তাঁত নিয়ে লিখতে লিখতে জন্ম নিল ‘দেশিমেড’

দেশিমেডের ফেসবুক কাভার

লক্ষ্মীর বাস বাণিজ্যে। কিন্তু ছেলেটি যে স্বরস্বতীর পূজারী। তাই কোনওদিন কারবারির খাতায় নাম লেখাবেন এমন চিন্তা মাথাতেই ছিল না। কিন্তু বাবা-দাদা সবাই যে ব্যবসায়ী। সেই ব্রিটিশ আমলেই দাদা সিরাজগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসামে গিয়েছিলেন ব্যবসা করতে। বাবাও একই পথের পথিক। কিন্তু নিজে ওই পথ মাড়াননি কোনওদিন। স্থানীয় স্কুল, কলেজ থেকে পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখান থেকে বিবিএ, এমবিএ। স্কুলে থাকাকালেই লেখালিখির চিন্তা মাথায় ঢুকেছিল। সেটা থেকে আর বেরুতে পারেননি। লিখতে লিখতে একদিন মনে হলো আরে, নিজের সম্প্রদায়ের কথা লিখলে কেমন হয়। বাপ-চাচা, আ্ত্মীয়স্বজন সবাই কাপড়ের কারবারি। তাঁতের খটরখটর শব্দ শুনে বড় হয়েছেন। তাই তাঁত নিয়েই লিখতে শুরু করলেন একদিন। ব্লগ খুললেন ওয়ার্ডপ্রেসে। লুঙ্গিওয়ালা নামে। চাকরির পাশাপাশি সময় পেলে একটু আধটু লেখা। 

লিখতে লিখতেই ভাবনা খেলে গেল। আচ্ছা, বাবার ব্যবসাটাকেই যদি অনলাইনে নিয়ে আসা যায়! ভাবলে কী হবে, স্বরস্বতী ছেড়ে লক্ষ্মীর সাধনায় সমাপন করা চাট্টিখানি কথা নয়। একদিন ফেসবুকে পেজ খুলে ফেললেন। উদ্দেশ্য, নিজের সম্প্রদায়ের তৈরি তাঁত পণ্য শহরের ব্যস্ত নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দেয়া। সেই পেজের নাম দিলেন দেশিমেড

এভাবেই দেশিমেড-এর শুরু। সেটা ২০১৬ সালের মার্চ মাসের ঘটনা। মূলত দেশের তৈরি পণ্য বিক্রির লক্ষ্য থেকেই দেশিমেড চালু করা। এই ক’মাসেই পেজটি বেশ পরিচিতি পেয়েছে। পেজের ফ্যান সংখ্যা ১৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। অর্ডারও মিলছে ক্রেতাদের কাছ থেকে। মূলত সিরাজগঞ্জে তৈরি শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা পাওয়া যায়। ভবিষ্যতে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তাঁতপণ্য রাখবেন বলে জানালেন দেশিমেড-এর কর্ণধার রেজাউল করিম। 

পাবনা জেলার ইতিহাস বইয়ের লেখক রাধারমণ সাহা প্রায় ১০০ বছর আগের জেলার তাঁতশিল্পের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন। সেখানে জেলার কোন এলাকায় কত তাঁত রয়েছে, সেই তথ্য মেলে। তাঁত পণ্য উৎপাদন নিয়েও রয়েছে কিছু তথ্য। এসব তথ্য তাঁতশিল্পে এই এলাকা কতোটা ঐতিহ্যমণ্ডিত সেটাই তুলে ধরে। এই ঐতিহ্যকেই দেশিমেড-এর মাধ্যমে সারাদেশের মানুষের হাতের নাগালে আনতে চেয়েছেন তিনি।

দেশিমেড

লুঙ্গিও অনলাইনে! এও দেখতে হলো! প্রথম প্রথম ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে এমন কথাও শুনেছিলেন রেজাউল করিম। তবে উৎসাহও দিয়েছেন অনেকে। এখন লোকজন আগ্রহ ভরে কিনছেন। দেশিমেড চালু প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে রেজাউল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমরা শাড়ি-লুঙ্গি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। আমরা দেখেছি, বড় বড় শপিংমলে আমাদের সিরাজগঞ্জের শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয়। তাই ক্রেতারা যাতে সুলভমূল্যে সিরাজগঞ্জের তাঁত পণ্য কিনতে পারেন, সেজন্য আমরা ফেসবুকভিত্তিক এই অনলাইন শপ চালু করেছি। সিরাজগঞ্জ থেকেই দেশের সবার কাছে সুলভ মূল্যে পণ্য পৌঁছানোর উদ্যোগ নিয়েছি। তাছাড়া তাঁতশিল্পে এখন দুর্দিন যাচ্ছে। অনলাইনে বিক্রি করার মধ্যে দিয়ে একে টিকিয়ে রাখারও একটা চেষ্টা বলতে পারেন।

দেশিমেড তাঁত কাপড় বিক্রির একটি অনলাইনভিত্তিক শপ হলেও তাদের কাছে ব্যবসাটাই সব নয়। বর্তমানে তাঁতশিল্পে খুব মন্দা যাচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁত। পৈত্রিক পেশা থেকে তাঁতীরা অন্য পেশায় যাচ্ছেন। তাঁতের সেই খটরখটর শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে এলাকা থেকে। সেজন্য তিনি চান তাঁত শিল্পে আবার জীবন ফিরুক। তিনি তার লুঙ্গিওয়ালা ব্লগে নিজের পরিচিতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আমার জন্ম বিকেলে। ছেলে হয়ে জন্ম নিলে আজান দেওয়া রীতি। আমার জন্মের পরও আজান দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আজানের শব্দের আগেই কানে এসে পড়েছিল তাঁতের খটরখটর শব্দ। জোলা বাড়ির ছেলে যে আমি! তাঁতের কাপড় বিক্রি করেই জুটেছে ভাত, কাপড়, স্কুলের খরচ। আজ তাঁতের ইতিকথা লিখে সেই ঋণ খানিকটা শোধ করার চেষ্টা করছি মাত্র’ আর এই জীবনদর্শনকে হাতিয়ার করেই তিনি ইন্টারনেটের দুনিয়ায় খুলে দিয়েছেন বা্ংলার আবহমান তাঁত সম্ভার দেশিমেড। দেশিমেডের ফেসবুক ঠিকানা: https://www.facebook.com/deshimade/?hc_ref=SEARCH

/এইচএএইচ/         

অারও পড়তে পারেন: ‘ই-জুডিসিয়ারি’ প্রকল্পের আওতায় ডিজিটাল হচ্ছে বিচার বিভাগ