সফটওয়্যার আমদানিতে ‘বিশেষ সুবিধা’ কাদের স্বার্থে?

 



সফটওয়্যার

২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে সফটওয়্যার আমদানিতে শুল্ক কমানো ও ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে দেশীয় সফটওয়্যার খাতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। বাজার ধ্বংসের পাশাপাশি স্থানীয় সফটওয়্যার নির্মাতারা পথে বসে যাবে। দেশীয় সফটওয়্যার খাতের বিকাশের পরিবর্তে বিদেশি সফটওয়্যার বাজার দখল করে নেবে।


বাজেট ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী সফটওয়্যার আমদানির ওপর থেকে ২০ শতাংশ শুল্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছেন।
জানতে চাইলে বেসিসের (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বললেন ভিন্ন কথা। তিনি মনে করেন, এটা হয়তো ভুলে হয়েছে। তার আশা, সরকার এটা বাজেট পাসের আগেই ঠিক করে দেবে। তা না হলে দেশীয় সফটওয়্যার খাত বড় ধরনের অসুবিধার মধ্যে পড়বে। বেসিস সভাপতি বলেন, ‘আমরা সংশ্লিষ্ট মহলকে আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। শিগগিরই আমরা এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করবো। আশা করছি এর একটা সুরাহা হবে।’ বিদেশি সফটওয়্যারের টোটাল আমদানি শুল্ক ও কর প্রায় ৫৯ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনাকে নিছকই তিনি ভুল বোঝাবুঝি হিসেবে দেখছেন!
ডাটাবেজ, অপারেটিং সিস্টেম, ডেভেলপমেন্টস টুল, প্রোডাক্টিভিটি, অটোমেটিক ডাটা প্রসেসিং মেশিনের জন্য কমিউনিকেশন বা কোলাবরেশন সফটওয়্যারসহ বিভিন্ন সফটওয়্যারে শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুল্ক ও ভ্যাট মিলিয়ে ৪০ শতাংশ দেখালেও আমদানি মোট খরচ (শুল্ক, ভ্যাটসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে) প্রায় ৫৯ শতাংশ।
বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘এই প্রস্তাবনা পাস হলে দেশীয় সফটওয়্যার খাত বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। যে সফটওয়্যার দেশেই তৈরি হয়, সেগুলোর আমদানির শুল্ক যদি একেবারে কমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে দেশি কোম্পানিগুলো একেবারে পথে বসে যাবে। বিদেশি সফটওয়্যার বাদ দিয়ে কেউ দেশি সফটওয়্যার কিনতে চাইবে না।’ তিনি মনে করেন, দেশে যেসব বিদেশি কোম্পানি সফটওয়্যার বিপণন করছে, তারা হয়তো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) প্রভাবিত করে নিজেদের স্বার্থে কাজটি করিয়েছে। এটা দেশীয় সফটওয়্যার খাতে সংকট তৈরি করবে।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, অপারেটিং সিস্টেম, ডাটাবেজ সফটওয়্যার দেশে আসুক, শুল্ক যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা হোক। সবসময় যেভাবে কেনা হচ্ছে, এসব সেভাবেই কেনা হবে। অন্যদিকে ইআরপি, ইআরএম বা অ্যাকাউন্টিং সফটওয়্যার দেশেই তৈরি হচ্ছে। সরকারের উচিত এসব সফটওয়্যার তৈরিতে উৎসাহ দেওয়া। তা না করে সফটওয়্যার আমদানিতে শুল্ক কমানো ও ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এখন দেদার এসব সফটওয়্যার আমদানি হবে। বিদেশপ্রীতির কারণে অনেকেই দেশি সফটওয়্যার ফেলে বেশি দামে বিদেশি সফটওয়্যার কিনতে উৎসাহী হবে। ফলে দেশীয় নির্মাতারা ক্রেতা পাবে না। বাজার হারাবে। এই বিষয়গুলো সরকারের বিবেচনা করা উচিত বলে অনেকেই মনে করেন।
বেসিসের সাবেক সভাপতি শামীম আহসান বলেন, ‘বাংলাদেশে যেসব বিদেশি সফটওয়্যার কোম্পানি ব্যবসা করছে সেসব প্রতিষ্ঠান কর অব্যাহতি পাচ্ছে। বরং এসব কোম্পানিকে করপোরেট করের আওতায় আনা উচিত। তা না করে তাদের সুবিধা দিতে শুল্ক কমানো হয়েছে এবং ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সব সময় বলে এসেছি, অপারেটিং সিস্টেম, ডাটাবেজ সফটওয়্যার যেগুলো দেশে তৈরি হয় না, সেগুলোর আমদানি শুল্ক ‘মিনিমাম’ করা উচিত। তাহলে দেশে লাইসেন্সড সফটওয়্যারের ব্যবহার বাড়বে। আর ইআরপি, ইআরএম ও অ্যাকাউন্টিংয়ের মতো যেসব সফটওয়্যার দেশে তৈরি হচ্ছে, সেগুলোর আমদানি শুল্ক ম্যাক্সিমাম করা উচিত। তাহলে দেশীয় সফটওয়্যার খাত বিকশিত হবে। কিন্তু তা না করে বরং উল্টোটা করা হয়েছে—যা দেশীয় সফটওয়্যার খাতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।’
বেসিসের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি রাসেল টি আহমেদ জানান, দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বিকাশে হুমকি বাড়িয়ে বিদেশি সফটওয়্যার আমদানি কর ৫৮ থেকে মাত্র ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি মনে করেন, বিদেশি কোম্পানির হয়ে এমন সফল লবিং নিশ্চয়ই আমাদের মধ্য থেকেই কেউ কেউ করেছেন। বিদেশি সফটওয়্যারের ওপর কর মাটিতে নামিয়ে আনার প্রস্তাবে আমাদের স্থানীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং দেশীয় সফটওয়্যার খাতের উন্নয়ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।