মোটা দাগে ঢাকার খেলার মাঠ নিয়ে এই হলো পরিস্থিতি। নিজস্ব মাঠ না থাকলে যা হয় আর কি! এদিক-সেদিক ব্যবস্থা করেই ফুটবল কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। আসলে এই সমস্যা শুধু দ্বিতীয় বিভাগের দিলকুশা ক্লাবের নয়, দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা প্রিমিয়ার লিগ থেকে শুরু করে কিশোরদের পাইওনিয়ার লিগ পর্যন্ত বিস্তৃত।
শুধু ফুটবল নয়, অন্য খেলার জন্যও মাঠ অপর্যাপ্ত। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সময় অনুশীলন মাঠ নিয়ে থাকতে হয় সংকটে। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই সংকট বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। ইঁট-কাঠ-পাথরে আবদ্ধ এই শহরে এখন খেলার জায়গার বড্ড অভাব।
বিশেষ করে পেশাদার ফুটবল ক্লাবগুলো কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। প্রিমিয়ার ফুটবল লিগের ১৩টি দলের মধ্যে মাত্র পাঁচটি ক্লাবের নিজস্ব মাঠ আছে। সর্বোচ্চ লিগেই যখন এমন অবস্থা, তখন পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ কিংবা আরও নিচের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং পাইওনিয়ার লিগের চিত্র যে আরও করুণ, সেটা বলাই বাহুল্য! এমনকি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটেও পরিস্থিতি প্রায় একই রকম। সারা দেশে ৮টি আন্তর্জাতিক ভেন্যু থাকলেও ঢাকায় ঘরোয়া কার্যক্রম চালাতে সীমিত মাঠের উপর ভরসা করতে হয়।
দেশের দুই ঐতিহ্যবাহী দল আবাহনী ও মোহামেডান। আকাশি-নীল জার্সির আবাহনীর নিজস্ব মাঠ থাকলেও সাদা-কালো শিবির মোহামেডানের নেই। এ নিয়ে দলটির আক্ষেপের শেষ নেই। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের কাছে মতিঝিলে ক্লাব টেন্ট পেলেও এক চিলতে উঠানই তাদের ভরসা। অনুশীলনের জন্য কোনও মাঠ না পেলে ওই এক টুকরো মাঠ হয়ে যায় মহামূল্যবান! মোহামেডান ক্লাব কর্তৃপক্ষ অবশ্য প্রায় এক যুগ আগে মাঠ সংকট দূর করার উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে সাভারের বিরুলিয়ায় ১৩ একর জমি কিনলেও সেই জমি এখনও বুঝে পায়নি তারা।
মোহামেডানের মতো ঐতিহ্যবাহী দলই যেখানে মাঠ সংকটে, সেখানে অন্য দলগুলোর কথা না বলাই ভালো! মাঠের জন্য ঢাকার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে হয় ক্লাবগুলোকে। কমলাপুর স্টেডিয়াম, ফুটবল ফেডারেশনের মাঠ এবং বুয়েট মাঠের ওপর সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে। কারণ এই তিনটি মাঠের দিকে বেশিরভাগ ক্লাবের চোখ থাকে। এমনও দেখা গেছে, কমলাপুর স্টেডিয়ামে এক সঙ্গে ছয়টি দল অনুশীলন করছে! মাঠ সংকটে কমলাপুরে এক দিনে চারটি খেলার আয়োজন করেছে বাফুফে। কিছু করার নেই। ফুটবল ফেডারেশনকেও তো ঘরোয়া কার্যক্রম চালাতে হবে।
দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লিগের চ্যাম্পিয়ন মুগদা সমাজ কল্যাণ ও ক্রীড়া সংসদের মাঠ নেই। কমলাপুর স্টেডিয়ামে তারা অনুশীলন করেছে, ম্যাচও খেলেছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন অসহায় কণ্ঠে বলেছেন, ‘কী করবো বলুন? এলাকায় তো কোনও মাঠ নেই যে দল নিয়ে অনুশীলন করবো। তাই কমলাপুর মাঠই ভরসা। এখানেই কষ্ট করে অনেক দলের ভিড়ে অনুশীলন করতে হচ্ছে। অনেক বাধা পেরিয়ে শিরোপা জিতেছি আমরা।’
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র দল গড়তে কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রতি বছর। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগের দলটিরও মাঠ নেই। ঢাকার ক্লাব হয়েও মুক্তিযোদ্ধাকে অনুশীলন করতে হয় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গিয়ে। কোচ আব্দুল কাইয়ুম সেন্টু এ নিয়ে ভীষণ হতাশ, ‘ঢাকায় অনুশীলনের জন্য মাঠ পাওয়া খুব কঠিন। তাই ঢাকার বাইরে মাঠ খুঁজে বের করতে হয়েছে। এভাবেই চলছে আমাদের ফুটবল।’
আর্থিকভাবে শক্তিশালী ক্লাবগুলো তা-ও মাঠ ভাড়া করে কার্যক্রম চালাতে পারে। কিন্তু নিচের দিকের ক্লাবগুলোর অবস্থা রীতিমতো করুণ। প্রথম বিভাগের দল যাত্রাবাড়ী ক্রীড়া চক্রকে অনুশীলনের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি করতে হয়। ক্লাবটির ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান মোবারক হোসেনের মন্তব্য, ‘আমাদের মতো মাঝারি মানের দলের পক্ষে টিকে থাকাই কঠিন। নানা কারণে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অনুশীলন মাঠের জন্য খরচ।’
পাইওনিয়ার ফুটবল লিগে এলাকা ভিত্তিক দল অংশ নেয় বেশি। কিন্তু এখানেও সমস্যা কম নয়। পাইওনিয়ারের নিয়মিত দল মনসুর স্পোর্টিং ক্লাবের মালিক মনসুর আলী বলেছেন, ‘পাইওনিয়ার লিগের বেশ কয়েকটি ক্লাব স্থানীয় স্কুল কিংবা এলাকার মাঠে অনুশীলন করতে পারে। কিন্তু অনুশীলন তেমন ভালো হয় না। কারণ মাঠগুলো অনুশীলন উপযোগী থাকে না, এবড়ো-খেবড়ো থাকে।’
জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান মাঠের সমস্যা সমাধানে বললেন, ‘মাঠ ভরাট করে বহুতল বিল্ডিং তৈরি সবার আগে বন্ধ করতে হবে। পার্কগুলোও সংস্কার করতে হবে। এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।’
দেশের ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনও সমস্যাটা স্বীকার করলেন অকপটে, ‘মাঠ সমস্যা অনেক দিনের। এই সমস্যা সমাধানে সরকারের সব মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। সিটি করপোরেশন, ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সহ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
ছবি: নাসিরুল ইসলাম