিঠি দিয়েছিলাম। কোনও উত্তর পাইনি।
জেলা প্রশাসক বললেন, 'আমরা তো আপনাদের স্বীকৃতি দেইনি। আমাদের পক্ষে সেটা দেওয়া সম্ভব নয়।'
বিকাল ৫টায় ম্যাচ। কৃষ্ণনগরে হবে। সেখানে গিয়ে সবাইকে বললাম- খেলার আগে বুট খুলে ফেলো, কালই চলে যাবো। তখন জেলা প্রশাসক ডিকে ঘোষ আমাদের অবস্থা দেখে তাৎক্ষণিক সভা করে বললেন, 'আপনাদের পতাকা ১০ মিনিটের জন্য উঠবে। আমাদেরটার সঙ্গে।'
আমি আমাদেরটা আর উনি তাদের দেশের পতাকা ওড়ালেন। জাতীয় সংগীত বাজলো। সবার চোখে অশ্রু। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ভাবতেই শিহরণ জাগে। এরপর নদীয়া একাদশের সঙ্গে ২-২ গোলে গোলে ড্র হয়েছিল ম্যাচ। আমরা আসলে সেই সময় অনেক খুশি হয়েছিলাম। তখন ম্যাচের পর স্থানীয় অনেকেই এসে সাহস জোগালো যে দেশ দ্রুত স্বাধীন হবে, আপনারা পারবেন দেশ স্বাধীন করতে।
ভারতে কত দিন থাকতে হয়েছে?
পিন্টু: সাত-আট মাস থাকতে হয়েছে। ১৬টি ম্যাচ হয়েছে। কলকাতা, বিহার মুম্বাইসহ আশপাশে খেলতে হয়েছে। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। তখন অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অন্যরা সবাই অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে। আমরা বল পায়ে ভিন দেশে লড়াই-সংগ্রাম করে গেছি। সবকিছুই করেছি স্বাধীন দেশের জন্য।
একটু পেছনে ফিরে তাকাই। আপনি তো পাকিস্তান জাতীয় দলেও খেলেছেন। সেখানে বাঙালি খেলোয়াড়দের মূল্যায়ন কীভাবে হতো?
পিন্টু: একদমই মূল্যায়ন ছিল না। ট্রায়ালে মাকরানিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা হতো। ওদের উদ্দেশ্য ছিল কোনোভাবেই যেন পাকিস্তান জাতীয় দলে বাঙালিদের সুযোগ না হয়। তাই খেলার মধ্যে অহেতুক মারতো। যেন ইনজুরড হয়ে যাই। আমি, টিপু, নুরুন্নবীসহ চার-পাঁচ জন খেলেছিলাম। তখন আমাদের জিদ ছিল, কেন জাতীয় দলে জায়গা পাবো না।
আমাকে ওরা তাচ্ছিল্য করে বলতো, 'তুম তো বহত বড় প্লেয়ার হো। চাউল খাতা হে। মাঠ মে কেয়া খেলোগে। উধার কেয়া কারো গে। তখন থেকে চিন্তাটা দ্রুত চলে আসে- আজ দেশ স্বাধীন থাকলে হয়তো এমনটি শুনতে বা দেখতে হতো না। তাই সুযোগ আসতেই স্বাধীন বাংলা দলে যোগ দেই।
স্বাধীন বাংলা দলের হয়ে খেলে তো বিহারে মৃত্যুর মুখে পড়েছিলেন?
পিন্টু: বিহারের পূর্ণিয়াতে খেলতে যাই। তখন ওরা বলেছে, তোমরা আমাদের পাঞ্জাবিদের মেরে ফেলতেছো। তোমাদের আমরা ছাড়বো না! তবে আবার বললো, খেলো ঠিক আছে। কিন্তু গোল দিতে পারবে না। তখন সালাউদ্দিন হঠাৎ দূরপাল্লার শটে গোল দিয়ে ফেললো। তখন দর্শকরা আমাদের ওপর চড়াও হতে থাকে। রামদা নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে! কোনও মতে জীবন হাতে নিয়ে মাঠ ছেড়ে পালালাম। ভোররাতে গোপনে পূর্ণিয়ার হোটেল ছেড়েছিলাম আমরা।
আসলে প্রতিটি মুহূর্ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফুটবল নিয়ে যুদ্ধ করে গেছি। প্রতিনিয়ত আশা করে গেছি দেশ স্বাধীন হবে। স্বাধীন দেশে ফিরে নতুন করে ফুটবল নিয়ে মাঠে নামতে পারবো।
মুম্বাইতে তো অনেক তারকা এসেছিলেন, তারা কি খেলেছেন আপনাদের বিপক্ষে?
পিন্টু: আমাদের বিপক্ষে তখন নবাব মনসুর আলী পতৌদি খেলেন। অধিনায়ক হিসেবে। খেলার সময় তার সঙ্গে কায়কোবাদের ধাক্কা লাগে। পতৌদি পড়ে যান মাঠে। তিনি তখন বলে ওঠেন- 'আমি তো ক্রিকেট খেলোয়াড়। কেন মারতেছো।' কায়কোবাদ লজ্জায় পড়ে যান। পতৌদি ২০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন সেই সময়। দীলিপ কুমার, সায়রা বানু, শর্মিলা ঠাকুরসহ অনেকেই এসেছিলেন। সহমর্মিতা জানিয়েছেন।
আপনি তো ওয়ান্ডারার্স থেকে ১৯৬১ সালে মোহামেডানে যোগ দিয়েছিলেন। ক্যারিয়ারও শেষ করেছেন সাদা-কালো দলে। কোচিং করিয়েছেন। স্বাধীনতার পরে অন্য দলে যাননি কেন?
