প্রযুক্তির বায়ু-রোগ


ইমদাদুল হকবায়ুদূষণের মতো প্রযুক্তি আসক্তিও রোগাক্রান্ত করে তুলছে নতুন প্রজন্মকে। ভার্চুয়াল চোরাবালিতে কাটছে নির্ঘুম সময়। তারা সহজেই যেন প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠছে। প্রযুক্তির বায়ুরোগ যেন পেয়ে বসেছে আমাদের। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ছাড়া মানসিক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। গ্যাজেটে বুঁদ হয়ে থাকছে দিবানিশি।

ফেসবুক, ইউটিউব, ই-মেইল, মুভি  দেখা, গান শোনা কিংবা গেম খেলা এমন আবর্তেই যেন আটকে থাকছে আমাদের ব্যবহৃত স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ। এসব গ্যাজেটে ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত ভাষাবান্ধব কনটেন্ট না থাকা এবং উপযোগ-ব্যবহারের অভাবে প্রযুক্তির রূপান্তরটা যেন এখনও ফ্যাশন আর আসক্তি থেকে বের হতে পারছে না। আমাদের দৃষ্টি দেশ, সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি ও বৈশ্বিক পরিসর থেকে সীমাবদ্ধ হয়ে কেবল দু’একটি জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এতে অবশ্য মানসিক সন্তোষের একটা জায়গা তৈরি হচ্ছে। নিজেকে নিয়ে একটা নিরাপদ জীবন পার করার বন্দোবস্ত হচ্ছে। কিন্তু সামষ্টিকভাবে আমরা পিছিয়ে পড়ছি।
ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রযুক্তি বিনোদন জগতের আলোকছটায় চোখ ধাঁধিয়ে গেলে জ্ঞানের পরিসর তৈরি হয় না। তারুণ্যের জন্য এটা আরও মারাত্মক। সে কেবল চটকদার বস্তুর সন্ধান করতে থাকে। জীবনের বহুমাত্রিক ও কষ্টকর অভিযাত্রায় তার আগ্রহ থাকে না। শুধু নিজেকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা তার আত্মাকে সংকুচিত করে দেয়। শ্রমজীবী মানুষের হাহাকার, বন্যার্তদের আহাজারি, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত মানুষের লাশ, ধর্ষিতার আত্মহনন, সা¤্রাজ্যবাদের কুটিল বিস্তারিত কিছুই তাকে ভাবায় না। নিজস্ব বিনোদন, পিসির মনিটর, আইফোন আর প্রতিদিনের সেলফি তোলা তাকে বড় আত্মপূজারী করে তোলে। পৃথিবী চায় অন্ন, বস্ত্র, সম্ভ্রম, শ্রমের মর্যাদা। আর প্রজন্ম চায় লাইক, কমেন্ট, শেয়ার। অন্তর্গত ক্ষয়ের এই বিমর্ষ চিত্র কি আপনাকে আলোড়িত করে? দিনশেষে কখনও কি আন্দোলিত করে চিন্তার জগতকে?
হ্যাঁ, এই ট্রেন্ডটা আসলেই অনেক শক্তিশালী। কারণ, এর সঙ্গে সমাজের বিভাজন এবং সম্পদের অসম বণ্টনের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। নিরপেক্ষ থাকা ও নিরাপদ থাকার প্রবণতা লুকিয়ে আছে। নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, খোলসে আবৃত হওয়ার ইচ্ছে নিহিত আছে। এজন্যই আমরা জ্ঞানের পরিসর বাড়ানোর কথা বলি। নতুন চিন্তা বিকাশের জন্য প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার কথা অনুভব করি। যত বেশি চিন্তার চর্চা হবে, আমি তত বেশি সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে সরব হবো। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিষ্পেষণের বিপক্ষে সোচ্চার হবো। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকারের জন্য কথা বলব। জানার শক্তি প্রতিরোধ করবে জ্ঞানপাপীর বিলাসী সংলাপ।
সঙ্গত কারণেই অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা কমিউনিটি ব্লগগুলোতে চোখ রাখলে এমন দূষণ হামেশা দেখা মেলে। এখানে যেমন ভাষাদূষণ আছে, তেমনি আছে রুচিদূষণও।
অবশ্য সম্প্রতি ই-বর্জ্য নিয়ে একটি খসড়া তৈরি হয়েছে। ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য থেকে সৃষ্ট বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০১৭ শীর্ষক এই খসড়া বিধিতে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ক্রেতাসহ সুনির্দিষ্ট ছয়টি পর্যায়ে দায়িত্ব বণ্টন হয়েছে। এতে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য থেকে সৃষ্ট বর্জ্য (ই-বর্জ্য) উৎপাদনকারী বা সংযোজনকারীকে ফেরত নেওয়ার বিধি যেমনটা রয়েছে, তেমনি ক্রেতাকে পণ্যমূল্য অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট হারের অর্থ বিক্রেতার কাছে জামানত হিসেবে জমা রাখার বিধানও রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত আলোচনার টেবিলেই জায়গা হয়নি প্রযুক্তির বায়ু রোগটির।

প্রযুক্তির বায়ুদূষণ আমাদের দৃষ্টির অগোচরে থাকছে। আইন দিয়ে প্রশমনের ব্যর্থ চেষ্টা চলছে। কেননা প্রযুক্তি নিয়ত উন্নয়ন ধারায় থাকায় সমস্যা প্রকট হওয়ার পর উদ্যোগ নেওয়ার চেয়ে প্রতিষেধক নিয়ে কাজ না করলে নিয়ত রক্তাক্ত হতে হবে। এ অবস্থা  থেকে উত্তরণের জন্য প্রযুক্তির টেকসই বা লাগসই ব্যবহারের পাশাপাশি আচরণগত পাঠও জরুরি। এখানে হেঁসেল আর বৈঠকখানার দূরত্বটা যেমন বজায় রাখা আছে, তেমনি ভার্চুয়াল এই আকাশে কার্বন নির্গমন হ্রাসে ব্যবহৃত জ্বালানি বিষয়েও আমাদের সচেতনতা দরকার। এই অন্তর্জাল যেন অন্তরের জ্বালা না হয়; বিনিসুতোয় বাঁধার পরিবর্তে জালের প্যাঁচে ফেলে না দেয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

/এইচএএইচ/