পিন্টু: আমি ডিটারমাইন্ড ছিলাম মোহামেডান ছেড়ে যাবো না। তাই করেছি। অনেকে প্রলোভন দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্লাব ছেড়ে যাইনি।
ওই সময় আবাহনীর মতো নতুন দল হয়েছিল?
পিন্টু: আমাকে অনেকে ডেকেছে। শেখ কামাল আমার কাছে এসে বলেছে, পিন্টু ভাই, 'আমার আবাহনীতে খেলেন।' তখন আমি বলেছি, হাজার চেষ্টা করেও আমাকে নিতে পারবে না (হেসে হেসে)।
আপনি তো স্বাধীন বাংলা দলের অধিনায়ক। মোহামেডানের টানা আটবারের অধিনায়ক। জাতীয় দলের প্রথম অধিনায়কও ছিলেন। ভাবতে এখনও কেমন লাগে?
পিন্টু: আমি পেলে ও ম্যারাডোনার চেয়ে একদিক দিয়ে ভাগ্যবান। আমার যা রেকর্ড আছে, তা তাদের নেই! তারা ঠিকই বিশ্বকাপ জিতেছেন। বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার, কিন্তু তাদের কারও ফুটবল খেলে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা রাখার সুযোগ হয়নি! কেননা, তাদের তো স্বাধীন বাংলা দল গঠনের সুযোগই হয়নি। এই জায়গায় আমি এগিয়ে আছি (হেসে হেসে)। আমার রেকর্ড থাকবে আজীবন। আমার মনে হয় না ভবিষ্যতে এমন কোনও দল আর হবে।
কিন্তু স্বাধীন বাংলা দল তো এখনও স্বাধীনতা পুরস্কার পায়নি?
পিন্টু: আমি ও কাজী সালাউদ্দিন পেয়েছি ব্যক্তিগতভাবে। আমার কাছে বিষয়টি খুবই খারাপ লাগে। প্রতি বছরই লেখা হয়। কেন দেওয়া হবে না পুরো দলকে। আমরা ব্যক্তিগতভাবে পেলেও কেন দলকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হবে না? স্বাধীনতা পদক না দেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার তো দেবেন। তাও দেওয়া হয়নি। এটা আমাকে এখনও পীড়া দেয়।
আপনার জীবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ভূমিকা আছে। সেই গল্প শুনতে চাই...
পিন্টু: অনেক বড় বিষয় এটা। আপনি কি জানেন বঙ্গবন্ধু ওয়ান্ডারার্সে স্ট্রাইকার ছিলেন? অধিনায়কও ছিলেন। ১৯৪০ থেকে ৪৮ সাল পর্যন্ত খেলেছেন। বঙ্গবন্ধু আমার হৃদয়ের লোক। আমি স্বাধীন বাংলা দলের অধিনায়ক হয়েছি বঙ্গবন্ধুর কারণে। কেউ হতে দিতো না। সেই বঙ্গবন্ধুই বলেছেন, পিন্টু অধিনায়ক হবে। তার অবদান বলে শেষ করা যাবে না।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম দেখা হয় কবে?
পিন্টু: বড় ইতিহাস আছে। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় তখন আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি। ১৯৫৫ সালের ঘটনা। আমাদের স্কুলের মাঠের পাশ দিয়ে তখন তিনি যাচ্ছিলেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভায়। আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন তিনি বললেন, 'তুই সামনে কেন দাঁড়ালি।' আমি বললাম, 'আপনার সম্মানে প্রীতি ম্যাচ খেলবো।' কী খেলা জানতে চাইলেন তিনি। ফুটবল ম্যাচের কথা শুনে বললেন, 'আমি আছি।'
এরপর কী হলো?
পিন্টু: আমি স্কুল দলের অধিনায়ক। আর আমার বাবা ডা. নজিব উদ্দিন আহমেদ অফিসার্স দলের অধিনায়ক। দুই দলের মধ্যে প্রীতি ম্যাচ হলো। সেই ম্যাচে আমি দুটো গোল করেছি। বঙ্গবন্ধু বললেন, 'তুই তো অনেক বড় খেলোয়াড় হবি। তুই খেল...। তোর বাবা কই?' আমার বাবাকে ডেকে হাতে হাত রেখে বললেন, 'আপনার ছেলেকে ফুটবলার বানাতে হবে।' তখন আমার বাবা কথা দিলেন আমাকে ফুটবলার বানাবেন। তারপর তো ফুটবলারই হলাম। তা না-হলে হয়তো ডা. জাকারিয়া পিন্টু হতাম (হেসে হেসে)।
তারপর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কবে দেখা হলো?
পিন্টু: স্বাধীনতার পর ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রীতি ম্যাচ। স্বাধীন বাংলা দলের হয়ে খেলি। অধিনায়ক হিসেবে। তখন তাকে মনে করিয়ে দিলাম সেই স্কুল জীবনের ঘটনা। তিনি ঠিকই মনে রেখেছেন সবকিছু।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আপনার প্রত্যাশা কী?
পিন্টু: সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশের ফুটবল এগিয়ে যাবে, অতীত ও বর্তমান মিলে। সবাই কাঁধে কাঁধ মিলে যেন এক হয়ে থাকতে পারি। দেশকে এগিয়ে নিতে পারি। বঙ্গবন্ধু যেমন বলেছেন, 'দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।' সেভাবে চলতে পারলে ভালো হবে।